পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের অনুরোধের পর দেশটির পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ড. আরিফ আলভি। এর আগে পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিরোধীদের আনা অনাস্থা প্রস্তাব খারিজ হয়ে যায়। এ পরিস্থিতিতে ইমরান খানই থাকছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং আগামী ৯০ দিনের মধ্যে দেশটিতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
অনাস্থা প্রস্তাব খারিজ হওয়ার হলে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে নির্বাচন দেয়ার জন্য প্রেসিডেন্টের কাছে অনুরোধ জানান। তার পরপরই প্রেসিডেন্ট এ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। নিয়ম অনুযায়ী নব্বই দিনের মধ্যে দেশটিতে সাধারণ নির্বাচন হবে। এ সময়ে অবশ্য ইমরান খানই প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন। তবে বিলুপ্ত হয়ে যাবে মন্ত্রিসভা। প্রেসিডেন্টের সচিবালয় থেকে জারি করা একটি বিবৃতিতে এ তথ্য জানানো হয়। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ড. আরিফ আলভি, পাকিস্তানের ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের সংবিধানের ৪৮(১) অনুচ্ছেদের সাথে পঠিত অনুচ্ছেদ ৫৮ (১) এর অধীনে জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেওয়ার জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুমোদন করেছেন।’
গতকালই পাকিস্তানের পার্লামেন্টে ইমরান খানের সরকারের বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাবে ভোটাভুটি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রস্তাবটি খারিজ হয়ে যায়। জাতীয় পরিষদের ডেপুটি স্পিকার কাসিম সুরি ওই প্রস্তাবের বিষয়ে ভোটাভুটি করতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি বিরোধীদের আনা প্রস্তাবটিকে অসাংবিধানিক বলে আখ্যায়িত করেন। সুরির পঠিত রায়টি বিরোধী বেঞ্চ থেকে তীব্র প্রতিবাদের কারণ হয় যারা তাদের প্রতিবাদ রেকর্ড করার জন্য স্পিকারের ডেস্ক ঘেরাও করেছিল। সুরি বলেন যে, রেজোলিউশনটি একটি বিদেশী শক্তি সমর্থিত বলে অভিযোগে ভোট দেওয়া যাবে না। তিনি অধিবেশনও অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেন। অধিবেশন শুরু হওয়ার সাথে সাথে তথ্যমন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরী অনাস্থা প্রস্তাবকে পাকিস্তানের শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তনের বিদেশী ষড়যন্ত্র বলে অভিহিত করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও বিরোধী দলের বিরুদ্ধে সেøাগান দিতে চাওয়া সরকারি আইনপ্রণেতাদের সেøাগানের মধ্যে তিনি এ কথা বলেন। তিনি স্পিকারের কাছে প্রস্তাবের সাংবিধানিকতার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার আহ্বান জানান। আগের দিন, বিরোধী দলগুলো একটি সংসদীয় বৈঠক করেছিল যাতে কমপক্ষে ১৭৪ জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। তাদের মধ্যে ৮৪ জন পিএমএল-এন, ৫৬ জন পিপিপি এবং ১৪ জন মুত্তাহিদা মজলিস-ই-আমাল (এমএমএ) এর সদস্য।
বিবিসির সংবাদদাতা সেকেন্দার কেরমানি বলেছেন, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সহায়তায় ইমরান খান ক্ষমতায় এসেছিলেন বলে মনে করা হয়। কিন্তু সম্প্রতি সেই সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে বলে পর্যবেক্ষকরা জানিয়েছেন। তার রাজনৈতিক বিরোধীরা সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েছে। তার জোট সরকারের বেশ কয়েকজন সহযোগী প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়ে বিরোধীদের দলে যোগ দেন। এ অবস্থায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সম্ভবত তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন। অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে খানকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে অপসারণের প্রচেষ্টা চালায় পাকিস্তানের বেশ কিছু বিরোধী দল।
পরিস্থিতি নিয়ে স্বপ্রণোদিত নোটিশ নিলেন প্রধান বিচারপতি : দেশের পরিস্থিতি নিয়ে স্বপ্রণোদিত নোটিশ নিলেন পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি (সিজেপি) উমর আতা বন্দিয়াল। সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র গতকাল একথা জানিয়েছেন। জাতীয় পরিষদের (এনএ) ডেপুটি স্পিকার কাসিম সুরি প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব খারিজ করার পরে এবং পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেয়ার কারণে পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতির স্বপ্রণোদিত নোটিশ নিয়েছেন সিজেপি। পরিস্থিতির সাথে সেনাবাহিনীর কোনো সম্পর্ক নেই : পাকিস্তানের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে এদিন যা ঘটেছে তার সাথে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কোনো সম্পর্ক নেই। পাকিস্তানের ইন্টার-সার্ভিস পাবলিক রিলেশন্স (আইএসপিআর) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল বাবর ইফতিখার রোববার একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সাথে দেয়া সাক্ষাতকারে এ কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবে ভোট দেয়ার জন্য গতকাল ডাকা জাতীয় পরিষদের অধিবেশন চলাকালীন যা ঘটেছিল তা পাকিস্তান সেনাবাহিনী অবগত ছিল কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে ডিজি আইএসপিআরের মন্তব্য এসেছে। মেজর জেনারেল বাবর ইফতিখার বলেন, ‘আজকে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে যা ঘটেছে তার সাথে সেনাবাহিনীর কোনো সম্পর্ক নেই।’
পাঞ্জাবের নতুন গভর্নর উমর সরফরাজ : পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের নতুন গভর্নর হিসেবে ওমর সরফরাজ চিমাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এর আগে চৌধুরী মুহাম্মদ সারোয়ারকে ওই পদ থেকে সরিয়ে দেয় ইমরান প্রশাসন। এদিকে অনাস্থা ভোটের আগে পাকিস্তানের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির স্পিকার আসাদ কায়সারকে অপসারণের জন্য একটি প্রস্তাব নিয়ে এসেছে বিরোধীরা। ১১০ জনের স্বাক্ষরও রয়েছে সেই প্রস্তাবে। অনাস্থা ভোট শুরু হওয়ার আগে বিক্ষোভ, জমায়েত বন্ধ করতে ইসলামাবাদে জারি করা হয়েছে ১৪৪ ধারা। স্থানীয় জেলা প্রশাসনের থেকে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা রাখা হয়েছে পাকিস্তানের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির বাইরে।
আফগান ইস্যুতে পাকিস্তানকে পাশে চায় যুক্তরাষ্ট্র : দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা সত্ত্বেও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনও চায় পাকিস্তান আফগানিস্তানে শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনতে তার ভূমিকা অব্যাহত রাখুক। গত ৩১ মার্চ, পাকিস্তান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই আফগানিস্তানের জন্য তথাকথিত বর্ধিত ট্রোইকাণ্ডএর আরেকটি বৈঠকে অংশগ্রহণ করেছিল, যার মধ্যে রাশিয়া এবং চীনও রয়েছে। চারটি দেশই আফগানিস্তানের জন্য তাদের বিশেষ দূতদেরকে প্রাচীন চীনা শহর তুনসিতে পাঠিয়েছে যেখানে চীন, রাশিয়া, পাকিস্তান, ইরান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান এবং উজবেকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদেরও আরেকটি বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছে। ট্রোইকা বৈঠকের পর, চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন উল্লেখ করেছেন যে, ‘চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং পাকিস্তান এমন সব দেশ, যাদের আফগান ইস্যুতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে।’
একই কথা বলা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের সর্বশেষ সংবাদ ব্রিফিংয়ে। ‘এগুলো এমন দেশ, যাদের তালেবানের উপরে ভালমাত্রায় প্রভাব, এবং ‘এক্সটেন্ডেড ট্রোইকা’ অতীতে একটি গঠনমূলক ফোরাম ছিল, এবং এটি গুরুত্বপূর্ণ যে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আফগানিস্তানে তার দৃষ্টিভঙ্গিতে ঐক্যবদ্ধ রাখবে,’ স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র নেড প্রাইস বলেন, ‘তালেবানকে সঠিক পথে ঠেলে দেয়ার জন্য এই সুবিধাটি ব্যবহার করা এই সমস্ত দেশের দায়িত্ব।’ প্রাইস বলেছেন যে, আফগানিস্তানে মার্কিন স্বার্থ ‘ট্রয়কার সদস্যদের সাথে সংযুক্ত’, যার মধ্যে রয়েছে পাকিস্তান, যার আফগানিস্তানের সাথে দীর্ঘতম সীমান্ত রয়েছে এবং ওয়াশিংটনের নীতিনির্ধারকরা বিশ্বাস করেন যে, ইসলামাবাদের এখনও তাদের নীতিনির্ধারণকে প্রভাবিত করার জন্য তালেবানদের উপর যথেষ্ট সুবিধা রয়েছে।
তিনি আরও ব্যাখ্যা করেছেন যে, এই বর্ধিত ট্রয়কার সদস্যদের দুটি মূল বিষয়ে তাদের প্রভাব ব্যবহার করা উচিত। ওয়াশিংটন গত বছরের আগস্ট থেকে যখন তালেবানরা কাবুল দখল করে তখন থেকে এ বিষয়ে জোর দিয়ে আসছে। সেগুলো হল, ‘মেয়েদের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ফিরে আসা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনকে উৎসাহিত করা।’ আফগানিস্তানে পাকিস্তানের ভূমিকা স্বীকার করা ইঙ্গিত দেয় যে, ওয়াশিংটন এখনও ইসলামাবাদের সাথে এমন ইস্যুতে জড়িত থাকতে চায় যেখানে পাকিস্তান একটি কার্যকর সহায়ক হতে পারে। কিন্তু মার্কিন রাজধানীতে কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকরা আর দক্ষিণ এশিয়ার দেশটির সাথে ওয়াশিংটনের এক সময়ের ঘনিষ্ঠ অংশীদারিত্ব পুনরুজ্জীবিত করার আকাক্সক্ষা দেখতে পাচ্ছেন না।
পাকিস্তান-মার্কিন সম্পর্ক ২০১১ সাল থেকে উত্তেজনাপূর্ণ, যখন আমেরিকানরা ইসলামাবাদকে না জানিয়ে অ্যাবোটাবাদে ওসামা বিন লাদেনকে খুঁজে বের করে নিয়ে যায়। কিন্তু পিটিআই সরকারের নীতির প্রতি মার্কিন অসন্তোষ প্রকাশ করে একটি কথিত চিঠির আবিষ্কার পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠনের মার্কিন আকাক্সক্ষাকে আরও ক্ষয় করেছে। যদিও অভিযুক্ত চিঠি, যা ওয়াশিংটন বলেছে যে তারা কখনও লেখেনি বা পাঠায়নি, বলছে যে, পিটিআই সরকারকে সরিয়ে দিলে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করা যেতে পারে। সূত্র : ডন, ট্রিবিউন, বিবিসি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন