মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপ সম্পাদকীয়

অতিনিয়ন্ত্রণ কখনই কাম্য হতে পারে না

প্রকাশের সময় : ১১ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

কামরুল হাসান দর্পণ
অনিয়ন্ত্রিত কোনো কিছুই ভালো নয়। সবকিছুতেই নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত। তবে তা অতিনিয়ন্ত্রিত না হয়ে স্বাভাবিক ও সুষম হওয়া বাঞ্ছনীয়। যা অতিনিয়ন্ত্রণের মধ্যে পড়ে তা হয় বিগড়ে যায়, না হয় নিশ্চল হয়ে পড়ে। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রসহ সকল ক্ষেত্রেই এ কথা প্রযোজ্য। আমাদের দেশে সুষম নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি অনেক সময় অতিনিয়ন্ত্রণে পরিণত হয়। কেউ অন্যায় করলে ধর ধর মার মার কাট কাট পর্যায়ে যেমন চলে যায়, তেমনি কোনো ধরনের শোধরানো বা সুনিয়ন্ত্রণের পথে না গিয়ে প্রশ্রয় দিয়ে একেবারে গাছে উঠিয়ে দেয়া হয়। এক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্বের বিষয়টি খুব দৃষ্টিকটু হয়ে দেখা দেয়। এই যে দেশে প্রতিদিন এত নারী ও শিশু নির্যাতন, খুন, জখমসহ ঘৃণ্য সব ঘটনা ঘটছে, তার পেছনে অপরাধীকে নিয়ন্ত্রণ না করা বা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার শৈথিল্য অন্যতম কারণ হয়ে রয়েছে। অন্যদিকে বাক স্বাধীনতা, স্বাভাবিক রাজনীতি করার অধিকার ইত্যাদির ক্ষেত্রে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সেখানে নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে চরমপন্থা অবলম্বন করা হচ্ছে। যারা নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় রয়েছে, তারা নিজেদের ইচ্ছেমতো যা করার তা করার অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করছে। তারা এ স্বাধীনতা ভোগ করছে, তাদের যেমন খুশি তেমন স্বাধীনতার ক্ষেত্রে যারা মূল প্রতিদ্বন্দ্বী, তাদের অতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রেখে। এটা করা হয় প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে। রহিম যদি মনে করে করিম তার অর্জিত জনপ্রিয়তা দিয়ে রহিমের ক্ষমতা খর্ব বা ক্ষমতাকে অতিক্রম করে যাওয়ার সক্ষমতা রাখে, তবে সে তা সুবিবেচনা দিয়ে বিচার না করে শক্তি প্রয়োগে করিমকে প্রতিহত করতে উঠেপড়ে লাগে। করিমের জনপ্রিয়তাকে অজনপ্রিয় করে তোলার জন্য যত ধরনের অপবাদ রয়েছে তা দিয়ে বা কুৎসা রটিয়ে অপরাধী সাব্যস্ত করে। আরোপিত এই অপরাধে করিমকে দায়ী করে নিপীড়ন-নির্যাতন করতে দ্বিধা করে না। রহিমের অতিনিয়ন্ত্রণ থেকে বের হয়ে করিম যে টুঁ শব্দ করবে বা বুকভরে শ্বাস নেবে তার সুযোগও দেয়া হয় না। এ প্রবণতা কোনোভাবেই সুস্থ মানসিকতার পরিচায়ক নয়। বিপজ্জনকও বটে। আমাদের দেশের রাজনীতিতে এমন অতিনিয়ন্ত্রণ এবং নিয়ন্ত্রিত হতে বাধ্য করার একটি প্রবণতা বেশ কয়েক বছর ধরেই চলছে।
দুই.
আমার জন্য যা ভালো, অন্যের ক্ষতি করে হলেও তা নিয়ন্ত্রণে নিতে দ্বিধা না করার মানসিকতা এখন প্রবল হয়ে উঠেছে। নিজের লোকজন অপরাধ, অন্যায় বা দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত থাকলেও সেখানে নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন বোধ করছে না। প্রতিপক্ষ বা সচেতন শ্রেণি এ নিয়ে কথা বললেই তাকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে চেপে ধরা হচ্ছে। আমাদের রাজনীতির ক্ষেত্রে বিশেষ করে যারা ক্ষমতায় থাকে, তাদের মধ্যে এ প্রবণতা খুব বেশি দেখা যায়। এখানে রাজনীতির সুস্থ প্রতিযোগিতা অনুপস্থিত। একে অপরকে শত্রুজ্ঞান করে। কতটা শত্রু বা কতটা শত্রু নয়, তা বিচার করা হয় না। আবার যে সবার কাছেই খারাপ লোক হিসেবে কমন, সে-ও অতি আদরণীয় হয়ে ওঠে। বিষয়টি এমন, তুমি যত খারাপই হও, আমার সাথে থাকলে তোমার মতো ভালো মানুষ পৃথিবীতে আর হয় না। তোমার সাত খুন মাপ। এমন একটা অপসংস্কৃতি আমাদের দেশের রাজনীতিতে জোরালো হয়ে উঠেছে। গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারায় সরকারি দল ও বিরোধী দল থাকবেÑ এটাই স্বাভাবিক। সরকার ভুল করলে বা ভুল সিদ্ধান্ত নিলে বিরোধী দল তা যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে প্রতিবাদ করবে। বিরোধী দল ভুল করলে সরকারও তা যথাযথ কারণ ও যুক্তি দিয়ে প্রতিকারের ব্যবস্থা নেবে। এটাই রাজনীতির অতি সাধারণ ও শুদ্ধ আচরণ। ভুল ধরা বা বিরোধিতা করলেই কাউকে শত্রু ভাবতে হবে, এমন মনে করার কারণ নেই। আমাদের দেশে রাজনীতির ধারাটিকেই এমন করে ফেলা হয়েছে যে, সরকারি দল ও বিরোধী দল একে অপরকে চিরশত্রু ভাবে। কেউ কাউকে দুই চোখে দেখতে পারে না। একে অপরকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারলেই যেন বাঁচে। প্রতিদ্বন্দ্বীকে শুধু প্রতিহিংসার বশে অপবাদ দিয়ে শত্রু ভাবা কুরাজনীতি ছাড়া কিছুই নয়। এই কুরাজনীতিই বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন দৃশ্যমান। প্রতিপক্ষকে নিধনের যত ধরনের পন্থা আছে, তার সবই অবলম্বন করা হচ্ছে। পুরোপুরি নিধন করতে না পারলেও প্রশাসনিক ক্ষমতা দিয়ে অতিনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কোণঠাসা করে রাখা হচ্ছে। এই নিধন কর্ম ও কোণঠাসা করাকে বৈধ করতে জনগণের সামনে প্রতিপক্ষকে ‘এই বেটা চোর, এমন আরও যত ধরনের অপবাদ দেয়া যায়, দেয়া হচ্ছে। স্বৈরশাসনের কথা বাদ দিলে বাংলাদেশের মতো এমন অস্বাভাবিক রাজনীতি আর কোনো দেশে আছে কিনা, সন্দেহ। অথচ আমাদের রাজনীতির ধারাটা এমন ছিল না। আমরা যদি স্বাধীনতার পূর্বের রাজনীতির ধারা দেখি, সেখানে দেখা যাবে, মত-পথের ভিন্নতা থাকলেও সব রাজনৈতিক দলের কমন লক্ষ্য ছিল, পাকিস্তানের শাসন-শোষণ এবং অত্যাচার-নির্যাতন ও বঞ্চনা থেকে সাধারণ মানুষকে মুক্ত করা। এই এক লক্ষ্য সামনে রেখে সকলেই রাজনীতি করেছেন। এর ফলে দেশ স্বাধীন হয়েছে, মানুষ মুক্তির স্বাদ পেয়েছে। স্বাধীনতার পর রাজনীতির এই ধারাটা ধরে রাখা যায়নি। দেশ গড়ার যে অনিবার্য লক্ষ্য ছিল, তা থেকে অনেকেই লক্ষ্যচ্যুত হয়ে স্ব স্ব স্বার্থের রাজনীতি শুরু করে। শুধুই ক্ষমতাকেন্দ্রিক এবং ক্ষমতা দখলের রাজনীতিতে লিপ্ত হয়ে পড়ে। দেশের উন্নয়ন কর্মকা- পরিচালনা করতে ক্ষমতায় যেতে হবে, তবে তা যদি দেশের উন্নয়নের চেয়ে গোষ্ঠী স্বার্থের উন্নয়ন প্রধান লক্ষ্য হয়ে ওঠে, তবে তা অবশ্যই দোষণীয়। দুঃখের কথা, এই দোষণীয় রাজনীতিই আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর অন্যতম লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। কে কাকে ল্যাং মেরে ক্ষমতায় যাবে এবং ক্ষমতায় থাকবেÑ এটাই মুখ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দল বরাবরই অত্যন্ত সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে। কারণ, রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা তার হাতে এসে পড়ে। যার হাতে রাষ্ট্রযন্ত্র থাকে, পৃথিবীতে তার চেয়ে শক্তিশালী আর কেউ হয় না। তবে এক্ষেত্রে শক্তির অপপ্রয়োগে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হয়। আমার হাতে সর্বময় ক্ষমতা আছে বলে যা খুশি তা করে ফেলব, প্রতিপক্ষ বা বিরোধী দলকে নস্যি করে তুলবÑ এমন মনোভাব কাম্য হতে পারে না। তার কথা এবং বাদ-প্রতিবাদকে তুচ্ছজ্ঞান করা উচিত নয়। আমাদের চলমান রাজনীতিতে এমন সুশীল আচরণ এখন কেউ কল্পনা করতে পারে না। বলাবাহুল্য, বিরোধী রাজনীতি এখন সবচেয়ে বিপাকে রয়েছে। মাঠে-ময়দানে সমাবেশের মাধ্যমে জনগণের সামনে যে সরকারের ত্রুটি-বিচ্যুতি ও সমালোচনা করবে, তার সুযোগ নেই বললেই চলে। গণতন্ত্রের রীতিনীতি এবং পরিধির মধ্যে যতটুকু আচরণবিধি রয়েছে, তার সুযোগও সংকুচিত করে ফেলা হয়েছে। অর্থাৎ বিরোধী রাজনীতি এখন অনেকটাই নির্বাসনে। কেবল সরকারের রাজনীতিই মুখ্য হয়ে উঠেছে। সরকারের রাজনীতিতে এ মনোভাবে এটাই প্রতীয়মান হয়Ñ বিরোধী দল বলে কিছু নেই, থাকলেও তার পক্ষে জনগণ তো নেই-ই, এমনকি তার নেতা-কর্মীও নেই। সরকারের মনোভাব এমন হলে, বিরোধী রাজনীতির ক্ষেত্রে এর চেয়ে ভয়ংকর আর কিছু হতে পারে না। মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে এমন এক একপেশে রাজনীতি এখন আমরা দেখছি।
তিন.
মানুষ কথা বলা ছাড়া থাকতে পারে না। একে অপরের সাথে ভাব প্রকাশ এবং মনের কথা খুলে বলতে চায়। এই ভাব প্রকাশ করতে গিয়ে যুক্তি-তর্ক এবং বাদানুবাদ হওয়া স্বাভাবিক। এটা প্রকৃতির অমোঘ বিধান। সব মানুষের অবস্থান এবং জ্ঞান-বুদ্ধি যেহেতু সমান নয়, তাই যেসব মানুষ নিজেদের অতি উঁচুদরের মনে করে, তারা আবার একটু কমজোর ও কম জ্ঞান-বুদ্ধির মানুষের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করে। তারা মনে করে, কথা বলা বা সিদ্ধান্ত নেয়া একমাত্র অধিকার তাদেরই। তাদের নিচের সারির মানুষের এ অধিকার নেই। যে স্বৈরাচার বা স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার কথা এখন বলা হয়, তা মানুষের সভ্যতার সূচনাকাল থেকেই ছিল। নিচের সারির মানুষকে তারা দাস-দাসী হিসেবে বিবেচনা করত। সুদীর্ঘকালের এই ধারাবাহিকতায় একটা সময় উঁচুতলার মানুষদের মধ্যে যারা শুভবুদ্ধি সম্পন্ন তাদের কারো কারো উপলব্ধি হয়, সাধারণ মানুষের মতামত নেয়া এবং প্রকাশের সুযোগ দেয়া ও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এই উপলব্ধি থেকেই আড়াই হাজার বছর আগে এথেন্সের দার্শনিক ক্লিসথেনিস এমন একটি ধারণার উদ্ভব ঘটান, যেখানে সাধারণ মানুষের মতামত নেয়া এবং তদানুযায়ী শাসন কাজ চালানোর তত্ত্ব তুলে ধরা হয়। অর্থাৎ জনগণের মতামতের ভিত্তিতে শাসনকাজ পরিচালিত হবে। তার এই ধারণা থেকেই ডেমোক্রেসি বা গণতন্ত্রের সূচনা হয়। তার এ ধারণাটি বেশ গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয়তা লাভ করে। শাসকদের ভালো-মন্দ নিয়ে আমজনতা কথা বলতে শুরু করে। শাসকরাও তা সানন্দে গ্রহণ করে। সেই থেকে গণতন্ত্রের যে সূচনা তা আজও মানুষের কাছে সবচেয়ে আদরণীয় হয়ে আছে। শাসকরাও মানুষের এই পছন্দকে প্রাধান্য দিয়ে শাসন কাজ পরিচালনা করতে চেষ্টা করে চলেছে। অবশ্য কেউ কেউ এর ধারেকাছে না গিয়ে নিজেদের মতো করেই শাসন কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তবে গণতন্ত্রের যে যাত্রা, তার গুরুত্ব এবং গ্রহণযোগ্যতা দিন দিন বেড়ে চলেছে। অনেক মনীষী ও দার্শনিক এ তন্ত্রকে আরও উন্নত মানসম্পন্ন করার জন্য নিজেদের তত্ত্ব ও মতামত যুক্ত করে একে আরও বিস্তৃত এবং গ্রহণযোগ্য করে তুলেছেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন গণতন্ত্রের কথা বলতে গিয়ে যে কথা বলেছেন, তা গণতন্ত্রের অসংখ্য সংজ্ঞার মধ্যে উজ্জ্বল হয়ে আছে। তিনি উচ্চারণ করেছিলেন, গভর্নমেন্ট অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল। গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি, মত প্রকাশ নিয়ে ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার তো নিজের জীবন দিয়ে দেয়ার কথা বলেছেন। বলেছেন, তোমার মতের সাথে আমি একমত হতে না পারি, তবে তোমার মত প্রতিষ্ঠায় আমি জীবন দিতে পারি। লেখক-সাহিত্যিক জন মিল্টন আকুতি প্রকাশ করে বলেছেন, আমাকে জানার স্বাধীনতা দাও, বলার স্বাধীনতা দাও, তর্ক করার স্বাধীনতা দাও। এ কথাও বলেছেন, মানুষের এসব স্বাধীনতা ছাড়া বিজ্ঞান, রাজনীতিসহ কোনো কিছুই অগ্রসর হয় না। অর্থাৎ নিয়ন্ত্রিত করা মানুষের মুখ ফুটে কথা বলার তত্ত্ব ‘গণতন্ত্র’কে তারা অকুণ্ঠচিত্তে গ্রহণ করে বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে উদগ্রীব ছিলেন। তাদের এ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়নি। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশে গণতন্ত্র এখন সগৌরবে বিরাজ করছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, আমাদের মতো দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা খুবই কঠিন একটি কাজ। এসব দেশের শাসকরা এখনও সামন্ত্যবাদী মনোভাব থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। এটা অনেকটা গরিব দেশে বড় লোকদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি দেখানোর মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে গণতন্ত্র এখন অনেকটাই উন্নত বিশ্বের শাসন ব্যবস্থার তত্ত্বে পরিণত হয়েছে। কোনো কোনো দেশ সেসব দেশের গণতন্ত্রকে অনুসরণ করে বা ধারণা নিয়ে দেশ পরিচালনা করতে চেষ্টা করে। তবে তা পুরোপুরি প্রতিপালন করে না বা করতে দ্বিধাবোধ করে। গণতন্ত্রের আংশিক ধারণাকেই গণতন্ত্র বলে আখ্যায়িত করে। এটা করে তাদের একচ্ছত্র ক্ষমতাকে সুরক্ষিত করতে। কারণ পুরোপুরি গণতন্ত্রায়ণ করলে তাদের ক্ষমতা দেখানো ও প্রয়োগের শক্তি খর্ব হয়ে যাবে। আমাদের দেশে গণতন্ত্রের অবস্থা অনেকটা তেমন। গণতন্ত্রের বর্তমান অবস্থা নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলেন, গণতন্ত্রের ‘গণ’ উঠে গেছে, এর জায়গায় ‘কর্তৃত্ব’ যুক্ত হয়েছে। কেউ বলেন, গণতন্ত্রকে ‘অতিনিয়ন্ত্রণ’ বা ‘সংকুচিত’ করে ফেলা হয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো তো একবাক্যে বলছে, দেশে কোনো গণতন্ত্র নেই, স্বৈরতন্ত্র চলছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বিরোধী দলের এসব অভিযোগ যে একেবারে অসত্য, তা বলার উপায় নেই।
চার.
অতিরিক্ত কোনো কিছুই প্রকৃতি গ্রহণ করে না। অনেকেই বলেন, অতি ‘ভালো’ও ভালো নয়। তেমনি ‘অতিনিয়ন্ত্রণ’, ‘অতিসাবধানতা’ও ভালো নয়। এতে হিতে বিপরীত হয়। যারা মানসিকভাবে খুবই দুর্বল বা নার্ভাস, কেবল তারাই এমন পন্থা অবলম্বন করে। তা করতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে আরও বিপদে পড়ে। তাই সবক্ষেত্রেই স্বাভাবিক পরিস্থিতি বা চেক অ্যান্ড ব্যালান্স বজায় রাখা জরুরি। রাজনীতির ক্ষেত্রে তো ‘ব্যালান্স’-এর কোনো বিকল্প নেই। এর ব্যত্যয় ঘটলেই গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়ে। একনায়কতন্ত্রের উদ্ভব ঘটে। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় এই ‘ব্যালান্স’ করার গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয় ক্ষমতাসীনদের ওপর। যদি এমন হয়, চেক অ্যান্ড ব্যালান্স-এর ‘ব্যালান্স’ বাদ দিয়ে কেবল ‘চেক’ নিয়ে সরকার ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তবে বুঝতে হবে সরকার গণতন্ত্র ও জনগণের মধ্যে নেই। সে রাষ্ট্রশক্তির ওপর নির্ভরশীল। এ ধরনের সরকার নৈতিকভাবে খুবই দুর্বল হয়ে পড়ে। তার ভেতর সবসময় পড়ে যাওয়ার ভয় কাজ করে। বিরোধী দল যাতে তাকে কোনো ধরনের নড়াচড়া করে ফেলে দিতে না পারে, এ জন্য অতিসতর্ক ও অতিনিয়ন্ত্রণের পথ অবলম্বন করে। আমাদের দেশের রাজনীতিতে বিশেষ করে সরকারের মধ্যে এই মনোভাব অনেকটাই স্পষ্ট। এর সর্বশেষ প্রমাণ পাওয়া যায়, গত ৭ নভেম্বর জাতীয় সংহতি ও বিপ্লব দিবস উপলক্ষে প্রধান রাজনৈতিক বিরোধী দল বিএনপিকে সমাবেশ করতে না দেয়া থেকে। এক্ষেত্রে বিরোধী দলের গণতান্ত্রিক অধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে জোর করেই থামিয়ে দেয়া হয়েছে। এ বিষয়টিও পরিষ্কার হয়েছে, সরকারের অতিনিয়ন্ত্রণের কবলে পড়ে কোণঠাসা হওয়া বিএনপিকে সরকার খোলস থেকে বের হতে দিতে চাচ্ছে না। বিরোধী মত প্রকাশে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাজি নয়। সরকার কার্যকর ও শক্তিশালী বিরোধী মত থাকুক, তা চায় না। আবার এর মাধ্যমে এটাও ধরে নেয়া যায়, সরকারের ভেতর নার্ভাসনেস বা এক ধরনের ভীতি কাজ করছে। কারণ আমাদের দেশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমাবেশ মানেই হাজার হাজার মানুষের অংশগ্রহণ। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও জানে, বিএনপিকে সমাবেশ করতে দিলে হাজার হাজার মানুষ সমবেত হবে এবং তার অতিনিয়ন্ত্রণের বিষয়টি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। যেহেতু সরকার তার আচরণ দিয়ে ইতোমধ্যে বুঝিয়ে দিয়েছে, তার বিরুদ্ধে বড় সমাবেশ বা বিরোধিতার চিত্র বড় হয়ে উঠুক তা চায় না, তাই যে কোনো অজুহাতেই হোক তা প্রতিহত করতে হবে। সরকার করেছেও তাই। এ ধরনের মনোভাব যে গণতান্ত্রিক নয়, তা সচেতন মানুষ মাত্রই জানেন।
darpan.journalist@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন