ড. শেখ সালাহ্উদ্দিন আহ্মেদ
দেশের পোলট্রিশিল্প বর্তমানে কঠিন সমস্যার মুখোমুখি। সংশয়ের সৃষ্টি এমনকি সম্ভাবনাময় শিল্পটিতে দেশি উদ্যোক্তারা অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারবেন কিনা তা নিয়েও। বিদেশি বিনিয়োগের ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোনো নীতিমালা না থাকার সুযোগ নিয়ে দেশের পোলট্রিশিল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ শুধু নয়, বিদেশিদের কর্তৃত্ব ও আধিপত্যও বেড়ে চলেছে। বর্তমানে পোলট্রিশিল্প বাজারের ৪৫ শতাংশই নিয়ন্ত্রণ করছে বিদেশি কোম্পানিগুলো। উল্লেখ্য, যে সাতটি বিদেশি কোম্পানি শিল্পটিতে বিনিয়োগ করেছে সেগুলোর মধ্যে ভারতীয় কোম্পানিই রয়েছে পাঁচটি। আরো আটটি বিদেশি কোম্পানিকে বর্তমান সরকার বিনিয়োগ ও ব্যবসা করার অনুমতি দিয়েছে।
এসব কোম্পানির ব্যাপারে সরকারের সুস্পষ্ট কোনো নীতিমালা বা নির্দেশনা না থাকায় পর্যায়ক্রমে সম্পূর্ণ পোলট্রিশিল্পই বিদেশিদের নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন দেশি ব্যবসায়ীরা। এর ফলে বাংলাদেশের যেসব কোম্পানি ও ব্যক্তি মালিক শিল্পটিতে জড়িত রয়েছে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়তে পারে। কারণ, বিদেশি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার মতো অর্থনৈতিক সামর্থ্য তাদের নেই। এ প্রসঙ্গে বিশেষ করে সামনে এসেছে ক্ষুদে উদ্যোক্তা এবং ব্যক্তি পর্যায়ের ব্যবসায়ী তথা খামারিদের কথা। স্মরণ করা দরকার, ২০০৮ সালে প্রণীত নীতিমালায় পোলট্রিকে প্রাণীজ কৃষিখাত হিসেবে ঘোষণা দিয়ে বলা হয়েছিল, এই শিল্পে শস্য খাতের সমান সুযোগ-সুবিধা দেয়া হবে। অন্যদিকে বাস্তব ক্ষেত্রে বড় বড় কিছু কোম্পানি বা খামারি অন্য কোনো খাত দেখিয়ে মাঝে-মধ্যে সামান্য পরিমাণের ব্যাংক ঋণ পেলেও ব্যক্তি পর্যায়ের ক্ষুদে উদ্যোক্তারা কোনো ঋণই পাচ্ছেন না। অথচ তিলে তিলে গড়ে ওঠা এই শিল্পটি দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রেখে চলেছে।
এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, কম করে হলেও ৬০ লাখ যুবক-যুবতী ও সাধারণ নারী-পরুষ এই শিল্পে চাকরি করছেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবসায়ীরা বলেছেন, ব্যাংক ঋণসহ সামান্য কিছু সুযোগ-সুবিধা দেয়া হলে পোলট্রিশিল্প দেশে আয়-রোজগারের একটি বড় খাতে পরিণত হতে পারে। বর্তমানে পোলট্রিশিল্পে লেনদেন হচ্ছে প্রায় ৩০ হাজার ৪২ কোটি টাকা। শহর ও নগর থেকে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত পুষ্টি চাহিদারও বিরাট একটি অংশ পোলট্রির মাধ্যমেই পূরণ করা যাচ্ছে। পাশাপাশি রফতানির পরিমাণও ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। এমন অবস্থায় অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেয়ার পরিবর্তে ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে সরকারের সহযোগিতা দেয়া হলে শিল্পটি দেশে নীরব বিপ্লব ঘটাতে পারে। কারণ, এই শিল্পের জন্য শহুরে দামি জমি বা শিল্প প্লটের দরকার পড়ে না। বক্তি পর্যায়ের উদ্যোক্তারা এমনকি গ্রামে তাদের নিজেদের বাড়ির আঙ্গিনাতেই খামার তৈরি করে নিতে পারে। কিন্তু সব সম্ভাবনাই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ব্যাংক ঋণসহ সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ার কারণে।
অন্যদিকে রয়েছে বিদেশি কোম্পানিগুলোর অনিয়ন্ত্রিত কর্মকা-। অনেক বেশি পুঁজি বিনিয়োগ করে সক্ষমতার দিক থেকে তারা শুধু দেশি খামারিদের ছাড়িয়ে যাচ্ছে না, টাকার জোরে বাজারও দখল করে নিচ্ছে। মুরগি ও ডিমের দাম বাড়বে কি কমবে তা যেমন তাদের ইচ্ছার বিষয়ে পরিণত হয়েছে তেমনি পুরো বাজারও চলে গেছে তাদের নিয়ন্ত্রণে। সময়ে সময়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করার মধ্যদিয়ে তারা এমনকি প্রচুর বাড়তি মুনাফাও লুটে নিচ্ছে। কিন্তু মূলত যথেষ্ট পরিমাণ পুঁজির অভাবে দেশি উদ্যোক্তা ও খামারিরা বিদেশিদের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারছেন না। প্রতিযোগিতায় তো টিকে থাকতে পারছেই না। এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই পোলট্রিশিল্পের ব্যাপারে ২০০৮ সালের নীতিমালা সংস্কার করে নতুন এবং সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করার দাবি উঠেছে। দেশি উদ্যোক্তা ও খামারিরা যাতে ব্যাংক ঋণসহ সুযোগ-সুবিধা পেতে পারেন এবং বিদেশি কোম্পানিগুলো যাতে যথেচ্ছভাবে কর্মকা- চালাতে ও বাজার নিয়ন্ত্রণ না করতে পারে সে লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেয়ারও দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
আমরাও মনে করি, পোলট্রি একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় শিল্প খাত। এতে বিপুল পরিমাণ পুঁজির যেমন দরকার হয় না তেমনি দরকার হয় না কোটি কোটি টাকার জমিরও। গ্রামের বাড়ির আঙ্গিনায়ও যেহেতু খামার করা সম্ভব এবং করা হচ্ছেও সেহেতু খাতটির জন্য সামান্য পরিমাণ ঋণ ও সুযোগ-সুবিধাই যথেষ্ট হতে পারে। সেটা করা সরকারের পক্ষে সহজেই সম্ভব। তাছাড়া ২০০৮ সালের নীতিমালায় একে প্রাণীজ শস্য খাত হিসেবে ঘোষণাও দেয়া হয়েছে। সে কারণে সরকারকে মৌলিক কোনো পরিবর্তন আনতে হবে না। এখন দরকার আসলে এমন ব্যবস্থা নেয়া, যাতে ক্ষুদে উদ্যোক্তা থেকে ব্যক্তি খামারি পর্যন্ত দেশের প্রত্যেকে চাহিদা অনুযায়ী ব্যাংক ঋণ ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পেতে পারে। একই সাথে বিদেশি কোম্পানিগুলোর জন্যও দরকার কঠোর নীতিমালা। তারা ঠিক কি পরিমাণ পুঁজি বিনিয়োগ করতে পারবে সেটা যেমন নির্দিষ্ট করে দেয়া দরকার তেমনি দরকার এমন কঠোর আইনও, তারা যাতে বাজার দখল ও নিয়ন্ত্রণের সুযোগ না পায়। আমরা আশা করতে চাই, সমগ্র প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে সরকার পোলট্রিশিল্পের সুষ্ঠু বিকাশের লক্ষ্যে জরুরি ভিত্তিতে ইতিবাচক ও সুফলপ্রসূ পদক্ষেপ নেবে।
ষ লেখক : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট ও সভাপতি, সাউথ এশিয়ান ল’ইয়ার্স ফোরাম
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন