পবিত্র রমজান মাসে অতি ব্যবহৃত পণ্যের দাহিদার তুলনায় মজুত বেশি। বাজারে সরবরাহ প্রচুর। তারপরও রমজানের আগেই বেড়ে গেছে ইফতার, সেহরি সংশ্লিষ্ট প্রয়োজনীয় সবধরনের পণ্যমূল্য। ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলা, খেজুর, পেঁয়াজ, মসুর ডাল, বেসন, খেসারির ডাল, গরুর গোশতসহ রমজাননির্ভর প্রতিটি পণ্যমূল্যে যেন আগুন লেগে গেছে। রাজধানীর বাজারগুলোতে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেলে প্রতিটি পণ্যে দোকান ঠাঁসা। তারপরও দাম বাড়তি। যাত্রাবাড়ী পাইকারি আড়তে ২০০ টাকার তরমুজ কিনে এক কিলোমিটার দূরে শনির আখড়া বাজারে ৪০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। রমজাননির্ভর সব পণ্যের একই অবস্থা। বাজার মনিটরিং করেন এমন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার টিসিবি’র মাধ্যমে এক কোটি পরিবারকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য দেয়ায় বাজারে এসব পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল হওয়ার কথা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে উল্টো চিত্র। প্রয়োজনীয় মনিটরিং না হওয়ায় অসাধু ব্যবসায়ীরা রমজাননির্ভর পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, মাত্র কয়েকজনের সিন্ডিকেটের কবজায় রয়েছে বাজার। সরকারের উচিত এদের নিয়ন্ত্রণ করা। সরকার টিসিবির মাধ্যমে হয়তো কিছু মানুষকে ভর্তুকি মূল্য পণ্য সরবরাহ করছে। কিন্তু বড় একটি অংশ; কিন্তু এর আওতার বাইরে। অধিক মুনাফা যাতে এ ব্যবসায়ীরা না করতে পারে, তার জন্য সরকারকে কঠোর হতে হবে।
গতকাল এক সেমিনারে অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, কিছু অতিলোভী অসাধু ব্যবসায়ী পণ্য মজুত করে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে জনজীবনে দুর্ভোগ তৈরি করছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য বৈশ্বিক পরিস্থিতিকে দায়ী করা হলেও প্রকৃতপক্ষে সুশাসনের অভাব এবং সরকারি সংস্থাগুলোর অদক্ষতা ও সমন্বয়হীনতা এর জন্য দায়ী।
সারাবিশ্ব যেখানে রমজান মাস উপলক্ষে মূল্যছাড় দিয়ে রেখেছে, সেখানে স্রোতের বিপরীতে বাংলাদেশ। প্রতিবছর পবিত্র রমজান মাসের আগে নির্দিষ্ট কিছু খাদ্যপণ্যের দাম বাড়বেÑ এটিই যেন নিয়ম। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। সারা দিন রোজা রাখার পর যারা ইফতারে লেবুর শরবত পান করতে পছন্দ করেন, তাদের জন্য দুঃসংবাদ আছে। রোজা শুরুর আগেই লেবুর দাম বেড়ে গেছে। এক সপ্তাহ আগেও যে লেবু প্রতি হালি বিক্রি করা হতো ৩০ থেকে ৪০ টাকায়, গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন কাঁচাবাজারে তা বিক্রি হয়েছে ৫০ থেকে ৬০ টাকায়। মূল্যবৃদ্ধির তালিকায় আরও রয়েছেÑ বেগুন, শসা, ধনেপাতা, পেঁয়াজ, ভোজ্যতেল, চিনি, খেজুর, চাল এবং সবধরনের গোশতের দামও ঊর্ধ্বমুখী। এর সবই মূলত ইফতারি তৈরির উপাদান। আর সেহরিতে যারা মুরগির গোশত খেতে পছন্দ করেন, তাদেরও আগের চেয়ে বেশি ব্যয় করতে হবে। এমনিতেই মাস দুয়েক ধরে বাজারে বেশিরভাগ নিত্যপণ্যের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী। এর মধ্যে নতুন করে কিছু পণ্যের দাম আবার বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের কষ্ট আরও বাড়বে। এবার যেসব পণ্যের দাম বেড়েছে, তার মূল কারণ মাহে রমজানের আগে হঠাৎ চাহিদা বেড়ে যাওয়া। রাজধানীর কারওয়ান বাজার, রামপুরা ও মিরপুরের বিভিন্ন পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী এবং ভোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রোজার মাসে যেসব পণ্য বেশি প্রয়োজন হয়, সেসব কিছুরই দাম বেড়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রমজান সামনে রেখে যে ভোজ্যতেলের চাহিদা তৈরি হয় দেশে তার চেয়ে বেশি পরিমাণ ভোজ্যতেল এবার মজুত রয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে গত ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট আমদানি হয়েছে ২১ লাখ ৭১ হাজার টন ভোজ্যতেল। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে এখন পর্যন্ত ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে ১৮ লাখ টন। এর সঙ্গে স্থানীয় উৎপাদন সরিষাসহ অন্য তেলবীজ থেকে আরও উৎপাদন হয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার টন। সব মিলিয়ে গত বছরের উদ্বৃত্তসহ এবার ২ লাখ টনের বেশি ভোজ্যতেল মজুত রয়েছে। এ ছাড়া প্রায় ২ লাখ ৩২ হাজার টন তেল দেশে প্রবেশের প্রক্রিয়ায়, যা রোজার প্রথম দিকেই চলে আসবে।
গত ২৩ মার্চ ব্যবসায়ী, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সুপারশপ ও বাজার কমিটির প্রতিনিধিদের সঙ্গে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের (ড্যাম) মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) আব্দুল গাফফার খান। সভায় রমজানের সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকে এমন ৮টি পণ্যের উৎপাদন, আমদানি, মজুত এবং চাহিদার তথ্য তুলে ধরেন। সেগুলো হলোÑ চাল, ডাল, পেঁয়াজ, ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলা, খেজুর এবং শাক-সবজি। এতে জানানো হয়, দেশে প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ টন চালের চাহিদার বিপরীতে চালের উৎপাদন হচ্ছে ৩ কোটি ৭৬ লাখ টন। ১৫ মার্চ পর্যন্ত আমদানি হয়েছে প্রায় ৯ লাখ ৫৯ হাজার টন। গত ৯ মার্চ পর্যন্ত খাদ্যশস্যের সরকারি মোট মজুত ১৯ লাখ ৩৩ হাজার টন। এর মধ্যে চাল ১৬ লাখ ৭৬ হাজার টন, গম ২ লাখ ২০ হাজার টন এবং ধান ৩৭ হাজার টন। বছরে ২৫ লাখ টনের চাহিদা হলেও রমজান মাসে পেঁয়াজের চাহিদা সাড়ে ৪ লাখ টন। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৩৫ লাখ ৪ হাজার টন। আমদানি হয়েছে ৬ থেকে ৭ লাখ টন। দেশে প্রায় ১৮ লাখ টন পরিশোধিত চিনির চাহিদা রয়েছে। রমজান মাসে এর চাহিদা ৩ লাখ টন। দেশে গত ২ মাসে ৪ লাখ ৮৮ হাজার টন অপরিশোধিত চিনি আমদানি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২ লাখ ৬০ হাজার টন বেশি। রমজানে মসুর ডালের চাহিদা ৭০ হাজার টন। চাহিদার বিপরীতে গত ফেব্রুয়ারি ও চলতি মার্চে এ পর্যন্ত আড়াই লাখ টনের বেশি আমদানি করা হয়েছে। রমজানে ৮০ হাজার টন ছোলার চাহিদার বিপরীতে ১ লাখ ৭৮ হাজার টন আমদানি করা হয়েছে। খেজুরের চাহিদা ২৫ হাজার টনের বিপরীতে ৫০ হাজার টন আমদানি করেছে সরকার।
গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি কেজি ছোলা বিক্রি হচ্ছে ৭০-৭৫ টাকা। মহল্লার দোকানগুলোতে একই মানের ছোলা বিক্রি হচ্ছে ৮০-৯০ টাকা। রমজান শুরু হওয়ার আগেই খুচরা ও পাইকারি বাজারে ছোলার দাম বেড়েছে। ইফতারির অন্যতম অনুষঙ্গ ছোলার দাম বাড়া নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন ক্রেতারা। দাম বাড়ার জন্য খুচরা বিক্রেতারা দুষছেন পাইকারি বাজারকে। শুধু ছোলা নয় বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে রোজার অন্যতম খাদ্যসামগ্রী, ডাল, বেসন, চিনি, মসুর ডাল ও খেজুর। বাজারে খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে ৮৫ টাকায়, যা এক সপ্তাহ আগেও ছিল ৮০ টাকা ও ১০-১৫ টাকা বেড়ে দেশি মসুরের ডাল ১২৫-১৩০ টাকা। মাঝারি দানার মসুর ডালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১০০-১১০ টাকা, যা কিছুদিন আগেও ছিল ৮০-৯০ টাকা কেজি। এ ছাড়া মানভেদে প্রতি কেজি খেজুরে ৫০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। লেবুর হালি বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ টাকায়। যা গত সপ্তাহেও ছিল ৪০-৫০ টাকা।
অন্যদিকে বুটের ডালের বেসন বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকা কেজি, যা কিছুদিন আগে ছিল ৮০-৯০ টাকার মধ্যে। আর খেসারির ডালের বেসন বিক্রি হচ্ছে ১০০-১১০ টাকা কেজি, যা কিছুদিন আগে ছিল ৮০-৯০ টাকার মধ্যে।
টিসিবির তথ্য বলছে, গত এক বছরের তুলনায় ছোলার দাম বেড়েছে ৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ। গত বছর যে ছোলা ৬৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। সেটি এ বছর ৭০ থেকে ৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একইভাবে মসুর ডাল ১৬ থেকে ৪৪ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। গত বছর দেশি মসুর ডাল বিক্রি হয়েছে ১০০-১১০ টাকা। এ বছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২৫-১৩০ টাকা। বড় দানার মসুর ডাল ছিল ৬৫-৭০ টাকা । এ বছর বিক্রি হচ্ছে ৯৫-১০০ টাকা।
ভোজ্য তেলের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, গত এক বছরে দাম ১৬ থেকে ২২ শতাংশ দাম বেড়েছে। গত বছর সয়াবিন তেলের ১ লিটারের বোতল বিক্রি হয়েছে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা। পাঁচ লিটারের সয়াবিন বিক্রি হয়েছে ৬৩০ থেকে ৬৫০ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে বোতলজাত ৫ লিটার সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে ৭৯০ থেকে ৮০০ টাকা এবং এক লিটার বিক্রি হচ্ছে ১৬৫ থেকে ১৬৮ টাকা। আর খোলা সয়াবিন তেলের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৭০ থেকে ১৭৮ টাকা দরে। অন্যান্য পণ্যের মতো চিনির দামও বেড়েছে। গত বছর ডিসেম্বর পর্যন্ত চিনির দাম ছিল ৭৮ টাকা। এ বছর ২ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা।
গত এক বছরে সব ধরনের গোশতের দাম বেড়েছে। এই বৃদ্ধির হার কেজিপ্রতি ৪ থেকে ১৬ শতাংশ পর্যন্ত। গত বছর প্রতি কেজি গরুর গোশত বিক্রি হয়েছে ৫৬০ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে দাম বেড়ে স্থানভেদে বিক্রি হচ্ছে ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা। একইভাবে দাম বেড়েছে ব্রয়লার ও দেশি মুরগির। এক বছরের ব্যবধানে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগিতে দাম বেড়েছে ৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ। দেশি মুরগির দাম বেড়েছে ১৪ দশমিক ১৩ শতাংশ।
এ ছাড়া এক বছরের ব্যবধানে গড়ে চালের দাম বেড়েছে ১ থেকে ৬ শতাংশ। এখন বাজারে প্রতি কেজি চিকন চাল বিক্রি হচ্ছে ৬৬ থেকে ৭০ টাকায়। এ ছাড়া মাঝারি মানের চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৬ থেকে ৬০ টাকা দরে।
এদিকে রমজানকে সামনে রেখে এরই মধ্যে রাজধানীর ১ কোটি পরিবারের মধ্যে সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য বিক্রি শুরু করছে সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। টিসিবির মুখপাত্র হুমায়ুন কবির ইনকিলাবকে বলেন, রমজানে যেসব নিত্য পণ্যের চাহিদা বেশি বিশেষ করে সয়াবিন তেল, মসুর ডাল, চিনি, পেঁয়াজ, খেজুর ও ছোলা ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করা হচ্ছে। পবিত্র রমজান উপলক্ষে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে টিসিবি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় এক কোটি নিম্ন আয়ের পরিবারকে (প্রতিটি পরিবারকে ২ বার) ভর্তুকি মূল্যে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকে টিসিবির পণ্য বিক্রি করছে। তবে দেশে এসব পণ্যের পর্যাপ্ত মজুত আছে। বাজারে দাম বাড়ার কথা নয়। যদিও টিসিবি বাজার দর নিয়ন্ত্রণ করে না। তারপরও টিসিবি ছোলা বিক্রি শুরু করার পর দেশে ছোলার দাম কেজি প্রতি ৭/৮ টাকা কমেছে বলে উল্লেখ করেন হুমায়ুন কবির।
টিসিবি’র তথ্যমতে, গত বছর রমজানে টিসিবি সয়াবিন তেল ৯০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছে। যা এ বছর রমজানের আগেই বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১০ টাকায়। গত বছর রমজানের প্রয়োজনীয় আরেক পণ্য চিনি বিক্রি করেছে ৫০ টাকা কেজি দরে। যা এ বছর ৫৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। মসুর ডাল গত বছর বিক্রি হয়েছে ৫৫ টাকা কেজি দরে, এ বছর ৬৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। পেঁয়াজ গত বছর বিক্রি হয়েছে ১৫ টাকা কেজি দরে, এ বছর ২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। ছোলা গত বছর বিক্রি হয়েছে ৬০ টাকা কেজি দরে, এ বছর ৫০ টাকায়। এছাড়া খেজুর গত বছর বিক্রি হয়েছে ৯০ টাকা দরে, এ বছর ৮০ টাকা কেজি দরে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন