মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপ সম্পাদকীয়

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন এবং মুক্তিকামী বিশ্বের করণীয়

প্রকাশের সময় : ১০ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ আবদুল গফুর

গত মঙ্গলবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত বহুল আলোচিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। প্রেসিডেন্ট নির্বাচন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হলেও এ নিয়ে আগ্রহ-উদ্দীপনা ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বিশ্বেই। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম ছিল না। বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ব্যাপারে এ আগ্রহের কথা মাথায় রেখেই সম্ভবত বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্থা স্টিফেনস ব্লুম বার্নিকাট আশা প্রকাশ করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন নিয়ে যে উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়েছিল বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনও সে রকম উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হবে।
সাধারণত কোনো বিদেশি কূটনীতিক ভিন দেশের কোনো রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে সংশ্লিষ্ট ভিন দেশ সম্পর্কে কিছু কিছু ভালো কথা বলার একটা অলিখিত রেওয়াজ আছে বলেই সম্ভবত মার্কিন রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশ সম্পর্কে গত সোমবার এমনটা আশাবাদ ব্যক্ত করতে পেরেছেন বাংলাদেশের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং বাংলাদেশের শাসক দল আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে। নইলে বাংলাদেশের নির্বাচনকালীন অবস্থা সম্পর্কে তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কিছুতেই রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট এমন আশাবাদ ব্যক্ত করতে পারতেন না। যে উৎসবমুখর ও নিরপেক্ষ পরিবেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনসহ বিভিন্ন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে তার যে ধারেকাছেও থাকে না বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের অধীন নির্বাচনকালীন পরিবেশ তা রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট জানেন না, এর চাইতে বড় অসত্য কথা আর কিছু হতে পারে না। তবে একজন বিদেশি রাষ্ট্রের কূটনীতিক হিসেবে তাঁর দায়িত্বের সীমাবদ্ধতার দিকেও লক্ষ্য রেখে বক্তব্য দিতে হয়।
বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত বর্তমান বিশ্বের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের নির্বাচনকালীন পরিস্থিতির সীমাবদ্ধতা নিয়ে যে কোনো বিরূপ মন্তব্য প্রকাশ করেন না এটা তার কোনো দয়ার ব্যাপার নয়। বাংলাদেশ সরকারের যেমন অভ্যন্তরীণ নীতির ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের নিরিখে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে তেমনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে প্রচুর প্রশ্নবিদ্ধ অবস্থান। আশ্চর্যের কথা, এ ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রধান রাজনৈতিক সংগঠন ডেমোক্রাট ও রিপাবলিকান পার্টির মধ্যে কোনো বড় ধরনের পার্থক্য নেই।
এ দিকটা লক্ষ্য রেখেই সম্ভবত বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্থা স্টিফেনস ব্লুম বার্নিকাট দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলতে পেরেছেন, সাম্প্রতিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল যাই হোক, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিদ্যমান মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির কোনো পরিবর্তন হবে না। অবশ্য বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির কোনো পরিবর্তন হবে না, এর অর্থ কিন্তু এ নয় যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কোনো বড় ধরনের পরিবর্তন হলেও তার ফলে মার্কিন পররাষ্ট্র নীতিতে কোনো পরিবর্তন আসবে না।
তবে এই ‘বড় ধরনের পরিবর্তন’ বলতে আমরা কী বুঝব তার ওপর নির্ভর করবে মার্কিন পররাষ্ট্র নীতিতে পরিবর্তনের বৈশিষ্ট্য। যদি বর্তমান মার্কিন শাসক দল ডেমোক্রেটদের শাসন অব্যাহত থাকে অর্থ্যাৎ ডেমোক্রেট দলের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিলারি ক্লিনটন বিজয়ী হন তবে মার্কিন সরকারের বর্তমান পররাষ্ট্র নীতিই বজায় থাকবে। কিন্তু যদি ডেমোক্রেটদের হারিয়ে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউসের দখল পেয়ে যান তা হলে তাঁর পররাষ্ট্র নীতি তিনি তো আগেভাগেই বলে দিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেস্ট ফ্রেন্ড (সর্বোত্তম বন্ধু) হবে ভারত। রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ট্রাম্পের এ আগাম ঘোষণার পর বহু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী হিন্দু ভোটার ট্রাম্পের বিজয় কামনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক মন্দিরে রীতিমতো পূজা পর্যন্ত দিয়েছেন।
তবে করুন বাস্তবতা এই যে, ডেমোক্রেট দলের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিলারি রিপাবলিকান দলের প্রার্থী ডোলান্ড ট্রাম্পের মতো অতটা উগ্র মুসলিমবিদ্বেষী না হলেও তিনি যে মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ কামনায় যথেষ্ট উৎসাহী এমনটা বলাও সম্ভব নয়। এর কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি, অর্থনীতি ও মিডিয়ায় মাত্রাতিরিক্ত ইহুদি প্রভাব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে এই মাত্রাতিরিক্ত ইহুদি প্রভাবের ফলশ্রুতিতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির পাশাপাশি তার পররাষ্ট্র নীতিতেও ইহুদি প্রভাব অতিরিক্ত প্রকট হয়ে পড়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক বিশ্বের নেতৃস্থানীয় শক্তি হিসেবে পরিচিতি লাভ করলেও মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তিন থেকে তাদের আদিবাসী ফিলিস্তিনিদের উৎখাত করে সেখানে তারা বিভিন্ন দেশ থেকে ইহুদি আমদানি করে সেখানে ইসরাইল নামের একটি জায়নবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সর্বাধিক পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে আসছে।
তাছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে পররাষ্ট্র নীতির কল্যাণে তার রাষ্ট্রনীতির মূল পরিচয় গণতন্ত্রের স্থলে সা¤্রাজ্যবাদ হয়ে দাঁড়িয়েছে তার মূলেও ইহুদি প্রভাব সুস্পষ্ট। বিশেষ করে ফিলিস্তিনের আদি বাসিন্দাদের মৌলিক মানবাধিকারের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সেখানে জায়নবাদী ইহুদীদের নিয়ে যে অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্র কায়েম করা হয়েছে এবং মূল বাসিন্দা ফিলিস্তিনের উৎখাত করে সেই অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলের আয়তন দিন দিন বৃদ্ধি করা হচ্ছে তা সম্ভবই হতো না এককালের তথাকথিত গণতন্ত্রী বিশ্বের নেতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যায় অমানবিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া। জায়নবাদী ইহুদিদের প্রতি পৃষ্ঠপোষকতা দানের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল ডেমোক্রেট ও রিপাবলিকানদের কোনো মতপার্থক্য নেই।
বিশ্বের মানচিত্র থেকে ফিলিস্তিন নামক একটি দেশকে মুছে ফেলার ব্যাপারে গণতান্ত্রিক বিশ্বের এককালীন তথাকথিত নেতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা সম্পর্কে বাংলাদেশে ফিলিস্তিনের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ইউসুফ এস ওয়াই রামাদানের সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে যা জানা গেছে তা থেকে এখানে কিছুটা আলোকপাত করা যেতে পারে। দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকায় গত সোমবার প্রকাশিত উক্ত সাক্ষাৎকারে জনাব রামাদান ফিলিস্তিনের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বলেন, জায়নবাদী দখলদারিত্বের কারণে ২৭ হাজার বর্গকিলোমিটার থেকে বর্তমানে ফিলিস্তিনের আয়তন হয়ে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬ হাজার বর্গকিলোমিটারে। তা এখন আরও কমছে। এ ব্যাপারে ইহুদিবাদী ও ইসরাইল সরকারকে শুরু থেকেই সব রকম সমর্থন দিয়ে চলেছে পশ্চিমারা। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
ফিলিস্তিনি চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স জনাব রামাদানের সাক্ষাৎকারে আরও যে একটা তথ্য বেরিয়ে এসেছে তা যেমনি চাঞ্চল্যকর, তেমনি ভয়াবহ। পশ্চিমা বিশ্বের পৃষ্ঠপোষকতার জন্য ইসরাইলের উদ্যোগেই কিছু দিন আগে আইএস (ইসলামিক স্টেট) নামের একটা সন্ত্রাসী গ্রুপ গঠন করা হয়েছে মুসলিম তরুণদেরকে সন্ত্রাসী কর্মকা-ে উৎসাহিত ও প্রশিক্ষিত করে তোলার লক্ষ্যে। এ ছিল এক ঢিলে ইসরাইলের দুই পাখি শিকারের চেষ্টার শামিল। এর মাধ্যমে মুসলিম তরুণদের উৎসাহী অংশকে একই সাথে বিপথগামী করে তাদের ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয়া এবং মুসলমানদের সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত করার স্বপ্ন দেখছে কুচক্রীরা। সুতরাং এসব ষড়যন্ত্র সম্পর্কেও সতর্ক থাকতে হবে সকলকে।
মোট কথা, বর্তমান বিশ্বে সোভিয়েত কমিউনিজমের পতনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর একশ্রেণির মুসলিমবিদ্বেষী পশ্চিমা নেতৃত্ব উদীয়মান মুসলিম উম্মাহকেই তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ধরে নিয়ে মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে নানামুখী ষড়যন্ত্র শুরু করে দিয়েছে। এদের পেছনে রয়েছে পশ্চিমা রাজনীতিতে প্রাধান্য বিস্তারকারী জায়নবাদী অপশক্তি। মুসলিম উম্মাহকে এদের এই বহুমুখী ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অত্যন্ত সাবধান থাকতে হবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র হলেও এবং বাহ্যিকভাবে গণতান্ত্রিক বিশ্বের মডেল হিসেবে পরিগণিত হলেও তার অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতিতে জায়নবাদী প্রভাব থাকার কারণে মার্কিন রাজনীতি কিছুতেই ইহুদি প্রভাবমুক্ত হতে পারছে না। এমতাবস্থায় মুসলিম বিশ্বকে অবশ্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক নির্ধারণে সাবধানতা অবলম্বনের প্রয়োজন রয়েছে।
বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমন একটি উন্নত পর্যায়ের রাষ্ট্র যার সাথে অন্যান্য দেশের সম্পর্ক রক্ষার প্রয়োজন পড়ে স্বাভাবিকভাবেই। তবে সে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে যেন আমরা মানবতার দুশমন জায়নবাদীদের প্রভাবে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত না হই সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে বাস্তবতার নিরিখেই। মোটের ওপর ইতিহাসের অভিজ্ঞতার আলোকে এবং বাস্তবতার নিরিখেই আমাদের যাবতীয় জাতীয় ও বৈশ্বিক নীতি নির্ধারণ করতে হবে। বর্তমানের জটিল পরিস্থিতিতে আমাদের কোন কিছুকেই অতিরেক সহজভাবে গ্রহণের সুযোগ নেই।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে লেখা শুরু করেছিলাম। সেই প্রসঙ্গ নিয়েই লেখা শেষ করতে চাই। সর্বশেষ ভোট গণনায় ট্রাম্পই জয়ী হয়েছেন। নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান দলের মধ্যে মূল প্রতিযোগিতা চললেও উভয় দলেই মানবতার এক নম্বর দুশমন জায়নবাদীদের প্রভাব রয়েছে প্রচুর। এ প্রভাব থেকে মার্কিন রাজনীতিকে পৃথক করে দেখা প্রায় অসম্ভব। এ অবস্থায় মুসলিম উম্মাহসহ মানবতার মুক্তিকামী বিশ্বকে মার্কিন রাজনীতি সম্পর্কে বাস্তবতার নিরিখে সতর্ক ও সাবধান থেকে নীতিনির্ধারণের কোনো বিকল্প নেই।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন