শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

উপ সম্পাদকীয়

এবারের মার্কিন নির্বাচন এবং বিশ্বব্যবস্থায় সম্ভাব্য সংকট

প্রকাশের সময় : ৯ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১২:০৩ এএম, ৯ নভেম্বর, ২০১৬

জামালউদ্দিন বারী

পশ্চিমা পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থা প্রভাবিত বিশ্বরাজনীতি এক জটিল আবর্তে প্রবেশ করেছে। প্রায় দুই দশক ধরে চলমান ইউনিপোলার মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদ পুরো বিশ্বকে এক চরম যুগ সন্ধিক্ষণে ঠেলে দিয়ে এখন নিজেও অস্তিত্বের পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছে। এ জন্য এবারের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নানা কারণে বিশ্ব রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। একদিকে ডোনাল্ট ট্রাম্পের বর্ণবাদী ও মুসলিমবিদ্বেষী হুঙ্কার, অন্যদিকে হিলারি ক্লিনটনের বিরুদ্ধে যুদ্ধবাদী নীতি অনুসরণের অভিযোগ এই নির্বাচনকে বাড়তি উত্তেজনাকর মাত্রা দিয়েছে। সা¤্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদী স্বার্থে এমনকি মার্কিনবিরোধী পরাশক্তি রাশিয়া ও চীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে ঘিরে বাহ্যিকভাবে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। প্রচার-প্রচারণার শুরু থেকে বিভিন্ন জনমত জরিপে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ট্রাম্পের চেয়ে নিরাপদ দূরত্বে এগিয়ে থাকলেও ভোটের শেষ সপ্তাহে চিত্র অনেকটাই পাল্টে যাওয়ার খবর বেরোতে থাকে। বিশেষত হিলারির কথিত ই-মেইল কেলেঙ্কারি নিয়ে এফবিআইর ভূমিকা পর্দার অন্তরালের কুশীলবদের নির্বাচনী দাবাখেলায় ২০০০ সালে প্রেসিডেন্ট বুশের মিরাকুলাস বিজয়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সে নির্বাচনে ডেমোক্রেটদলীয় প্রার্থী আল গোর ইলেক্টোরাল ভোটে বুশের চেয়ে ৯ ভোটে এগিয়ে থাকার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দুই প্রার্থীর মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের রাতে জেব বুশের মিডিয়া ক্যুর কথাও মার্কিন মুল্লুকে প্রচারিত হয়েছে। এরপর মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ইতিহাসে বিরল ঘটনা হচ্ছে, নির্বাচনের পর এক মাস পর্যন্ত নির্বাচনের ফলাফল ঝুলে থাকা। ফ্লোরিডায় ভোটিং মেশিনের গলদ এবং পুনঃগণনায় বুশের বিজয়ের ঘোষণা মার্কিন নির্বাচনের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল।
নির্বাচনী মেশিনারিজমের ক্যারিশমায় জর্জ বুশের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্ক ও পেন্টাগনে সন্ত্রাসী বোমা হামলার প্রতিক্রিয়া হিসেবে প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে যে সন্ত্রাসবিরোধী বিশ্বসন্ত্রাসের চক্রে নিক্ষেপ করেছিলেন তা থেকে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী বারাক ওবামাও দেশকে বের করে আনতে পারেননি। বলা চলে, তিনি তার পূর্ববর্তী রিপাবলিকান জর্জ বুশের সূচিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আরো বিস্তৃতি ঘটিয়েছেন। বারাক ওবামার সময় মধ্যপ্রাচ্যের আরো অন্তত ৬টি দেশে পশ্চিমা সমর্থিত যুদ্ধের বিভীষিকা ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বারাক ওবামা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের প্রথম আফ্রো-আমেরিকান প্রেসিডেন্ট। হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে শুধু সাদা প্রেসিডেন্টই বসবেন, ওবামাকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করার মধ্য দিয়ে শ্বেতাঙ্গ মার্কিনিদের এমন (ট্যাবু) ধারণা ভেঙে দেয়া হয়েছে। তবে মার্কিন গণতন্ত্রের ইতিহাসে এখনো কোনো নারী সে দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আসেননি। এবারের নির্বাচনে হিলারি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে মার্কিন গণতন্ত্রের আরেকটি ট্যাবু ভেঙে দিয়ে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হবে। ডোনাল্ট ট্রাম্প নিঃসন্দেহে একজন প্রভাবশালী রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বী। চরম মুসলিম বিদ্বেষ এবং শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী ভূমিকার কারণে একদিকে ইহুদিদের গোপন সমর্থন, অন্যদিকে রাশিয়ার প্রকাশ্য সমর্থন ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য অবশ্যই একটি বড় ভূ-রাজনৈতিক ভিত্তি দাঁড় করিয়েছে। অন্যদিকে ট্রাম্পের চীনবিরোধী ভূমিকার কারণে হিলারির প্রতি চীনাদের পরোক্ষ সমর্থন ভূ-রাজনৈতিক শক্তিতে একটি ভারসাম্য তৈরি করেছে। এমতাবস্থায় সার্বিকভাবে চূড়ান্ত বিচারে হিলারি ক্লিনটন কিছুটা এগিয়ে থাকলেও নির্বাচনে কারো পক্ষেই বিজয়ের নিশ্চয়তা দেয়া অসম্ভব। এবারো মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে নানা ধরনের শঙ্কার কথা শোনা যাচ্ছে। ভোটিং মেশিনের কারসাজিতে ফলাফল উলট-পালট হয়ে যাবে কিনা, এমন আশঙ্কা করছেন মার্কিন ভোটাররা। সেই সাথে ভোটের দিন সাইবার হামলা এবং ভোটিং মেশিন হ্যাক্ড হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্প নির্বাচন বাতিল করে তাকে বিজয়ী ঘোষণার অদ্ভুত দাবি করেছিলেন। তার এই দাবি যেমন মার্কিন গণতান্ত্রিক ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা, একইভাবে নির্বাচনী প্রচারণার শুরুতেই তিনি মুসলমান, হিস্পানিক ও অভিবাসনবিরোধী অবস্থান ঘোষণা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক স্পিরিটের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। আর নির্বাচনের আগে প্রার্থীরা যত কথাই বলুন, যত প্রতিশ্রুতিই দিন, যে দলের প্রার্থীই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হোন, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে তেমন কোনো বড় ধরনের পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
এরপরও এবারের নির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্টকে একটি যুগসন্ধিক্ষণের অনুঘটকের ভূমিকা পালন করতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর মাত্র ৭ দশকের মধ্যেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পতনের ঘণ্টা বাজতে শুরু করেছে। একটি পরাশক্তির রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পতনের মধ্য দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী আরেকটি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরাশক্তির আধিপত্য নিরঙ্কুশ হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার এবং নিউ আমেরিকান সেঞ্চুরি শুরু হয়েছিল, তার ষোলকলা পূর্ণ হয়েছিল বিংশ শতকের নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের মধ্য দিয়ে। আমরা স্মরণ করতে পারি, প্রথম মহাযুদ্ধের সময় ১৯১৭ সালে বলশেভিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যে মার্ক্সবাদী সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক শক্তির একটি নতুন বিশ্বশক্তি হিসেবে অভ্যুদয় ঘটেছিল তাও বিংশ শতকের গ-ি অতিক্রম করতে পারেনি। ১৯৮৯ সালে আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ৭৫ বছরের মাথায় সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতন ঘটে। তার আগে সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভ ‘গ্লাস্তনস্ত (খোলা দরজা)’ ও ‘পেরেস্ত্রয়কা (পুর্নগঠন)’ নীতি ঘোষণা করে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের বদ্ধ দুয়ার পুঁজিবাদী বিশ্বের জন্য খুলে দেয়ার ব্যবস্থা করেন। মার্ক্সবাদের রাষ্ট্রদর্শন যোসেফ স্টালিনের হাতে যে একনায়কতান্ত্রিক রূপ লাভ করেছিল তার সমালোচনায় ব্রিটিশ লেখক জর্জ অরওয়েল রূপকাশ্রয়ী ফিকশন ‘এনিমেল ফার্ম’ লিখেছিলেন। গর্বাচেভের খোলা দরজা দিয়ে সত্যের আলো প্রবেশ করার পর সে ফার্মটি যেন তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছিল। তবে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের মধ্য দিয়ে দ্বি-মেরুকেন্দ্রিক বিশ্বের ভারসাম্য বিনষ্ট হওয়ায় বাকি দুনিয়া যেন পুঁজিবাদের রক্তচোষা গিনিপিগে পরিণত হয়েছে। তবে অর্থনীতি ও প্রযুক্তিগত গ্লোবালাইজেশনের হাওয়ায় পুঁজির নতুন সঞ্চয় বিশ্বব্যবস্থায় একটি নতুন ভারসাম্য তৈরি করতে শুরু করেছে। শুধুমাত্র যুদ্ধবাদী পররাষ্ট্রনীতির মাধ্যমে রিজিম চেঞ্জ করে, ন্যাটো বাহিনী দিয়ে পশ্চিমাদের পছন্দনীয় গণতন্ত্র অথবা বশংবদ স্বৈরতন্ত্র চাপিয়ে দিয়ে তারা মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদ টিকিয়ে রাখার শেষ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অস্ত্র ও যুদ্ধবাদী নীতি-কৌশলে মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের ইজ্জত ও স্বার্থ রক্ষার শেষ চেষ্টাও ইতোমধ্যে ব্যর্থ হতে শুরু করেছে। দুই দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনগ্রসর বিশ্বে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তনের যে সুযোগ পেয়েছিল, তা তারা ‘অ্যাবিউজ’ করেছে। বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের জনগণ ও মানচিত্র নিয়ে তারা একটি বিপজ্জনক খেলায় মেতে উঠেছে। ইরাকে রিজিম চেঞ্জ করার পর সেখানে গণতন্ত্র, স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। লিবিয়া, মিসর ও সিরিয়ার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আর সিরিয়ায় মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের দাঁত ভেঙে গেছে। এখানে রাশিয়ার রণকৌশলের কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চরমভাবে পরাভূত হয়েছে। মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদ এভাবেই একটি একটি করে পরাজয় ও ব্যর্থতার গহ্বরে নিমজ্জিত হতে শুরু করেছে।
মার্কিন রাজনৈতিক ভাষ্যকার ও নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের প্রফেসর মার্ক ক্রিসপিন মিলারের একটি ভিডিও গত রোববার আইসিএইচ অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছে। সাড়ে ৮ মিনিটের এই ভিডিওতে তিনি স্পষ্টত দেখিয়েছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভোটিং ব্যবস্থা ম্যানিপুলেট করে কীভাবে ভোটের ফলাফল পাল্টে দেয়া যায়। অনলাইন মিডিয়ায় প্রকাশিত আরেকটি সাক্ষাৎকারে প্রফেসর ক্রিসপিন মিলার বলেছেন, দেশে দেশে মার্কিনি তথা পশ্চিমাদের অন্যায় হস্তক্ষেপ ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রাশিয়া ও চীনের মতো বড় শক্তির সাথে বিভিন্ন দেশ যেভাবে একাত্ম হতে শুরু করেছে তাতে আগামী দিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একাধিপত্য টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যের জটিল পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি রাশিয়াও যখন নিয়ামক শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষত সিরিয়ায় মার্কিন সমর্থিত বিদ্রোহী বা সামরিক জোট যখন কোনো ফলাফল দিতে পারছিল না, তখন রাশিয়ার সামরিক হস্তক্ষেপ সেখানে একটি ডিসাইসিভ ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা এমন সময় ঘটছে, যখন ইউক্রেনের রাজনৈতিক সংকটকে ঘিরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার ঘাড়ের ওপর উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়ছিল। ইউক্রেন সমস্যার শুরুতে, ২০১৪ সালেই কেউ কেউ ইউক্রেনকে ঘিরে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল। ইউক্রেনে রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা এখনো দৃশ্যত ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্ন’ অবস্থায় রয়েছে। ইউক্রেন নিয়ে মার্কিনিদের অতি রাজনীতি ও বেশি মাতামাতির জবাবে রাশিয়া ইতোমধ্যেই ইউক্রেনের অটোনমাস প্রদেশ ক্রিমিয়াকে রাশিয়ান ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে গাঁটছড়া বাঁধার একটি প্রস্তাব স্থগিত করে দেয়ায় গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইউনোকোভিচের বিরুদ্ধে বিরোধী রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে একটি গণআন্দোলনে ইন্ধন দিয়ে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে ২০১৪ সালে ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বশংবদ পেরোশেঙ্কোকে ক্ষমতার বসানোর মধ্য দিয়ে ইউক্রেন সমস্যা আরো জটিল ও বিস্ফোরণমুখী হয়ে ওঠে। একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের জন্য ভারী অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করতে শুরু করে, অন্যদিকে ইউক্রেন সীমান্ত ঘেঁষা ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোতে মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম বসিয়ে রাশিয়ার সাথে চরম উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি করে। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে রাশিয়াও ক্রিমিয়াসহ সর্বত্র কৌশলগত সমরশক্তি নিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে, এমনকি পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্র প্রস্তুত রাখারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাশিয়া। ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান অবস্থানকে কোল্ড ওয়ার সূচনাকালের কিউবান মিসাইল ক্রাইসিসের সাথে তুলনা করছেন আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।
চলমান বিশ্ববাস্তবতা বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে সংঘটিত দুটি মহাযুদ্ধের ফসল। প্রথম মহাযুদ্ধে সাতশ বছরের উসমানীয় খেলাফত বা অটোমান সাম্রাজ্যের পতন নিশ্চিত করার পাশাপাশি ইউরোপীয় পরাশক্তিগুলোর মধ্যে নতুন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মেরুকরণের সূচনা হয়। মহাযুদ্ধ চলার সময়েই বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জেমস বালফোর তার ব্যক্তিগত বন্ধু ও বৃটিশ ইহুদিদের নেতা ওয়াল্টার রথশিল্ডের কাছে লেখা একটি ছোট চিঠিতে ফিলিস্তিনি ভূ-খ-ে ভবিষ্যতে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বৃটিশ পরিকল্পনার কথা প্রকাশ করেন। এরপর সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মধ্যপ্রাচ্যের সম্ভাব্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষগুলোকে খ--বিখ-, দুর্বল ও অস্থিতিশীল করার পাশাপাশি উসমানীয় খিলাফতের ভগ্নস্তূপের ওপর ভবিষ্যতের বশংবদ আরব ডায়নেস্টির রূপরেখা এবং প্লটও তখনি তৈরি হয়। তবে সেই রূপরেখার চূড়ান্ত ভাগ্য নির্ধারিত হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলাফলের মধ্য দিয়ে। বিশ্বযুদ্ধের আগে ফিলিস্তিনে ইহুদি জনবসতি ছিল শতকরা ১০ শতাংশেরও কম। শতকরা ৯০ ভাগ আরব মুসলমানকে বিতাড়িত করে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা খুব জটিল ও দুরূহ ব্যাপার ছিল। এ কারণেই বালফোরের ডিক্লারেশনের পরও তা বাস্তবায়ন করতে ইঙ্গ-মার্কিনিদের আরো ৩০ বছর সময় নিতে হয়েছে। ফিলিস্তিনের দরিদ্র আরবদের জমি কিনে নিয়ে ইহুদি জনবসতির পরিসর বৃদ্ধির পরিকল্পনা তেমন কাজে না আসায় সামরিক শক্তি দিয়ে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করে, বিতাড়িত করে, বাড়িঘর বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়ে ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম দেয়া হয়। যুগে যুগে পুরনো সা¤্রাজ্যের পতন ও ধ্বংসস্তূপের ওপর নতুন সা¤্রাজ্যের জন্মের অনেক ইতিহাস আছে। কিন্তু ফিলিস্তিনের যেসব শহর গ্রামগুলো দখল করে ইসরাইল রাষ্ট্র গড়ে তোলা হয়েছিল সেটা আরব বা মুসলমানদের সা¤্রাজ্যের কোনো ভগ্নাবশেষ ছিল না। সেখানে হাজার বছর ধরে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা স্বল্পসংখ্যক ইহুদি প্রতিবেশীর সাথে মিলেমিশে চলছিল। গত দুই হাজার বছরের ইতিহাসে ইহুদিরা বার বার বিতাড়িত-নিগৃহীত হয়েছে। আন্দালুসিয়া বা মুসলিম স্পেনের সময়কালটি সম্ভবত একমাত্র ব্যতিক্রম। সে সময়টিকে ইহুদি সমাজের জন্য একটি স্বর্ণযুগ বলে অভিহিত করেছেন কোনো কোনো পশ্চিমা ঐতিহাসিক। এমনকি ক্রুসেডের সময়ও খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে ইহুদিদের কদাচিত মুসলমানদের পক্ষাবলম্বনের ইতিহাস আছে। রোমানদের হাতে চরমভাবে উৎপীড়িত হয়ে ফিলিস্তিন বা সিরিয়া ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল ইহুদিরা। এরপর সারা ইউরোপে ইহুদিদের ছড়িয়া পড়া এবং ব্যাংকিং, সুদি-মহাজনি ব্যবসায়সহ নানা ধরনের ব্যবসায়-বাণিজ্য ও উদ্ভাবনী সৃজনশীলতা দিয়ে তারা প্রতিটি জনপদে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করার সাথে সাথে বৃহত্তর সমাজের জন্য নানা ধরনের সমস্যাও তৈরি করেছে। ঊনবিংশ শতকের শেষদিকে জায়নিজম বা রাজনৈতিক ইহুদিবাদ রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব এবং জার্মানির নব্য জাতীয়তাবাদের জন্য বড় হুমকি হিসেবে চিহ্নিত হয়। এ কারণেই হিটলারের নাৎসি বাহিনীর অন্যতম টার্গেট ছিল ইহুদি জনগোষ্ঠী।
অবৈধভাবে দখলদারিত্বের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত ইসরায়েল রাষ্ট্রের অস্তিত্বের স্বীকৃতি মেনে না নিলেও বায়তুল মোকাদ্দাস বা মসজিদুল আকসাসহ পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের দাবি নিয়ে ফিলিস্তিনের আন্দোলন শুরু হয়েছে ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর থেকেই। ইসরাইল বরাবরই মসজিদুল আকসাসহ টেম্পল মাউন্ট সাইটকে ইহুদিদের পবিত্র স্থান হিসেবে দাবি করে আসছিল। প্রায় সত্তর বছর পর সম্প্রতি জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও বিশ্বঐতিহ্য বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর একটি রেজুলেশনে আল আকসা কমপ্লেক্সের ওপর ইহুদিদের দাবি নাকচ করে মুসলমানদের দাবির স্বীকৃতি দিয়েছে। শত বছরের ইহুদি প্রচারণা ও প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে স্বাধীনতাকমী ফিলিস্তিনি এবং মুসলমানদের জন্য এটি একটি বড় নৈতিক বিজয়। কয়েক বছর আগে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বলেছিলেন, ১০ বছরের মধ্যে ইসরাইলের পতন ঘটবে। হেনরি কিসিঞ্জারের এই বক্তব্যের সূত্র ধরে ইসরাইলের হারেজ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি নিবন্ধের শিরোনাম হয়েছিল ‘হ্যাজ আওয়ার এক্সপাইরেশন ডেট এরাইভ্ড?’ ইসরাইলের টিকে থাকার পেছনে তাদের শক্তিশালী সামরিক বাহিনী, স্মার্ট বোম্ব, শক্তিশালী ও স্থিতিশীল অর্থনীতি এবং ঈশ্বরের ইচ্ছা বা সমর্থনের কথা বলা হয়েছিল নিবন্ধে। সেই সাথে বিশাল শক্তিধর সেনাবাহিনী, পারমাণবিক বোমা থাকার পরও মাত্র ৭০ বছরের মাথায় সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের কথাও তুলে ধরা হয়েছিল হারেজ পত্রিকার নিবন্ধে। তবে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা ইমাম খামেনি ২০১৫ সালে দেয়া এক বক্তৃতায় আগামী ২৫ বছরের মধ্যে ইসরাইলের পতনের কথা বলেছেন। অরাজনৈতিক ও অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় শুধুমাত্র সামরিক শক্তির ওপর ভর করে ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল। এরপর অব্যাহতভাবে পশ্চিমা সামরিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা নিয়ে বার বার ইসরাইল ফিলিস্তিন ও আরব প্রতিবেশীদের ওপর আগ্রাসন ও দখলদারিত্ব চালিয়েছে। শুধুমাত্র সামরিক শক্তিকেই তারা ইসরাইলের টিকে থাকার অবলম্বন হিসেবে বিবেচনা করেছে। ইসরাইল এবং নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার বা নিই আমেরিকান সেঞ্চুরির বয়েস প্রায় সমান। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের মতো এখন মার্কিন পুঁজিবাদী সা¤্রাজ্যবাদের পতন ঘটলে এবং সেই সুবাদে জুলুমবাজির মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত ইসরাইল নামক ইহুদি রাষ্ট্রটি বিলুপ্ত হলে বিস্ময়ের কিছু নেই। তবে সেই আশঙ্কা নস্যাৎ করে দিতে জায়নবাদী ইহুদিরা এবং মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের কুশীলবরা তাদের সর্বশক্তি নিয়ে বিশ্বকে আরেকটি মহাযুদ্ধের দিকে নিয়ে যেতে চাইছে। এ কারণেই এবারের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বিশ্বের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্ট। এখানে উগ্র বর্ণবাদী ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং কর্পোরেট সা¤্রাজ্যবাদী হিলারি ক্লিনটন যিনিই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হোন তাকে আমরা হয়তো হিটলারের ভূমিকায় অথবা মিখাইল গর্বাচেভের ভূমিকায় দেখতে পাব। এর মানে হয়তোÑ সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের তিন দশকের মাথায় মার্কিন পুঁজিবাদী সা¤্রাজ্যবাদেরও পতন ঘটবে।
bari_zamal@yahoo.com

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন