বর্ষা মৌসুম আসতে এখনো মাস চারেক বাকি। এরই মধ্যে খুলনার বিভিন্ন স্থানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুর্বল বেড়িবাঁধে ফাটল দেখা দিয়েছে। দু’দিন আগে রূপসা উপজেলায় নৈহাটি ইউনিয়নে আঠারোবাকী নদীর বেড়িবাঁধে ব্যাপক ফাটল দেখা দিয়েছে। ঝুঁকিতে রয়েছে কয়রা, পাইকগাছা, বটিয়াঘাটা, দাকোপ উপজেলার প্রায় ৮০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের কমপক্ষে সাড়ে ৪শ’ টি পয়েন্ট। এখনই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাঁধ মেরামত না করলে বর্ষা মৌসুমে ভাঙন ভয়াবহ আকার ধারণ করবে বলে আশংকা সংশ্লিষ্টদের।
বর্ষাকাল মানেই খুলনাঞ্চলের উপকূলীয় বেড়িবাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা তালিয়ে যাওয়া। প্রতি বছর বেড়িবাঁধ ভেঙে হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে। ফসলের ক্ষেত, মাছের ঘের তলিয়ে অর্থনৈতিক দূরবস্থার শিকার হন সমগ্র খুলনাঞ্চলের মানুষ। ১৯৬৭-১৯৬৮ সালের দিকে নির্মিত বেড়িবাঁধগুলো এতোটাই দূর্বল হয়ে পড়েছে যে, সামান্য জোয়ারের চাপে বাঁধ ভেঙে যায়, হু হু করে পানি প্রবেশ করে লোকালয়ে। বাঁধ মেরামতের নামে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা লুটপাট করে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন অসাধু কিছু জনপ্রতিনিধি, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা ও স্থানীয় প্রভাবশালী মহল। দুর্নীতির মচ্ছবে কাগজে কলমে বাঁধ মেরামত হয়, বাস্তব সুফল পান না এলাকাবাসী।
বর্ষা মৌসুমের আগেই খুলনায় বেড়িবাঁধে ফাটল দেখা দিয়েছে। জেলার রূপসা উপজেলার আঠারোবাকি নদী সংলগ্ন নৈহাটী ইউনিয়নের শ্রীরামপুর বেড়িবাঁধে গত কয়েকদিন ধরে ভয়াবহ ফাটল দেখা দিয়েছে। এতে হুমকির মুখে পড়েছেন শ্রীরামপুর বিল এলাকার কয়েক হাজার কৃষি ও মৎসজীবী। যে কোনো সময় জোয়ারের চাপে বাঁধ ভেঙে যেতে পারে। বাঁধ ভেঙে গেলে শত শত একর জমির বোরো ক্ষেত ও গম ক্ষেত তলিয়ে যাবে। ডুবে যাবে সবজি ক্ষেত। মৎস্যঘের প্লাবিত হয়ে ভেসে যাবে কয়েক কোটি টাকার চিংড়ি ও অন্যান্য মাছ। তাছাড়া লবন পানি প্রবেশ করা মানেই আবাদী জমির দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি হওয়া।
বেড়িবাঁধ ভাঙার পেছনে দুর্বল বেড়িবাঁধের সাধে অবৈধ ইটভাটাগুলোকে দায়ি করছেন স্থানীয়রা। ভাটা মালিকরা তাদের ভাটার সীমানা বৃদ্ধির জন্য প্রতি বছর নদীর পাশে ইট ও ভাটার আবর্জনা ফেলে নদীর কিনারা ভরাট ও দখল করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ কারণে আঠারোবাকি নদীর শ্রীরামপুর এলাকার বাঁকে স্রোত বাঁধা পাওয়ায় হুমকির মুখে পড়েছে শ্রীরামপুর বিলটি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আঠারোবাকী নদীর পশ্চিম পাশে নন্দনপুর গ্রামে গড়ে উঠেছে সিটি ব্রিকস, টাটা ব্রিকস, এফবিএম ব্রিকস, আজাদ ব্রিকস, মুন ব্রিকস এবং রনি জোমাদ্দারের ইটভাটা। কিছুদিন আগে নদী খননের কাজ শেষ হলেও ভাটা এলাকায় কোনো এক অদৃশ্য কারণে নদী খনন করা হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। ইটভাটাগুলোর বিরুদ্ধে স্থানীয় প্রশাসনের নিরবতা সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্নের উদ্রেক করে।
নৈহাটি ইউনিয়নের শ্রীরামপুর বিলে গম চাষি নারায়ন দাস জানান, এবার প্রায় ৫ বিঘা জমিতে গমের আবাদ করছেন। গতবার ৩ বিঘায় ভাল ফলন পেয়ে এবার আবাদের পরিমান বাড়িয়েছেন। কিন্তু বেড়িবাঁধে ফাটল দেখা দেয়ায় এখন নতুন করে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। পারি প্রবেশ করলেই তিনি সর্বশান্ত হবেন। একাধিক কৃষক জানান, তারা বোরো আবাদ করে এখন দুশ্চিন্তার মাঝে রয়েছেন বাঁধ নিয়ে। আকস্মিক বেড়িবাঁধ ভেঙে পানিতে ফসল নিমজ্জিত হলে সারা বছরই তাদের না খেয়ে থাকতে হবে।
শ্রীরামপুর বিল পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতির সভাপতি আব্দুর রউফ কোরাইশী জানান, শ্রীরামপুর বিলে তিন ফসল উৎপাদন হয়। এখনো বিলে উচ্ছে, বাঙ্গী, মিষ্টি আলু, গম, ভুট্টা, ঝিঙা, টমেটো, মিষ্টি কুমড়া, শিম, লাউসহ বিভিন্ন প্রকার সবজির চাষ অব্যাহত আছে। এমন অবস্থায় নদীর লবন পানি প্রবেশ করলে সব ফসলের ক্ষতি হবে। তিনি অভিযোগ করেন, বাঁধ সংস্কারের আবেদন জানিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোনো সাড়া পাননি।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. সাইদুর রহমান বলেন, আঠারোবাকীর ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ এলাকা পরিদর্শন করা হয়েছে। দ্রুত এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এদিকে, শুধু রূপসা উপজেলার নৈহাটি ইউনিয়নে আঠারোবাকীর ভাঙন নয়, কয়রা, পাইকগাছা, বটিয়াঘাটা, দাকোপ উপজেলার প্রায় ৮০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের কমপক্ষে সাড়ে ৪শ’ টি পয়েন্ট চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। মাস চারেক পর বর্ষাকাল শুরু হবে।
খুলনা-৪ আসনের (রূপসা-দিঘলিয়া-তেরোখাদা) সংসদ সদস্য আব্দুস সালাম মুর্শেদী বলেন, ভাঙন এলাকা সম্পর্কে তিনি অবহিত আছেন। অতিসত্বর সরকারি এবং ব্যক্তিগত অর্থায়নে ভাঙন রোধে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
খুলনা-৬ আসনের (পাইকগাছা-কয়রা) এর সংসদ সদস্য আকতারুজ্জামান বাবু বলেন, সরকারি বরাদ্দে বিভিন্ন স্থানে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ মেরামতের কাজ চলছে। আশা করা হচ্ছে, এবার বর্ষা মৌসুমে অন্য বছর গুলোর মত বাঁধ ব্যাপক আকারে ভাঙবে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন