আজ হতে ১০০ এক বছর আগে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেদিন মাতৃক্রোড়ে যে শিশু প্রথম চোখ মেলেছিল, পরবর্তীকালে সে শিশুর পরিচিতি দেশের গন্ডিরেখা অতিক্রম করে পরিব্যপ্ত হয়েছে বিশ্বব্যাপী। মা-বাবার আদরের খোকা, রাজনৈতিক সহযোদ্ধাদের সুপ্রিয় মুজিব ভাই, সমসাময়িকদের প্রিয় শেখ সাহেব থেকে মুক্তিকামী বাঙালির ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে অর্জন করেন ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি এবং শেষতঃ কায়েমি স্বার্থবাদীদের প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে হয়ে ওঠেন জাতির অবিসংবাদিত নেতা, জাতির পিতা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে তার নাম একাকার হয়েছে। এ তো শুধু একটি নাম নয়, ইতিহাস। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক। ১৭ মার্চ আমাদের জাতীয় জীবনে এক ঐতিহাসিক দিবস। দিনটি রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘জাতীয় শিশু দিবস’ হিসেবে প্রতি বছর পালিত হয়ে থাকে। জাতির জনকের শুভ জন্মদিনে সমগ্র জাতি কৃতজ্ঞচিত্তে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করছে।
বঙ্গবন্ধু জীবনব্যাপী একটিই সাধনা করেছেন, বাঙালির মুক্তির জন্য নিজকে উৎসর্গ করা। ধাপে ধাপে প্রতিটি সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ’৪৮ থেকে ’৫২ অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য আন্দোলন, ’৫০ থেকে ’৫৪ জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ, ’৫৪ থেকে ’৫৬ সাংবিধানিক স্বায়ত্তশাসন, ’৬৪-তে সা¤প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অসা¤প্রদায়িকতা, ’৬৬-তে জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার অর্থাৎ স্বাধিকার তথা ছয় দফা, ’৬৯ থেকে ’৭০-এ সার্বজনীন ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা ও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ভূমিধস বিজয় অর্জন এবং পরিশেষে ’৭১-এ স্বাধীনতার ডাক দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ঐতিহাসিক এই পর্বগুলো সংঘটনে তাকে জীবনের প্রায় ১৩টি বছর কারান্তরালে কাটাতে হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার মুক্তিকামী মানুষের নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার একটি উক্তি এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, ‘ওঃ রং ংধরফ ঃযধঃ হড় ড়হব ঃৎঁষু শহড়ংি ধ হধঃরড়হ ঁহঃরষ ড়হব যধং নববহ রহংরফব রঃং লধরষং.’ ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থটি পড়ে জেনেছি কারারুদ্ধ অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর সম্বল ছিল একটি থালা, বাটি, গøাস আর কম্বল। প্রকৃতপক্ষে ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থটির শিরোনাম তিনি দিয়েছিলেন ‘জেলখানার সম্বল থালা বাটি কম্বল।’ এখানে গিয়েই বারবার আমাদের কেন্দ্রীয় কারাগার এবং পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালি কারাগারের কথা ভেবেছি যে কারাগারে বঙ্গবন্ধু দীর্ঘকাল বন্দিজীবন অতিবাহিত করেছেন। বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী হিসেবে লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামিক সম্মেলনে গিয়ে মিয়ানওয়ালি কারাগারের প্রিজন গভর্নর (জেল সুপার) হাবীব আলীর কাছ থেকে বর্ণনা শুনেছি, জেলের সামনে কবর খুঁড়ে বঙ্গবন্ধুকে প্রধানমন্ত্রী অথবা কবর বেছে নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু কবরকেই বেছে নিয়ে বলেছিলেন, ‘যে বাংলার আলো-বাতাসে আমি বর্ধিত হয়েছি, মৃত্যুর পর এই কবরে না, আমার লাশ প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিও।’ জাতির পিতা সাড়ে ৯ মাস পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালি কারাগারের নির্জন সেলে বন্দি ছিলেন। মিয়ানওয়ালি কারাগার ভিন দেশে হওয়ায় আমরা তা সংরক্ষণ করতে পারিনি। তবে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের যে কক্ষে তিনি বন্দি ছিলেন সে-সব সংরক্ষণ করা হয়েছে। আগরতলা মামলায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের যেখানে তিনি বন্দি ছিলেন সেটিও জাদুঘর করা হয়েছে। মানুষের মুক্তির লড়াইয়ে আত্মোৎসর্গকারী নেতৃত্বের রয়েছে ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত আদর্শিক মিল। যেমন ’৭১-এর ৪ মার্চ বাঙালির সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে জাতির জনক বলেছিলেন, ‘চরম ত্যাগ স্বীকার করা ছাড়া কোনো দিন কোনো জাতির মুক্তি আসে নাই।’ বঙ্গবন্ধু সবসময় বলতেন, ‘মানুষকে ভালোবাসলে মানুষও ভালোবাসে। যদি সামান্য ত্যাগ স্বীকার করেন, তবে জনসাধারণ আপনার জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত।’ ‘আমার সবচেয়ে বড় শক্তি দেশের মানুষকে ভালোবাসি, সবচেয়ে বড় দুর্বলতা তাদেরকে খুব বেশি ভালোবাসি।’
বঙ্গবন্ধু সবসময় ছোটকে বড় করে তুলতেন। যেসব জায়গায় সফর করতেন, বক্তৃতায় সেখানকার নেতা-কর্মীদের বড় করে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতেন। ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতাকে থানার, থানা আওয়ামী লীগের নেতাকে জেলার এবং জেলা আওয়ামী লীগের নেতাকে জাতীয় নেতায় রূপান্তরিত করে তিনি জাতির পিতা হয়েছেন। ফলত, সারা বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে বহু চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে আজো বঙ্গবন্ধুর চেতনা ধারণ করেই টিকে আছে।
মনে পড়ছে ’৭১-এর রক্তঝরা মার্চের ১৭ তারিখের কথা। সেদিন বঙ্গবন্ধুর ৫২তম জন্মদিন ছিল। দেশ জুড়ে অসহযোগ আন্দোলন চলছে। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা শেষে তখনকার প্রেসিডেন্ট ভবন অর্থাৎ পুরাতন গণভবন সুগন্ধা থেকে দুপুরে যখন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসভবনে ফিরে এলেন তখন বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে ঘরোয়া আলোচনাকালে একজন সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেন, ‘৫২তম জন্মদিনে আপনার সবচাইতে বড় ও পবিত্র কামনা কী?’ উত্তরে স্বভাবসুলভ কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘জনগণের সার্বিক মুক্তি।’ এরপর সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জ্ঞাপনকালে বেদনার্ত স্বরে বলেছিলেন, ‘আমি জন্মদিন পালন করি না, আমার জন্মদিনে মোমের বাতি জ্বালি না, কেকও কাটি না। এ দেশে মানুষের নিরাপত্তা নাই। আপনারা আমাদের জনগণের অবস্থা জানেন। অন্যের খেয়ালে যে কোনো মুহূর্তে তাদের মৃত্যু হতে পারে। আমি জনগণেরই একজন, আমার জন্মদিনই কী, আর মৃত্যু দিনই কী? আমার জনগণের জন্য আমার জীবন ও মৃত্যু। আমি তো আমার জীবন জনগণের জন্য উৎসর্গ করেছি।’
’৭২-এর ১০ জানুয়ারি বন্দিদশা থেকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে রেসকোর্স ময়দানের সর্বকালের সর্ববৃহৎ জনসমুদ্রে হূদয়ের অর্ঘ্য ঢেলে আবেগমথিত ভাষায় বলেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে যাবার সময় বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।’ স্থির-প্রতিজ্ঞ থেকে বলেন, ‘ভাইয়েরা, তোমাদেরকে একদিন বলেছিলাম, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। আজকে আমি বলি, আজকে আমাদের উন্নয়নের জন্য আমাদের ঘরে ঘরে কাজ করে যেতে হবে।’ সেদিন বক্তৃতায় তিনি আরো বলেন, ‘আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই যে, বাংলাদেশ একটি আদর্শ অসা¤প্রদায়িক রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনো ধর্মীয় ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে—গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র।’
বিশেষভাবে একাত্তরের ২৫শে মার্চের থমথমে দিনটির কথা মনে পড়ে। সকালে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে বের হই, কাজ শেষে পুনরায় নেতার সঙ্গে দেখা করি। বিদায় নেওয়ার সময় বলি, বঙ্গবন্ধু, আমার তো মনে হয় তারা অবশ্যই আপনাকে গ্রেফতার করবে। দৃঢ়-প্রত্যয়ী বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘করুক না। তাতে কী? ওরা আমাকে আগেও গ্রেফতার করেছে এবং তাতে ওদের কোনো লাভ হয় নাই। ওরা ফের আমাকে গ্রেফতার করতে পারে। কিন্তু এ থেকে ওরা কী সুবিধা পাবে আমি জানি না। ওরা যদি আমাকে মেরেও ফেলে তাতেও ওদের কোনো লাভ হবে না। আমার মৃত্যুর বদলা নিতে বাংলার মাটিতে হাজারো শেখ মুজিবের জন্ম হবে। ওদের দিন শেষ, এটা ওরাও জানে। দীর্ঘদিনের সংগ্রামের পর আজ এই সত্যই আমার হূদয়টাকে অনাবিল আনন্দে ভরে দিচ্ছে। ওরা যদি আমাকে মেরে ফেলে এবং তুমি আমার লাশ দেখার সুযোগ পাও তখন দেখবে, আমি কেমন সুখে হাসছি।’ গণহত্যা শুরুর প্রাক্কালে সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে বিষাদাচ্ছন্ন স্বরে বলেছিলেন, ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে এই বাংলায়...।’
দুটি মহান লক্ষ্য সামনে নিয়ে জাতির জনক রাজনীতি করেছেন। একটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা, অপরটি অর্থনৈতিক মুক্তি। প্রথম লক্ষ্য পূরণ করে যখন দ্বিতীয় লক্ষ্য পূরণের দ্বারপ্রান্তে ঠিক তখনই ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা বিরোধী দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা তাকে সপরিবারে হত্যা করে। জাতির জনকের দুই কন্যা তখন বিদেশে অবস্থান করায় রক্ষা পান। জাতির জনকের জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক আওয়ামী লীগের রক্তে ভেজা সংগ্রামী পতাকা হাতে নিয়ে নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় অভিষিক্ত করে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সুন্দরভাবে সামনের দিকে অগ্রসর হয়ে একের পর এক লক্ষ্যপূরণ করে চলেছে। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ হবে জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাংলা।
লেখক: আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য, সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন