মঙ্গলবার ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ২০ কার্তিক ১৪৩১, ০২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মবার্ষিকী সংখ্যা

মানব উন্নয়নই ছিল বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শন

ড. মইনুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ১৭ মার্চ, ২০২২, ১২:০২ এএম

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের মাধ্যমে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে যাত্রা শুরুর লগ্নে বাংলাদেশ ছিল একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত জনপদ। সাড়ে সাত কোটি জনগণের এক কোটি তখন ফিরে আসছিল ভারতের শরণার্থী শিবিরগুলো থেকে। তাদের ঘরবাড়ী ছিল বিধ্বস্ত, লুন্ঠিত কিংবা পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদর বাহিনীর অগ্নি-সন্ত্রাসে পুড়ে ছারখার হওয়া ধ্বংসস্তুপ। দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে প্রাণ বাঁচানো আরো দুই-আড়াই কোটি মানুষও তাদের ঘরবাড়ী পুনর্নির্মাণে এবং সংসার গুছিয়ে তোলার সংগ্রামে ছিল জেরবার। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ত্রিশ লাখ মানুষের পরিবারের যাঁরা বেঁচেছিলেন তাঁরাও ছিলেন অর্থনৈতিকভাবে সর্বস্বান্ত এবং শোকে পাগলপ্রায়। দেশের খাদ্য পরিস্থিতি ছিল ভয়াবহ, ১৯৭০ সালেই তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে খাদ্যঘাটতি প্রায় চল্লিশ লাখ টনে পৌঁছে গিয়েছিল। রাস্তাঘাট, সড়ক-মহাসড়ক, সেতু-কালভার্ট, বন্দর ও রেলপথগুলো ছিল ধ্বংসযজ্ঞের শিকার। এগুলোর মোকাবেলায় সরকারের কোষাগার ছিল শূন্য, বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার ছিল পাকিস্তানীদের সুপরিকল্পিত লুন্ঠনের ফলে একদম খালি। দেশের প্রাইভেট সেক্টরের কলকারখানাগুলোর সাতাত্তর শতাংশের মালিক ছিল হয় পাকিস্তানী নয়তো অবাঙালি। তারা পাকিস্তানে পালিয়ে যাওয়ায় ঐ প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের আগেই। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সালÑ এই ২৪ বছরের পুরো সময়টা পশ্চিম পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ হিসেবে শোষণ, লুন্ঠন ও অবিশ^াস্য রকম বঞ্চনার শিকার হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান। কিন্তু, তবুও বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ১ মার্চ পর্যন্ত তাঁর ছয় দফা এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফার ভিত্তিতে পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যেই প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন এবং জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির পথে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যস্থির করেছিলেন। পাকিস্তানের সামরিক জান্তা এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোর ‘লারকানা ষড়যন্ত্রে’ বঙ্গবন্ধুকে কিছুতেই পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা না দেওয়ার চরম সিদ্ধান্ত নেয়াতেই জাতিকে ১ মার্চ শৃঙ্খলমুক্তির লক্ষ্যে স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং ২৬ মার্চ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছিল। দু’শ ছেষট্টি (২৬৬) দিনের ঐ মুক্তিযুদ্ধে হানাদার ঘাতক পাকিস্তানী বাহিনী আক্ষরিকভাবেই ‘পোড়ামাটি’ নীতি অবলম্বন করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর তাদের আত্মসমর্পণ-লগ্নে বাংলাদেশকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করার মিশনটি প্রায় সম্পন্ন করে এনেছিল। (‘বেলুচিস্তান ও বাংলার কসাই’ সমরনায়ক টিক্কা খানের ঘোষণা ছিল,‘মুঝে ¯্রফি মিট্টি চাহিয়ে’)।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসার আগেই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন সরকার এই ভয়াবহ সংকট মোকাবেলার কঠিন সংগ্রামে পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নামিয়ে দিয়েছিল, কিন্তু দেশের দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ও পুনর্নির্মাণের পরিকল্পিত সংগ্রাম শুরু করার জন্য বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় থাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সরকারের নেতৃত্ব গ্রহণের পর সম্প্রসারিত মন্ত্রীসভা গঠন করে বিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনর্গঠনের দায়িত্বটি কাঁধে তুলে নেন, ঐ মন্ত্রীসভার অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রীর দায়িত্বটি অর্পণ করা হয় মুক্তিযুদ্ধের কান্ডারি তাজউদ্দিন আহমদের ওপর। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীসভায় যাঁরা স্থান পেয়েছিলেন তাঁদের সততা ও যোগ্যতা সম্পর্কে সারা জাতি অকুন্ঠ আস্থা জানিয়েছিল শুরু থেকেই। মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল ঘোষিত বাংলাদেশের প্রথম সরকার স্বাধীন-সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের তিনটি রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণ করেছিল গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। বঙ্গবন্ধু এগুলোর সাথে যোগ করলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদ। এই চারটি রাষ্ট্রনীতির ভিত্তিতে দেশের সংবিধান রচনার জন্য বঙ্গবন্ধু সংবিধান কমিশন গঠন করলেন। একটি সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে নেতৃত্ব প্রদানের জন্য প্রথমেই প্রয়োজন হয় যোগ্যতম অর্থনীতিবিদদের সমন্বয়ে গঠিত একটি শক্তিশালী পরিকল্পনা কমিশন। বঙ্গবন্ধু দেশের শ্রেষ্ঠ চারজন অর্থনীতিবিদদেরকে রাজি করালেন পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান এবং সদস্য হওয়ার জন্য। প্রফেসর নুরুল ইসলাম হলেন মন্ত্রীর পদমর্যাদায় ডেপুটি চেয়ারম্যান, আর প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় সদস্য হলেন প্রফেসর মোশাররফ হোসেন, প্রফেসর রেহমান সোবহান এবং প্রফেসর আনিসুর রহমান। কমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন প্রফেসর এ আর খান, প্রফেসর মুজাফফর আহমদ, ড. স্বদেশ রঞ্জন বোস এবং প্রফেসর শামসুল ইসলামের মত মেধাবী ব্যক্তিরা। অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী তাজউদ্দিন এবং পরিকল্পনা কমিশনের নেতৃত্বে শুরু হলো ১৯৭২-৭৩ অর্থ-বছরের জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সরকারি বাজেট এবং প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ। সরকারের দায়িত্বগ্রহণের অব্যবহিত পর ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির প্রথম স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ উদযাপনকে উপলক্ষ করে বঙ্গবন্ধু জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত বেতার ভাষণে বাংলাদেশে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিস্তারিত নীতিমালা ঘোষণা করলেন। ঐ নীতিমালার প্রধান দিকগুলো ছিল নি¤œরূপ:

১ ) পাট, বস্ত্র, ইস্পাত, চিনি, কেমিক্যাল, কাগজ ও নিউজপ্রিন্ট শিল্প-কারখানার জাতীয়করণ,
২) পশ্চিম পাকিস্তানী ও অবাঙালি সকল মিল-মালিকদের পরিত্যক্ত কল-কারখানা ও ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান সরকারি অধিগ্রহণ,
৩) সকল ব্যাংক ও বীমা কোম্পানি জাতীয়করণ,

৪) দেশের সকল প্রাইমারি স্কুল সরকারিকরণ এবং প্রাইমারী শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক ও সম্পূর্ণ অবৈতনিক ঘোষণা,
৫) দেশের সরকারি কর্মকর্তাদের মাসিক সর্বোচ্চ বেতন এক হাজার টাকা নির্ধারণ এবং সরকারি কর্মচারীদের নি¤œতম মাসিক বেতন এক’শ টাকায় উন্নীতকরণের লক্ষ্যে বেতন কমিশন গঠন, এবং
৬) দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগোপযোগী, একক মানসম্পন্ন ও আধুনিক করার লক্ষ্যে শিক্ষা কমিশন গঠন।

বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রথম বাজেট ১৯৭২-৭৩ অর্থ-বছরের বাজেটে শিক্ষাখাতে এ-দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ২১.১৬ শতাংশ সরকারি ব্যয়বরাদ্দ করা হয়েছিল। তখনকার যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতির বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষাখাতে এত বেশি ব্যয়বরাদ্দ যে সরকারের জন্য কতবড় চ্যালেঞ্জ ছিল তা এখন চিন্তাও করা যাবে না, অথচ শিক্ষা ও মানবউন্নয়নকে বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শনের কেন্দ্রীয় ফোকাসে ন্যস্ত করার এই সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে যে বিশে^র সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে জনগণকে দ্রæত শিক্ষিত করে গড়ে তোলাই যে উন্নয়নের মূল দর্শন হতে হবে সে বিষয়টি বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর সরকারের নীতি-নির্ধারকরা দৃঢ়ভাবে বিশ^াস করতেন। বঙ্গবন্ধু সরকারের শেষ বাজেট ১৯৭৫-৭৬ অর্থ-বছরের বাজেটেও শিক্ষাখাতের প্রতি বঙ্গবন্ধুর অগ্রাধিকার প্রদানের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। দুঃখজনক হলো, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যা করার পর ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ক্ষমতাসীন জিয়াউর রহমান ১৯৭৬-৭৭ অর্থ-বছরের বাজেটে শিক্ষাখাতের সরকারি ব্যয়বরাদ্দকে টেনে ১১ শতাংশের নিচে নামিয়ে এনেছিলেন। তখন থেকে পুরো জিয়া আমল এবং এরশাদ আমলে প্রতিরক্ষা খাতের সরকারি ব্যয়বরাদ্দ সরকারের প্রধান অগ্রাধিকারে পরিণত হয়েছিল। ১৯৮৩-৮৪ অর্থ-বছরে শিক্ষাখাতে সরকারি ব্যয়বরাদ্দ ছিল বাজেটের মাত্র ৯.৬ শতাংশ। ২০০১-৬ মেয়াদের বিএনপি-জামায়াত কোয়ালিশন সরকারের সময় কয়েক বছর শিক্ষাখাতের সরকারি ব্যয়কে জিডিপি’র ২ শতাংশেরও নিচে নামিয়ে ফেলেছিলেন তদানীন্তন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান। অনেকেই হয়তো জানেন না যে ঐ সময়ে শিক্ষাখাতের সরকারি ব্যয়-জিডিপি’র অনুপাত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে ছিল সর্বনি¤œ। আরো দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির উত্তরসূরি দাবিদার বর্তমান সরকার নিজেদেরকে শিক্ষাবান্ধব সরকার বলে গলাবাজি করলেও চলমান ২০২১-২২ অর্থ-বছরে শিক্ষাখাতে সরকারি ব্যয়বরাদ্দ জিডিপি’র ২.৩ শতাংশেই আটকে রয়েছে। গত ১৩ বছর ধরে এই অনুপাত জিডিপি’র ২.২ শতাংশ থেকে ২.৩ এর মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, তেমন বাড়ানো যায়নি। অথচ ইউনেসকো বলছে জিডিপি’র ছয় শতাংশ শিক্ষাখাতে ব্যয় করা উচিত, বাংলাদেশও ঐ অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষরকারী দেশ।

সংবিধান কমিশন রেকর্ড নয় মাসের মধ্যে খসড়া সংবিধান রচনা করে সরকারের কাছে পেশ করে। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর সংসদে সংবিধান বিল পাশ হয় এবং ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর সংবিধান কার্যকর হবে মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। শিক্ষা সম্পর্কে সংবিধানের অঙ্গীকার বিধৃত হয়েছে ১৭ নম্বর ধারায়, যা নি¤œরূপ:
‘রাষ্ট্র (ক) একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য, (খ) সমাজের প্রয়োজনের সহিত শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করিবার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করিবার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য, (গ) আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করিবার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’

উপরে উল্লিখিত অঙ্গীকার মোতাবেক দেশের প্রাথমিক পর্যায়ের মাদ্রাসা শিক্ষা ও ইংরেজী মিডিয়াম শিক্ষাকে ধাপে ধাপে মূল ধারার প্রাথমিক শিক্ষার ‘একক মানসম্পন্ন’ কারিক্যুলামে নিয়ে আসাই সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। এই সাংবিধানিক অঙ্গীকার বাস্তবায়নের জন্য বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭২ সালেই পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক ঘোষণা করার পাশাপাশি দেশের সকল প্রাথমিক স্কুলকে জাতীয়করণ করেছিল। ১৯৭৪ সালে কুদরতে খুদা শিক্ষা কমিশনের যে প্রতিবেদনটি সরকার গ্রহণ করেছিল তাতে ঐ বাধ্যতামূলক, অবৈতনিক ও একক মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বর্ধিত করার প্রস্তাব ছিল। জাতির দুর্ভাগ্য, কুদরতে খুদা কমিশনের রিপোর্ট সরকার গ্রহণ করেছে মর্মে সরকারি গেজেট প্রকাশিত হওয়ার আগেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছিলেন। ঐ রিপোর্টের সুপারিশগুলো ১৯৭৫-১৯৯৬ এর ২১ বছরে কোন সরকারেরই সুবিবেচনা পায়নি, যদিও জিয়াউর রহমান, এরশাদ ও বেগম খালেদা জিয়ার ১৯৯১-১৯৯৬ মেয়াদের সরকার নিজেদের পছন্দমাফিক একাধিক শিক্ষা কমিশন বা কমিটি গঠন করেছে এবং শিক্ষা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট চালিয়েছে। এমনকি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের সরকার কর্তৃক গঠিত ‘শামসুল হক কমিটির’ রিপোর্টেও এই বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছিল। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় ফিরে আসার পর শেখ হাসিনার মহাজোট সরকার কর্তৃক প্রফেসর কবির চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত কমিটির প্রতিবেদনে এই সাংবিধানিক অঙ্গীকারটিকে বাস্তবায়নের সুস্পষ্ট সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, এবং বর্তমানে তা বাস্তবায়নাধীন রয়েছে।

এদেশে ১১ ধরনের প্রাথমিক শিক্ষা চালু রয়েছে। তালিকাটা দেখুন: ১) সরকারি প্রাইমারী স্কুল, ২) এক্সপেরিমেন্টাল প্রাইমারী স্কুল, ৩) রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাইমারি স্কুল, ৪) নন-রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাইমারি স্কুল, ৫) প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট-সংযুক্ত প্রাইমারি স্কুল, ৬) কমিউনিটি স্কুল, ৭) সেটেলাইট স্কুল, ৮) হাই স্কুলের সাথে সংযুক্ত প্রাইমারি স্কুল, ৯) এনজিও পরিচালিত স্কুল, ১০) কিন্ডারগার্টেন ও ১১) এবতেদায়ী মাদরাসা। শিক্ষাজীবনের শুরুতেই শিশুকে এত ধরনের বৈষম্যমূলক শিক্ষা ব্যবস্থার জালে আটকে ফেলার এহেন নৈরাজ্যকর ব্যবস্থা বিশ্বের আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। পিতামাতার বিত্তের নিক্তিতে ওজন করে নির্ধারিত হয়ে যাচ্ছে কে কিন্ডারগার্টেনে যাবে, কে সরকারি বা বেসরকারি প্রাইমারি স্কুলে সুযোগ পাবে, কার এনজিও স্কুলে ঠাঁই হবে, আর কাকে এবতেদায়ী মাদ্রাসায় পাঠিয়ে বাবা-মা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে।

উচ্চশিক্ষার প্রতি বঙ্গবন্ধুর দরদ প্রতিফলিত হয়েছিল দেশের চারটি বিশ^বিদ্যালয়ের জন্য স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা চালু করার মাধ্যমে। ১৯৭৩ সালে প্রথম ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় অধ্যাদেশ জারি হয়েছিল এবং পরবর্তীতে রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের জন্য তিনটি বিশ^বিদ্যালয় আইন পাশ হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে। ১৯৭৫ সালের পর ক্রমান্বয়ে ভূলুন্ঠিত হয়ে চলেছে বিশ^বিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন, এখন তো সরাসরি বলা হচ্ছে ‘পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়’। এটা মোটেও কাকতালীয় নয় যে ঐ চারটি বিশ^বিদ্যালয়ের পর গত ৪৭ বছরে এদেশের আর কোন পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হয়নি। ১৯৯২ সালে বিএনপি সরকার দেশে প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আইন চালু করার পর গত ত্রিশ বছরে উচ্চশিক্ষা এখন মহার্ঘ পণ্যে পরিণত হয়েছে। ব্যবসায়ীদের মুনাফাবাজির লোভনীয় ক্ষেত্র এখন শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষার এহেন বাজারিকরণ কি অসাংবিধানিক নয়?

লেখক: সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন