শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

গণতন্ত্রের সঙ্কট

হারুন-আর-রশিদ | প্রকাশের সময় : ১৪ এপ্রিল, ২০২২, ১২:০১ এএম

গণতন্ত্রের ছদ্মবেশে একদলীয় কর্তৃত্ববাদী শাসন বাংলাদেশে আমরা দেখছি টানা বহু বছর ধরে। গণতন্ত্রের পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে গিয়ে অতীতে বাংলাদেশে বহু মানুষের প্রাণ হারিয়েছে। তৎকালীন পাকিস্তানের স্বৈরচারি আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গণতন্ত্রের সূচনাপর্ব শুরু হয়। সেনাশাসক আইয়ুব খান ১৯৬৯ সালে পদত্যাগে বাধ্য হন। ক্ষমতায় আসেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। ইয়াহিয়া সরকার আন্দোলনের মুখে ১৯৭০ সালে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বরের নিবার্চনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে আওয়ামী লীগ বিজয় অর্জন করে। মেজরিটি আসনে বিজয়ী দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার কারণে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। ৯ মাস ব্যাপী এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাকিস্তান পরাজিত হয়। উপমহাদেশে বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ইয়াহিয়া খান যদি নির্বাচনে বিজয়ী দলের কাছে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করতেন তাহলে পাকিস্তান ভেঙে যেতো না। সে হিসেবে এক কথায় বলা যায়, স্বাধীনতার মূলমন্ত্র এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূল উৎস ছিল গণতন্ত্র। বিগত ৫০ বছর ধরে বাংলাদেশে গণতন্ত্র তার নিজস্ব কাঠামোতে আবদ্ধ থাকতে পারেনি। যখন যে দল ক্ষমতায় আসে তাদের পছন্দ অনুযায়ী গণতন্ত্রকে সাজিয়ে নেয়। ফলে গণতন্ত্র বাংলাদশে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিতে পারেনি। সবারই উদ্দিশ্য আজীবন ক্ষমতায় টিকে থাকা। এ কারণে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের মৌলিকত্ব বজায় থাকেনি। অধিকাংশ সময়ই বাংলাদেশে গণতন্ত্রের জন্য ছিল সংকটকাল। মূলত রাজনীতিকরাই গণতন্ত্রকে সংকটে ফেলে দিয়েছেন। রাজনৈতিক দলগুলো পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশে স্থায়ী রূপ দিতে পারতো। সেটা তারা করেনি বলেই গণতন্ত্রের সংকট এখোনো চলমান আছে। একটি সময়ে এসে দেখা গেছে, দেশের রাজনীতি ব্যবসায়ী ও আমলা নির্ভর হয়ে পড়েছে। রাজনীতি আর রাজনীতিকদের হাতে থাকেনি। একবার যদি গণতন্ত্রের চালিকাশক্তির হাতবদল হয় অর্থাৎ ব্যবসায়ী ও আমলাতন্ত্রের হাতে জিম্মি হয়ে যায় তখন গণতন্ত্রের পরিছন্ন চেহারা আর থাকে না। রাজনীতিকদের সাথে জনগণের যে সম্পর্ক থাকে, সেটা আমলা ও ব্যবসায়ীদের সাথে থাকে না। তখন গণতন্ত্র জনবিছিন্ন হয়ে পড়ে। ফলে গণতন্ত্রের সংকট আরও প্রসারিত হয়। যেসব দেশে বেসামরিক একনায়কতন্ত্র আছে, সেখানেও নিয়মিত নির্বাচন হয়। জনগণের মতামতকে সহিংসভাবে দমনের চেষ্টাও করা হয়। অনেক সময় গণতান্ত্রিক সরকারের চরিত্র দেখে অনেক সামরিক শাসকও লজ্জা পায়। এধরনের কতৃত্ববাদী সরকার ক্ষমতায় থাকলে নির্বাচনে ভোটার অংশগ্রহণ কমে যায়। সরকার হয়ে যায় একদলীয়। এরকম পরিস্থিতিতে মানুষ মত প্রকাশে ভয় পায়। তখন মানুষ নিরাপত্তার ঝুঁকিতে ভোগে। এসময় দেশে পণ্যমূল্যের দাম বেড়ে যায়। ক্ষমতা হারানোর ভয়ে থাকে সরকার। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সরকার মামলা-হামলার মাধ্যমে বিরোধী মতকে দমন করার চেষ্টা করে।

গণতন্ত্রের মৌলিক বিষয় হলো মানুষের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করা। যাতে মানুষ উৎসবমুখরভাবে ভোট দিতে পারে। ১৯৯০ সালে তিন বিরোধী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের ৮ দল, বিএনপির ৭ দল এবং বাম ফ্রন্টের ৫ দলীয় জোটের যৌথ ঘোষণায় নিরপেক্ষ তত্তাবধায়ক সরকারের রূপরেখার বিশদ উল্লেখ করা হয়। সম্মিলিত বিরোধী দলগুলোর মনোনীত ব্যক্তি হিসেবে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের কাছে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে তত্তাবধায়ক সরকার গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। কোনো সাংবিধানিক সংশোধনী ছাড়াই ১৯৯০ সালে তত্তাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়। কারণ, সময়ের স্বল্পতার কারণে সংসদ অধিবেশন আহবান সম্ভব ছিল না। সেই সময়ে সকল মানুষের বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের প্রতি সমর্থন ছিল, তার বৈধতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠেনি।

সর্বপ্রথম জামায়াত এবং তারপর আওয়ামী লীগ ১৯৯৩ সালে তত্তাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত বিল সংসদ সচিবালয়ে পেশ করে। এতে বলা হয়, জাতীয় নিবার্চনকে অবাধ ও নিবার্চনের সামগ্রিক প্রক্রিয়াকে ক্ষমতাশীন দলের প্রভাবমুক্ত করার জন্য তত্তাবধায়ক সরকারের বিধান সংবিধানে সংযোজন করা উচিত। কিন্তু বিএনপি সরকার প্রথম থেকেই এ দাবি অসাংবিধানিক বলে প্রত্যাখ্যান করে। অবশেষে বিএনপি সরকার বিরোধীদলের তুমুল আন্দোলনের মুখে ১৯৯৬ সালের ২৭ মার্চ আইনটি জাতীয় সংসদে পাস করে নেয়। মূলত ১৯৯১ সালেই রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার কারণেই সংবিধানে আইনী প্রক্রিয়ায় নির্দলীয় তত্তাবধায়ক সরকারের অধীনে চারটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন যথা ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত হয়। দুঃখজনক হলো, তত্তাবধায়ক সরকারের জন্য যারা বিএনপি সরকারের (১৯৯১-১৯৯৬) বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে, পরবর্তী সময়ে তারাই ক্ষমতায় এসে ২০১১ সালে ৩০ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্তাবধায়ক সরকারের আইনটি তুলে দেয়। এর পর থেকেই অবশিষ্ট জাতীয় নির্বাচনগুলোতে ব্যাপকভাবে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। খুনের সংখ্যাও ছিল অনেক। জন অগ্রহণযোগ্যতা ছাড়াও দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষক মহল এসব নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন বলে আখ্যায়িত করে।

বাংলাদেশে কার্যকর গণতন্ত্র আছে কিনা তা নিয়ে বিগত বহু বছর ধরে বিভিন্ন পশ্চিমা গণমাধ্যমে নানা প্রশ্ন তুলেছে। ২০১৮ সালের মার্চ মাসে জার্মান প্রতিষ্ঠান বেরটেলসম্যান স্টিফটুং তার এক প্রতিবেদনে বলে, বাংলাদেশ এখন স্বৈরশাসনের অধীন এবং সেখানে এখন গণতন্ত্রের ন্যূনতম মানদন্ড পযর্ন্ত অনুসরণ করা হচ্ছে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র সামিটে বাংলাদেশকে বয়কট করে। নিউইয়র্ক টাইমস ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে তাদের সম্পাদকীয়তে এ নির্বাচনকে প্রহসন বলে বর্ণনা করে। অন্যদিকে সিএনএন এ নির্বাচনকে বিতর্কিত হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, বাংলাদেশ বিপদজনক পথে হাঁটছে।

গণতন্ত্রের মূল কথা হচ্ছে, দেশে বিরাজমান সকল সমস্যা শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও আলোচনার মাধ্যমে সমাধান, যেটা ১৯৯১ সালে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্যের কারণে সম্ভব হয়েছিল। পুনরায় রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যমত্যের মাধ্যমে জাতীয় নিবার্চনকে যাতে অবাধ এবং ক্ষমতাশীন দলের প্রভাবমুক্ত করা যায়, সেরকম একটি সাংবিধানিক আইনী ব্যবস্থা আশু প্রয়োজন। তাহলেই গণতন্ত্র তার ঠিকানা খুঁজে পাবে বলে আশা করা যায়।

লেখক: গ্রন্থকার ও গবেষক।
harunrashidar@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন