স্বল্পোন্নত দেশ হতে বাংলাদেশের উত্তোরণ পরবর্তী সময়ে দেশের প্লাস্টিক খাতের বিকাশে কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক কাঠামো সহজীকরণ, সংশ্লিষ্ট নীতিমালার যুগোপযোগীকরণ, পণ্য জাহাজীকরণে শুল্ক হ্রাস, রপ্তানি বৃদ্ধিতে সম্ভাবনাময় দেশগুলোর সাথে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর, প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, আন্তর্জাতিক মানের টেস্টিং ল্যাবরেটরি স্থাপন, নতুন পণ্য উদ্ভাবনে ডিজাইনিং কার্যক্রমের উপর জোরারোপ, বিনিয়োগ আকর্ষনে ব্যবসা সহায়ক পরিবশে নিশ্চিতকরণের উপর জোরারোপের আহ্বান জানিয়েছে ঢাকা চেম্বার। উল্লেখ্য, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘স্বল্পোন্নত দেশ হতে উত্তোরণ পরবর্তী সময়ে টেকসই রপ্তানি বৃদ্ধি; প্লাস্টিক খাতের কৌশল নির্ধারণ’ শীর্ষক ওয়েবিনার আজ (শনিবার) অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস এবং এফবিসিসিআই সভাপতি মোঃ জসিম উদ্দিন যথাক্রমে প্রধান অতিথি ও বিশেষ অতিথি হিসেবে যোগদান করেন।
ওয়েবিনারের স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, আমাদের জিডিপিতে প্লাস্টিক খাতের অবদান ০.৩৩ শতাংশ এবং এখাতের মাধ্যমে দেশে প্রায় ১.৫ মিলিয়ন লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, বৈশি^কবাজারে দেশের প্লাস্টিক খাতের অবদান ০.৬ শতাংশ এবং আমাদের উৎপাদিত পণ্য মূলত যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানী, নেদারল্যান্ডস্, ভারত, পোল্যান্ড, চীন, জাপান প্রভৃতি দেশে রপ্তানি হয়ে থাকে। ২০২৬ সালের পরে স্বল্পোন্নত দেশ হতে বাংলাদেশের উত্তোরণকালে প্লাস্টিক খাতের পণ্য রপ্তানিতে নানামুখী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে, যা মোকাবেলায় বিশেষকরে কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক কাঠামোর সহজীকরণ, প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা প্রদান, বায়ো-প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহারকে উৎসাহিতকরণে নীতিমালা প্রণয়ন এবং রপ্তানি বৃদ্ধিতে সম্ভাবনাময় দেশগুলোর সাথে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরে উদ্যোগ গ্রহণের উপর তিনি জোরারোপ করেন। সেই সাথে এশিল্পের রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ, প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা সাধন, আন্তর্জাতিক মানে টেস্টিং ল্যাবরেটরি সুবিধা নিশ্চিতকরণ, নতুন পণ্য উদ্ভাবনে ডিজাইনিং কার্যক্রমের উপর জোরারোপ, মানবসম্পদের দক্ষতা উন্নয়ন, ইডিএফ সুবিধা সম্প্রসারণ এবং দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ সম্প্রসারণে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ একান্ত অপরিহার্য বলে মত প্রকাশ করেন ঢাকা চেম্বারের সভাপতি রিজওয়ান রাহমান। এছাড়াও তিনি তৈরি পোষাক খাতের সাফল্যের মডেলের আলোকে প্লাস্টিক শিল্পে নীতি ও প্রণোদনা সহায়তা প্রদানে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
প্রধান অতিথি’র বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস বলেন, জাতিগতভাবে আমাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বেড়েছে, একই সাথে আমাদের উদ্যোক্তাদের দক্ষতা প্রতিনিয়িত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বর্তমান সরকার দেশের বেসরকারিখাতের অগ্রগতির জন্য ক্রমাগত সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে, যা সামনের দিনগুলোতেও অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন, বেসরকারিখাতের সহায়তায় আমরা সকল নেতিবাচক সমালোচনা মোকাবেলা করতে পেরেছি এবং অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন কর্মকান্ড অব্যাহত রাখতে পেরেছি। এলডিসি উত্তর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার পাশাপাশি দেশের প্লাস্টিক খাতের সার্বিক উন্নয়নে বেসরকারিখাতের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করা যেতে পারে বলে, মুখ্য সচিব মত প্রকাশ করেন। এখাতের উন্নয়নে শুল্কমুক্ত সুবিধা সম্প্রসারণ, অন্যান্য প্রণোদনা প্রদান, রপ্তানি পণ্যের জাহাজীকরণের মাশুল হ্রাস এবং সম্ভাবনাময় দেশগুলোর সাথে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের উপর তিনি জোরারোপ করেন।
বিশেষ অতিথি’র বক্তব্যে এফবিসিসিআই সভাপতি মোঃ জসিম উদ্দিন বলেন, এলডিসি’র চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের রপ্তানি বৃদ্ধিতে পণ্যের বহুমুখীরকণের কোন বিকল্প নেই, যেখানে প্লাস্টিক খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তিনি উল্লেখ করেন, বেকওয়ার্ড লিংকেজ সহ প্লাস্টিক খাতের বাৎসরিক রপ্তানি প্রায় ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কাছাকাছি, তাই এখাতের বিকাশে নীতি সহায়তা প্রদান, দেশে বিশ^মানের টেস্টিং ল্যাবরেটরি স্থাপন, উৎপাদিত পণ্যের পেটেন্ট স্বত্ব, নতুন নতুন পণ্য উদ্ভাবন, দক্ষ মানব সম্পদ, এসএমইদের সক্ষমতা বাড়ানো এবং বিশেষকরে রপ্তানি পণ্য জাহাজীকরণে বিদ্যমান শুল্ক হ্রাসের উপর জোরারোপ করেন। তিনি বলেন, প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহের উপর আমাদের নজর দিতে হবে, কারণ এ থেকেও বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। সকল রপ্তানিকারকদের জন্য একই হারে কর্পোরেট কর নির্ধারণ, বন্ডেড ওয়ারহাউস সুবিধা প্রদানের দাবী জানান, এফবিসিসিআই সভাপতি। এছাড়াও তিনি এলডিসি গ্রাজুয়েশন হওয়ার পূর্বে আমাদের অবকাঠামো উন্নয়নের উপর জোরারোপ করেন।
ওয়েবিনারে মূল বক্তব্য উপস্থাপনকালে বাংলাদেশ প্লাস্টিক পণ্য প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিপিজিএমইএ)’র সভাপতি শামীম আহমেদ বলেন, ২০২০-২১ অর্থবছরে প্লাস্টিক খাতের মোট রপ্তানির পরিমাণ ছিল প্রায় ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি এবং এখাতের স্থানীয় বাজারের পরিমাণ প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। তিনি জানান, বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী খাতগুলোর মধ্যে ১২তম স্থানে রয়েছে প্লাস্টিক খাত এবং এটি প্রতিবছর প্রায় ৪.৫% হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অর্থায়ন জটিলতা, কেন্দ্রীয় বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধার অনুপস্থিতি, অপ্রতুল দক্ষ মানবসম্পদ ও পণ্যের বহুমুখীকরণ এখাতের অন্যতম প্রতিন্ধকতা বলে উল্লেখ করেন শামীম আহমেদ। তিনি আরো বলেন, এলডিসি উত্তরোণ পরবর্তী সময়ে আমাদের প্লাস্টিক শিল্প পণ্য রপ্তানিতে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা এবং প্রণোদনা প্রাপ্তি হতে বঞ্চিত হবে, যার ফলে সক্ষমতা হ্রাসের সম্ভবনা তৈরি হবে, তবে তা মোকাবেলায় সংশ্লিষ্ট সকলকে এখনই কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে এগিয়ে আসতে হবে। এলডিসি পরবর্তী সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দেশের আমদানি-রপ্তানি নীতিমালায় প্রয়োজনীয় সংষ্কার, এখাতে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষনে ব্যবসা সহায়ক পরিবেশের উন্নয়ন, পেটেন্ট রেজিস্ট্রেশন, আইপিআর ইকোসিস্টেম, নতুন পণ্য উদ্ভাবন এবং গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রমের উপর আরো বেশি হারে মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানান বিপিজিএমইএ’র সভাপতি।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)’র সদস্য (অডিট কাস্টমস) ড. মোঃ শহীদুল ইসলাম, প্রাণ আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আহসান খান চৌধুরী এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয় (বুয়েট)-এর কেমিক্যাল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন অনুষ্ঠানের নির্ধারিত আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন।
ড. মোঃ শহীদুল ইসলাম বলেন, প্লাস্টিক পণ্যের স্থানীয় চাহিদার প্রায় ৮০শতাংশই আমাদের নিজস্ব উৎপাদিত পণ্যের মাধ্যমে মেটানো হয়ে থাকে। রপ্তানি বহুমুখীকরণ, ভ্যালু এ্যাডেড পণ্যে উৎপাদনে বেশি হারে জোরারোপ, আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিতকরণ, নিজস্ব ডিজাইন হাউস স্থাপনের পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি সংস্থা সমূহের সমন্বয় বাড়ানোর পরামর্শ প্রদান করেন এনবিআরের এই কর্মকর্তা। সেই সাথে তিনি প্লাস্টিক পণ্যের কাঁচামাল আমদানিতে জাহাজীকরণে শুল্ক কমানো, পণ্য খালাসের সময় বন্দরে কাস্টমস প্রক্রিয়া দ্রুততর করার প্রস্তাব করেন, যার মাধ্যমে ব্যবসায় ব্যয় ও সময় হ্রাস পাবে।
আহসান খান চৌধুরী বলেন, প্লাস্টিক পণ্য পুনঃব্যবহারে আমাদের সক্ষমতা বাড়ছে এবং বাংলাদেশের উৎপাদিত পণ্য বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, আস্ট্রেলিয়া, জার্মানী সহ ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। তিনি বলেন, এলডিসি উত্তরোণের বিষয়ে আমাদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই, তবে নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সকলকে মনোযোগী হতে হবে। সেই সাথে পণ্য উৎপাদন ব্যয় হ্রাস এবং বিশেষকরে ইউরোপের দেশগুলোতে স্বল্পমূল্যে জাহাজীকরণ সম্ভব হলে প্লাস্টিক শিল্পে রপ্তানি আরো বাড়বে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন, একই সাথে রপ্তানির সম্ভাবনাময় দেশগুলোর সাথে পিটিএ ও এফটিএ স্বাক্ষরেরও প্রস্তাব করেন। এছাড়াও প্লাস্টিক শিল্পের জন্য তিনি বন্ডেড ওয়ারহাউস সুবিধা দেওয়ার আহ্বান জানান। প্লাস্টিক খাতে কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক হ্রাসের প্রস্তাব করেন আহসান খান।
ড. ইজাজ হোসেন প্লাস্টিক খাতের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা এবং সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তরের সক্ষমতা বাড়ানোর আহ্বান জানান। তিনি প্লাস্টিক পণ্যের পুনঃব্যবহারের উপর জোরারোপ করেন, কারণ এ থেকে উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি করা সম্ভব। রপ্তানি বৃদ্ধির পাশাপাশি ব্যবসায় ব্যয় ও সময় হ্রাসকল্পে দেশে একটি আন্তর্জাতিক মানের সার্টিফিকেশন ল্যাবরেটরি স্থাপনের প্রস্তাব করেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন