শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অভ্যন্তরীণ

বৃহত্তর খুলনাঞ্চলের দোকানে ভেজাল ও নামসর্বস্ব ওষুধে সয়লাব

প্রকাশের সময় : ১৪ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আবু হেনা মুক্তি, খুলনা থেকে

জীবন রক্ষাকারী ওষুধ এখন মরণফাঁদ। র‌্যাব এবং জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা ভেজাল ও ফুড সাপ্লিমেন্ট ওষুধের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযান চালিয়ে জেল জরিমানা করলেও বৃহত্তর খুলনার সিন্ডিকেট চক্রের অপতৎপরতা থামেনি। অনেক নামিদামি কোম্পানির ওষুধও ভেজাল হচ্ছে। মাছ কোম্পানির আড়ালে খুলনায় আবিষ্কৃত হয়েছে ভেজাল ওষুধ তৈরির কারখানা। আর পাল্লা দিয়েও বাড়ছে ওষুধের দাম। এদিকে, নগরীর ক্লে রোডে হেরাজ মার্কেটের মেসার্স আলামিন ড্রাগ হাউজে অভিযান চালিয়ে আড়াই লক্ষাধিক টাকা মূল্যের সরকারি ওষুধ উদ্ধার করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার খুলনার ওষুধ প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ অভিযান চালানো হয়। উদ্ধারকৃত ওষুধের মধ্যে রয়েছে ১০ হাজার পিস সরকারি অ্যান্টিবায়োটিক, গ্যাস্ট্রিক ও হৃদরোগসহ বিভিন্ন রোগের ওষুধ এবং ভারত থেকে আমদানিকৃত নিষিদ্ধ যৌন উত্তেজক ওষুধ। ড্রাগ সুপার মাহমুদ হোসেন জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে নগরীর হেরাজ মার্কেটের মেসার্স আলামিন ড্রাগ হাউজে অভিযান চালানো হয়। এ সময় উক্ত দোকান থেকে অবৈধভাবে রক্ষিত ১০ হাজার পিস সরকারি অ্যান্টিবায়োটিক, গ্যাস্ট্রিক ও হার্টসহ বিভিন্ন রোগের ওষুধ এবং ভারত থেকে আমদানিকৃত নিষিদ্ধ যৌন উত্তেজক ওষুধ উদ্ধার করা হয়। যার আনুমানিক বাজার মূল্য আড়াই লক্ষাধিক টাকা। উদ্ধারকৃত ওষুধের জব্দ তালিকা ঢাকায় ওষুধ প্রশাসনের মহাপরিচালকের নিকট পাঠানো হবে। সেখান থেকে অনুমতি আসার পর খুলনায় মামলা করা হবে। “রিকশা চালিয়ে এত কষ্ট করে আয় করে ঠিকমত বাজার ও মাছ না কিনে ঔষুধ কিনি। কিন্তু তা ভেজাল শুনে মনের কষ্ট রাখার জায়গা নেই।” অত্যন্ত আক্ষেপের সাথে সংবাদকর্মী পরিচয় পেয়ে অভিযোগ করলেন চুকনগরের রিকশাওয়ালা মুনসুর আলী (৫৬)। কাঁচা-পাকা দাড়ির শীর্ণ কায়ার এই খেটে খাওয়া রিকশাওয়ালার মনের প্রশ্ন যে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে আয় হয় তা দিয়ে বৃদ্ধা মাতা ও নিজের অসুস্থ স্ত্রীর জন্য কেনা ওষুধগুলো কি ভেজাল না আসল। রোগ নির্মূলের বদলে সে আরো আক্রান্ত হচ্ছে কিনা জানেনা। মেয়াদউত্তীর্ণ ওষুধ খাচ্ছে কিনা বোঝে না। এমনই লোকের সংখ্যা অসংখ্য। সম্প্রতি খুলনায় ভেজাল ও মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ আটক করে নষ্ট করার ঘটনা শুনে অসংখ্য মানুষের মনের মাঝে এমনই প্রশ্ন আবার জেগেছে। এছাড়া খুলনার বিশিষ্ট শিল্পপতি কাজী শাহনেওয়াজের মাছ কোম্পানির আড়ালে ভেজাল ওষুধ তৈরির কারখানা যেন মানুষকে রীতিমত ভাবিয়ে তুলেছে। সবার একই প্রশ্ন ওষুধ নামে আমরা কী খাচ্ছি। সূত্রমতে, বৃহত্তর খুলনাঞ্চলের কয়েক হাজার ওষুধের দোকান এবং কয়েক শত হাতুড়ে ডাক্তার রয়েছে। বহু গ্রামে-গঞ্জে মুদিখানা দোকানে ওষুধ বিক্রি হয়। শহরে ওষুধের দোকানে সেলসম্যান থাকতে থাকতে গ্রামে এসে ডাক্তার সেজে চেম্বার খোলে। চেম্বারে রোগী দেখার পাশাপাশি চলে দেশি-বিদেশি ওষুধ বিক্রি। প্রেসক্রিপশন ছাড়া হরহামেশা চলছে ওষুধের বেচা-কেনা। মেয়াদ উত্তীর্ণ এবং ভেজাল ওষুধে সয়লাব করেছে বৃহত্তর খুলনাঞ্চলের বিভিন্ন দোকান। ভারতীয় ফুড সাপ্লিমেন্ট নিষিদ্ধ ওষুধ চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে দেদার। আর এসব দেখভালের জন্য খুলনা ওষুধ প্রশাসনের চারজন কর্মকর্তা-কর্মচারী দিয়ে যে কর্মকা- চালানো হচ্ছে তাতে জনস্বাস্থ্য রীতিমত হুমকির সম্মুখীন। মাত্র চার- পাঁচজন লোকবল দিয়ে এই বিপুলসংখ্যক ওষুধের দোকান এবং জীবন রক্ষাকারী এই কর্মকা-ের মনিটরিং করা আদৌ সম্ভব নয়। সূত্রমতে, সম্প্রতি খুলনার প্রাণকেন্দ্রে গড়ে ওঠা পাইকারি ওষুধের বৃহৎ বাজার হেরাজ মার্কেটে বিভিন্ন সময় কয়েকবার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট অভিযান চালায়। অভিযানে জব্দকৃত বিপুল পরিমাণ বিভিন্ন ধরনের ওষুধ আগুনে পুড়িয়ে বিনষ্ট করা হয়। অননুমোদিত এবং মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ রাখার অভিযোগে হেরাজ মার্কেটের বেশ কয়েকটি দোকানে কয়েকবার লক্ষাধিক টাকা জরিমানা করা হয়। অভিযানে হেরাজ মার্কেটের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থেকে বিপুল পরিমাণ মেয়াদ উত্তীর্ণ দেশি-বিদেশি ওষুধ ও সিরাপ এবং বিভিন্ন মলম জব্দ করা হয়। এছাড়া ওষুধ কোম্পানি থেকে চিকিৎসকদের দেয়া বিভিন্ন স্যাম্পল এবং যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট জব্দ করা হয়। জব্দকৃত সকল ওষুধ পুড়িয়ে বিনষ্ট করা হয়। স্বনামধন্য এই ওষুধ মার্কেটের যদি এ অবস্থা হয় তাহলে শহর-বন্দর-গ্রামেগঞ্জের ওষুধের দোকানের কী অবস্থা এমন প্রশ্ন শুধু রিকশাচালক মুনসুর আলীর নয়। এ প্রশ্ন এ অঞ্চলের আমজনতার। কারণ এমন কোনো পরিবার নেই যেখানে ওষুধের প্রয়োজন নেই। জীবন রক্ষাকারী ওষুধ যেন তাদের জীবনে ব্যুমেরাং না হয় এমন নিবেদন সংশ্লিষ্টদের। ওষুধ প্রশাসনে জনবল সংকটের কারণে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী দিনের পর দিন চালিয়ে যাচ্ছে অবৈধ, ভেজাল ও নাম সর্বস্ব ওষুধ কেনাবেচা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ফুড সাপ্লিমেন্ট বিক্রি করেও জনসাধারণের সাথে প্রতারণা করা হচ্ছে। এসব অবৈধ ব্যবসার সাথে ওষুধ ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির কোনো কোনো নির্বাচিত প্রতিনিধিও জড়িত বলেও অভিযোগ রয়েছে। যদিও বিসিডিএস’র কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে সম্প্রতি লিফলেট বিতরণ করে বলা হয়েছে ‘নকল ওষুধ প্রস্তুতকারক ও বিক্রেতা দেশ ও জাতির শত্রু, এদের ধরিয়ে দিন, সমিতিকে খবর দিন।’ ওষুধ প্রশাসনের জনবল সংকট কাটিয়ে তুলতে বর্তমান জেলা প্রশাসন ও র‌্যাব তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সূত্রমতে, বৃহত্তর খুলনাঞ্চলের বিভিন্ন ওষুধ বাজারে প্রায় অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠানের ৩ শতাধিক ফুড সাপ্লিমেন্ট আইটেম রয়েছে। যা রোগীদের প্রভাবিত করে বেশি দামে ওষুধ হিসেবে বিক্রি করা হয়। অনেক নামিদামি ডাক্তাররা ইদানীং ব্যাপকহারে প্রেসক্রিপশনে ফুড সাপ্লিমেন্ট লিখছেন। খুলনার বাজারে কেলসিম্যাগ, ওলিগো, কেয়ার, ওভাকেয়ার, গোল্ডকেয়ার, লিবেরিল, প্রেগনাকেয়ার, প্রিসজেল, হাইলন, এব্যানা, বিয়ন, ক্যাসপো, ভিএম ক্যাল, ভিএম-৩২, স্টিমুলিন এক্স, এসপি গোল্ড, প্রিমা-১০০০, মেগা-৩, গিংগুবা-১০০, বনক্যাল-ডি, অস্টিওমিন, ভিটা এক্সএল, অ্যামাইনো এনার্জি, সি-জয়েন্টিন, বোন মিল, ইপো, এস্টাভিট, সি-ক্যাল পাস, প্রোবায়েটিক-৪, এনডি ক্যাল, অর্থপাস, বনগার্ড, ওনিক্স, রক্সেন, বিলোবা পাস, বোন ডি এস, সিনো-ই, জয়েন্ট বিল্যাক্স, ওমাল, জেলপাস, ইভোনিয়া, মাল্টিজেন, এসডি পাস, স্টেনিন ই, বি-গোল্ডসহ প্রায় ৩শ’র মতো আইটেম পাওয়া যাচ্ছে। আর ওষুধের বাজারে এখন নানা আয়ুর্বেদীক ব্যানারে যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট ও সিরাপ বিক্রি হচ্ছে। গ্যাসের ট্যাবলেট বিক্রি হচ্ছে নাম না জানা কোম্পানির নামে। আদৌ এ ওষুধে কোনো কাজ হয় কিনা তা জানা নেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন