রাশিয়া শুক্রবার ইউক্রেনে তার সামরিক অভিযান আরও জোরদার করেছে। গতকাল তারা প্রথমবারের মতো কিয়েভের পশ্চিমে বিমানবন্দরের কাছাকাছি হামলা চালিয়েছে। পর্যবেক্ষক এবং স্যাটেলাইট ফটোগুলো ইঙ্গিত দেয় যে, রাশিয়ার সামরিক কনভয় রাজধানী কিয়েভ ঘেরাও করে ফেলেছে।
ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযান এখন তৃতীয় সপ্তাহে পড়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করার এবং তার সবচেয়ে পছন্দের বাণিজ্য মর্যাদা প্রত্যাহার করে নিষেধাজ্ঞার জন্য তাদের প্রচেষ্টা বাড়াতে প্রস্তুত। পশ্চিম ইউক্রেনে নতুন বিমান হামলা সম্ভবত রাশিয়ার কাছ থেকে একটি বার্তা ছিল যে, কোনও এলাকাই নিরাপদ নয়। এখনও পর্যন্ত রুশ সেনা উত্তরে এবং কিয়েভের আশেপাশের দক্ষিণ এবং পূর্বের শহরগুলোতে সর্বাধিক অগ্রগতি করেছে। স্যাটেলাইট থেকে পাঠানো ছবিতে কিয়েভের কাছে একটি রুশ সেনাবহর দেখা গিয়েছে। সেখানে কিয়েভের আশেপাশের অঞ্চলে রুশ বাহিনীকে পুনরায় মোতায়েন হতে দেখা গেছে। এটি ইউক্রেনের রাজধানীর দিকে রুশ বাহিনীর নতুন করে অগ্রসর হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক কোম্পানি ম্যাক্সার টেকনোলজিস জানিয়েছে যে, বৃহস্পতিবার তোলা স্যাটেলাইট চিত্রগুলি দেখায় যে যানবাহন, ট্যাঙ্ক এবং আর্টিলারির ৬৪ কিলোমিটার (৪০-মাইল) লম্বা লাইন ভেঙে দিয়ে পুনরায় স্থাপন করা হয়েছে। সংস্থাটি বলেছে যে, চিত্রগুলিতে দেখা গেছে রুশ সাঁজোয়া ইউনিটগুলি কিয়েভের উত্তর-পশ্চিমে আন্তোনোভ বিমানবন্দরের কাছের আশেপাশের শহরগুলির মধ্যে এবং এর মধ্য দিয়ে চালনা করছে। কনভয়গুলোকে শেষবার আন্তোনভ বিমানবন্দরের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে দেখা গিয়েছিল - কিন্তু এখন সেগুলো আশেপাশের শহরে অবস্থান নিতে সরে গিয়েছে। ম্যাক্সার বলছে যে অন্যান্য ছবিতে দেখা যায় যে, কিছু কনভয় লুবিয়াঙ্কার কাছে অবস্থান নিয়েছে এবং কাছাকাছি আর্টিলারি স্থাপন করেছে।
এর আগে বৃহস্পতিবার একজন ঊর্ধ্বতন মার্কিন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা বলেছিলেন যে রুশ বাহিনী গত ২৪ ঘণ্টায় কিয়েভের তিন মাইল বা ৫ কিলোমিটার কাছাকাছি এগিয়ে এসেছে। এর অর্থ হল, রাজধানীর উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে এগিয়ে আসা রাশিয়ান সৈন্যরা এখন কিয়েভের কেন্দ্র থেকে মাত্র নয় মাইল বা ১৫ কিলোমিটার দূরে রয়েছে। সেইসাথে উত্তর-পূর্ব দিক থেকে এগিয়ে আসা রাশিয়ান বাহিনী শহর থেকে ২৫ মাইল বা ৪০ কিলোমিটার দূরে রয়েছে। উত্তরের শহর চেরনিহিভ এখন ‘বিচ্ছিন’ হয়ে পড়েছে বলে, কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। ইউক্রেনে সামরিক আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর থেকে রুশ বাহিনী এ পর্যন্ত ৭৭৫টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে বলে তারা জানান।
এদিকে ইউক্রেনের বিমান বাহিনী বলেছে যে, তারা বৃহস্পতিবার ১০টি রাশিয়ান যুদ্ধবিমানকে আঘাত করেছে এবং দুটি বড় অস্ত্রবাহী কনভয় ধ্বংস করেছে। রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে বিষয়টি এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ইউক্রেনীয় সৈন্যরা সেখানে রাজধানীতে যাওয়ার প্রধান মহাসড়কের নিয়ন্ত্রণের জন্য ভয়ঙ্কর লড়াইয়ের বর্ণনা দিয়েছে এবং এএফপি সংবাদ সংস্থার সাংবাদিকরা কিয়েভর শহরের সীমানার বাইরে ভেলিকা ডাইমেরকাতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা দেখার কথা জানিয়েছেন।
নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক : যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় ইউক্রেন জীবাণু অস্ত্র উন্নয়নে কাজ করছে এমন অভিযোগ করেছে রাশিয়া। এ সংক্রান্ত আলোচনার জন্য গতকাল জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ জরুরি বৈঠকে বসেছে। বৈঠকটি রাশিয়ার অনুরোধে অনুষ্ঠিত হয়। পশ্চিমাদের অভিযোগ, ভবিষ্যৎ কোনো জৈব ও রাসায়নিক হামলার ভিত্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ইউক্রেনের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ এনেছে রাশিয়া। জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের মিশনের একজন মুখপাত্র বলেছেন যে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে তাদের ভুল তথ্য প্রচারের স্থান হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে রাশিয়া।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, কোনো ধরনের জৈব অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে না তার দেশ। বরঞ্চ ইউক্রেনের বেসামরিক নাগরিকের ওপর এ ধরনের অস্ত্র ব্যবহারের পরিকল্পনা করছে রাশিয়া। আরটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়ার দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান অ্যাভরিল হেইন্স। এ ছাড়াও সিনেট ইন্টিলিজেন্স কমিটিকে দেয়া বক্তব্যে হেইন্স বলেন, ‘আমরা মনে করি না ইউক্রেন কোনো জৈব, রাসায়নিক অস্ত্র বা পারমাণবিক বোমা বানানোর চেষ্টা করছে।’ এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র বিভাগের মুখপাত্র নেড প্রাইস বলেন, ‘ইউক্রেনে কোনো রাসয়নিক বা জৈব গবেষনাগার পরিচালনা করে না যুক্তরাষ্ট্র। এই ধরণের কোনো অস্ত্রও তারা কোথাও তৈরি করছে না।’
হোয়াইট হাউজের মুখপাত্র জেন সাকিও রাশিয়ার অভিযোগকে মিথ্যা ও প্রপাগান্ডা হিসেবে অভিহিত করেছেন। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডবিøউএইচও) পক্ষ থেকে ইউক্রেনকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে, ‘সম্ভাব্য ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে’ গবেষণাগারে রাখা বিপজ্জনক জীবাণু ধ্বংস করে ফেলার জন্য। ডবিøউএইচও’র একজন কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে এমনটাই জানিয়েছেন।
জ্বালানি মূল্য বৃদ্ধির জন্য রাশিয়া দায়ী নয় : রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন মনে করেন, পশ্চিমারা বিশ্বে জ্বালানি মূল্য বৃদ্ধির জন্য রাশিয়াকে দায়ী করার চেষ্টা করছে। বৃহস্পতিবার সরকারের সদস্যদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি এ অভিমত ব্যক্ত করেন। পুতিন বলেন, ‘সেখানে (ইইউ দেশগুলোতে জ্বালানি বাহকদের জন্য) দাম বাড়ছে, কিন্তু আমাদের ভুলের কারণে নয়। এটা তাদের নিজেদের ভুল হিসাব-নিকাশের ফল। এর জন্য তাদের আমাদের দোষারোপ করা উচিত নয়।’ ‘এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তেল এবং পেট্রোলিয়াম পণ্যের দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তারা ঘোষণা করেছে যে, তারা আমেরিকান বাজারে রাশিয়ান তেল আমদানি বন্ধ করছে, সেখানে দাম বেশি, মুদ্রাস্ফীতি অভ‚তপূর্বভাবে বেশি, সম্ভবত সর্বকালের মধ্যে পৌঁছেছে তারা তাদের নিজেদের ভুলের ফলাফলের জন্য আমাদের উপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করছে,’ রাশিয়ান নেতা পরিস্থিতি বর্ণনা করেছেন।
তার মতে, এটি বাজার বিশেষজ্ঞদের কাছে স্পষ্ট, ‘কারণ আমেরিকান বাজারে রাশিয়ান তেলের সরবরাহ ৩ শতাংশের বেশি নয়।’ ‘এটি একটি নগণ্য পরিমান, এবং তাদের দাম বাড়ছে। এর সাথে আমাদের একেবারেই কিছুই করার নেই, এবং এমনকি এখানে রাশিয়ান তেল আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞার সাথে একেবারে কিছুই করার নেই। তারা আবার এই সিদ্ধান্তের আড়ালে লুকিয়ে আছে। তাদের নিজস্ব জনগণকে প্রতারিত করে,’ পুতিন বলেছিলেন।
রাশিয়ান নেতা এই বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমনকি সেই দেশগুলির সাথে আলোচনা করার চেষ্টা করছে যেগুলির বিষয়ে ওয়াশিংটন একবার অবৈধ বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল। ‘তারা ইরানের সাথে শান্তি স্থাপন করতে প্রস্তুত, অবিলম্বে সমস্ত নথিতে স্বাক্ষর করতে এবং ভেনিজুয়েলার সাথে। তারা ভেনিজুয়েলায় আলোচনার জন্য গিয়েছিল, কিন্তু তাদের এই অবৈধ নিষেধাজ্ঞাগুলি চালু করা উচিত ছিল না,’ পুতিন বলেছেন। ‘আমাদের দেশের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটবে, এতে আমার কোন সন্দেহ নেই,’ তিনি জোর দিয়ে বলেছেন।
মস্কো যুদ্ধ নয়, স্বাধীনতা চায় : দেখতে দেখতে ষোলো দিনে পা দিয়েছে ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযান। একাধিক বৈঠকেও মেলেনি রফাসূত্র। যুদ্ধ দীর্ঘদিন চলতে পারে, এই আশঙ্কা বাড়ছে। এর মধ্যেই রাশিয়া জানাল, তারা দ্রুত এই সংঘর্ষের সমাপ্তি চায়। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সার্গেই ল্যাভরভ এমনটাই জানিয়েছেন। রাশিয়ার সরকারি সংবাদ সংস্থা তাস জানিয়েছে ল্যাভরভ এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, ‘মস্কো কখনওই যুদ্ধ চায়নি। এবং এই সংঘর্ষ শেষ করতেও উন্মুখ হয়ে রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘রাশিয়া পশ্চিমাদের থেকে নিরাপত্তা ও তাদের থেকে স্বাধীন থাকতে চায়।’ যদিও রাশিয়ার এই বিবৃতি সত্তে¡ও যুদ্ধ সত্যিই এখনই থামবে কিনা তা নিয়ে সন্দিহান ওয়াকিবহাল মহল।
রাশিয়ার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ইউরোপকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে : বর্তমানে রাশিয়ার ওপর সবচেয়ে বেশি নিষেধাজ্ঞার অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় ২০১৪ সাল থেকে রাশিয়ার ওপর মোট ৫৫৩২টি শাস্তি আরোপ করা হয়। যা ইরান ও সিরিয়ার চেয়েও বেশি। আর এর মধ্যে ২৭৭৮টি নিষেধাজ্ঞা ২২ ফেব্রুয়ারির পর আরোপ করা হয়। তবে, এসব শাস্তি আরোপের পর কিছু দেশের অবস্থা আরো জটিল হয়েছে। পরিস্থিতি বিশ্লেষণে দেখা যায়, রাশিয়ার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ইউরোপকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
যেমন, ইইউর সদস্য দেশগুলো ও ব্রিটেন। এসব দেশের শিল্প ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বিপুল পরিমাণের প্রাকৃতিক গ্যাস প্রয়োজন। আর যা নির্ভর করে রাশিয়ার ওপর। তাদের ৪০ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাস রাশিয়া থেকে আমদানি করা হয়। তাই ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরু হলে ইউরোপের প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম ২০ শতাংশ বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে তেলের দামও বেড়েছে। এ ছাড়া ইউরোপীয় দেশগুলোর বিমান চলাচলের ক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেকেই বলছে, বিশ্ব রাশিয়াকে শাস্তি দিচ্ছে না, যুক্তরাষ্ট্র আসলে ইউরোপকে শাস্তি দিচ্ছে।
উল্লেখ্য, গত ২৪ ফেব্রুয়ারী, রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ডনবাস প্রজাতন্ত্রের প্রধানদের অনুরোধের ভিত্তিতে ইউক্রেনে একটি বিশেষ সামরিক অভিযানের ঘোষণা করেছিলেন। রাশিয়ান নেতা জোর দিয়েছিলেন যে, মস্কোর ইউক্রেনীয় অঞ্চলগুলো দখল করার কোন পরিকল্পনা নেই এবং লক্ষ্য ছিল দেশটিকে নিরস্ত্রীকরণ এবং ডিনাজিফাই করা। সূত্র : সিআরআই, আল-জাজিরা, তাস, বিবিসি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন