শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

উপ সম্পাদকীয়

মার্কিন নির্বাচন থেকে আমরা যা শিখতে পারি

প্রকাশের সময় : ১৪ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আবদুল আউয়াল ঠাকুর
ইতিহাস সৃষ্টির হাতছানি দিয়ে সেখান থেকে ছিটকে পড়লেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন ইতিহাসে তার একটি অবস্থান নিশ্চিত করেছেন। ফলাফলের আগ মুহূর্ত পর্যন্তও এটা কেউ অনুমান করেনি যে তিনি হেরে যাবেন। অধিক ভোট পেয়েও ‘কৌশলী’ ভোটে তিনি হেরেছেন। সে কারণে তার পরাজয় তার সমর্থকদের মধ্যে বেদনার সৃষ্টি করেছে। ক্ষুব্ধ করে তুলেছে তাদের। ফলাফল হয়তো কষ্ট দিয়েছে। সেখানে নতুন প্রশ্ন উঠেছে নির্বাচনী পদ্ধতি নিয়ে। এমনকি স্বাধীনতার বিষয়টিও নতুন করে উঠে এসেছে। পরাজিত হিলারি নিজেই বলেছেন, আমি দুঃখিত। আমরা নির্বাচিত হতে পারিনি। এই কষ্ট দীর্ঘদিন থাকবে। তবু ফল মেনে নিয়ে আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। নির্বাচনে অভাবনীয় জয়ের পর ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজয়ী ভাষণে বিভক্তি ভুলে মার্কিনিদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। একই সঙ্গে আমেরিকাকে সবার উপরে রাখার অঙ্গীকার করেছেন। বাস্তবত বিজয়ী হওয়ার মধ্য দিয়ে ট্রাম্প যে কেবল নতুন ইতিহাস তৈরি করলেন তা নয় বরং তিনি বিশ্ব রাজনীতির জন্য নতুন কিছু বার্তাও পৌঁছে দিয়েছেন। প্রাইমারি নির্বাচনে যেমন রিপাবলিকান পার্টির অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে হারিয়ে দলের মনোনয়ন পেয়েছিলেন, তেমনি নির্বাচনেও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজনকে হারিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, ট্রাম্পের বিরুদ্ধে সমালোচনা কেবল বিরোধী দলেই সীমাবদ্ধ ছিল না, নিজ দলের অভ্যন্তরেও অনেকে তাকে সমর্থন দেননি। তার বিরুদ্ধে নানা ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন। বলা হয়েছে, ১৯৬৪ সালের পর এই প্রথম কোনো প্রার্থী দলের অংশকে পাশ কাটিয়ে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিলেন। অন্যদিকে ১৯৪০ সালের পর এই প্রথম কেউ সরকারি কিংবা সামরিক কাজের অভিজ্ঞতা ছাড়াই দলীয় প্রার্থী মনোনীত এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। সেই সাথে এ কথাও সত্যি যে, মার্কিন মিডিয়ার একটি বড় অংশ হিলারির কেবল সমর্থকই নয়, যথারীতি ট্রাম্পকে তুলাধোনা করেছিল। কার্যত নির্বাচনের ফলাফলের আগ পর্যন্ত মনে হয়েছিল, সময়টা হিলারির, সময়টা ডেমোক্রেটদের। এর অন্যতম কারণ বারাক ওবামা। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। এক মহাবিপর্যয়কর বাস্তবতায় মার্কিন জনগণ তার হাতে দায়িত্ব তুলে দিয়েছিল। শুধু একবার নয়, পরপর দু-দুবার তার প্রতি আস্থা স্থাপন করেছিল। হতে পারে এক নতুনতর বিশ্ব গড়ে তুলতে তার প্রয়াসের যে উত্তরাধিকারী তাকে নির্বাচিত করতে চেয়েছিলেন। বিশ্ববাসী হয়তো সে ব্যাপারে ইতিবাচক ধারণা নিলেও মার্কিন জনগণ তা সঙ্গত মনে করেনি। গণতান্ত্রিক রীতিনীতি অনুযায়ী যেহেতু প্রতিটি দেশের জনগণই হচ্ছে তাদের নেতা নির্বাচনের মালিক-মোক্তার তাই মার্কিন জনগণ যা তাদের জন্য উত্তম মনে করেছে সেটাই বাস্তব, সেটাই চূড়ান্ত।
ডেমোক্রেটিক পার্টির আরেকজন জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট ছিলেন বিল ক্লিনটন। মার্কিন মুলুকে তাকে কম বয়সী প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনে করা হতো। তার যুদ্ধবিরোধী অবস্থান এবং নীতি তাকে এতটাই জনপ্রিয়তা দিয়েছিল যে মনে করা হতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান অনুমতি দিলে তিনি যদি আরেকবার দাঁড়াতেন তাহলে হয়তো নির্বাচিত হতেন। তার এত বিপুল জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও তিনি ডেমোক্রেটদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারেননি। মার্কিন জনগণের ভোটে সে সময়ে যিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন পরবর্তী ইতিহাসের আলোচনায় তিনি একজন ধিকৃত ব্যক্তি হিসেবেই পরিচিত। রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে অসত্য তথ্যের ওপর দাঁড়িয়ে বিশ্ব সংস্থাসমূহের আবেদন অগ্রাহ্য করে তিনি আক্রমণ করেছিলেন ইরাক-আফগানিস্তান। এর পরবর্তী ইতিহাসের আলোচনা অপ্রয়োজনীয়। শুধু এটুকুু বলা দরকার, মার্কিন জনগণের অভ্যন্তরীণ সংকট মেটাতে ব্যর্থ হয়ে তিনি আগ্রাসন চালিয়েছিলেন মার্কিনিদের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতে। এতে ফল হয়েছে ভিন্নরূপ। যুদ্ধে নিহত-আহত মার্কিনিরা তাদের স্বজনদের জন্য যে আর্তি করেছে তার পরিণতিতেই নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী বরাক ওবামা নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি যতটা পেরেছেন অথবা বলা যায় প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও যতটা সম্ভব তিনি মার্কিন অর্থনীতিকে ইতিবাচকতায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন। সে কারণেই হয়তো পরপর দুবার তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার আন্তরিকতা নিয়ে তেমন কোনো প্রশ্ন দেখা দেয়নি। কিন্তু উত্তরাধিকার তিনি দল থেকে নির্বাচিত করতে পারেননি। হিলারির এই পরাজয়ের কথা বাংলাদেশের চায়ের আড্ডা থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক মাধ্যমেও উঠে এসেছে। কান পাতলেই শোনা যায় একটি কথা। নিউইয়র্ক বা ওয়াশিংটন দিয়ে আমেরিকাকে বিচার করা ভুল। আমেরিকার একটি বৃহৎ অংশ এখনো নারীকে সর্বোচ্চ পদে দেখতে আগ্রহী নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মার্কিন নাগরিক যে এখনো রক্ষণশীল হিলারির পরাজয়ে সে বিষয়টি আবারো সামনে এসেছে। শুধু নারী প্রার্থী নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও তাদের রক্ষণশীলতার প্রকাশ ঘটেছে। একজন নারীকে ভোট দেয়া না দেয়াকে যদি রক্ষণশীলতা এবং তথাকথিত প্রগতিশীলতা সূচক হিসেবে বিবেচনা করতে হয় তাহলে সত্যিই ভিন্ন কিছু ভাবার রয়েছে। বর্তমান সময়ের দিকে যদি তাকানো যায় তাহলে দেখা যাবে, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মান, ইতালি, ব্রাজিলসহ বিশ্বের সর্বত্রই প্রায় নারী নেতৃত্ব রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করছে। এশিয়াতে তো কথাই নেই। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন, মিয়ানমারসহ এ অঞ্চলের বহু দেশে নারী নেতৃত্ব রয়েছে। ভোটাধিকার প্রয়োগের বিবেচনায় কখনই জেন্ডার ইস্যু বড় হয়ে দেখা দেয়নি। একটা সময় ছিল যখন হয়তো এসব বিবেচনাকে বিশেষভাবে দেখা হতো। সাবেক পাকিস্তান আমলে ১৯৬৪ সালে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হয়েছিলেন কায়েদ-ই-আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বোন মিস ফাতেমা জিন্নাহ। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জেনারেল আইয়ুব খান। তিনি অবশ্য ক্ষমতায় থেকেই নির্বাচন করেছিলেন। ওই নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়েছিল মার্কিন পদ্ধতিতে। অর্থাৎ পরোক্ষ ভোটে। ওই নির্বাচনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ফাতেমা জিন্নাহ অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন। তার জনপ্রিয়তা বা পপুলার সমর্থন এতটাই তুঙ্গে উঠেছিল যে, মনে করা হয়েছিল তার প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। সে সময়ে আওয়ামী লীগ তাকে সমর্থন করেছিল। শেষ পর্যন্ত তিনি হেরে যান। তার পরাজয়ের পরও সে সময়ে বলা হয়েছিল, পাকিস্তানের জন্য একজন নারী প্রেসিডেন্ট মানায় না। অর্থাৎ নারী হওয়ার কারণেই নাকি তিনি পরাজিত হয়েছিলেন। ১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ লেগে গেলে লোকেরা বলাবলি করেছিলÑ দেখ, এখন আইয়ুব খানের কত প্রয়োজন। যাই হোক যদি এটা হয়ে থাকে যে, যারা ফাতেমা জিন্নাহর নির্বাচনের বিরাধিতা করেছিলেন তারা জানতেন যে শীঘ্রই ভারতের সাথে একটি যুদ্ধ হবে এবং সে যুদ্ধে জেনারেল আইয়ুবের ভীষণ প্রয়োজন তাহলে ভিন্ন কথা। সে বিবেচনায় যদি এবারের মার্কিন নির্বাচনকে দেখা যায় তাহলে হয়তো এমনটা ধারণা করা যেতে পারে, বিশ্ব কি আরো একটা বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়তে যাচ্ছেÑ যে জন্য কোনো কোনো মহল নারী ছুতা তুলে ট্রাম্পকে নির্বাচিত করে উসকে দিতে চেয়েছে? এ প্রশ্নের এখনই উত্তর পাওয়া যাবে না। আরো একটু সময় নেবে। ট্রাম্পের জয়ের পর বিশ্ব নেতৃবৃন্দের যারা অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়েছেন তাদের বাইরে ইন্দোনেশিয়ার শীর্ষ মুসলিম সংগঠনের মুখপাত্র সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, মার্কিন নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় ইসলামী বিশ্বের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে। ইন্দোনেশিয়ার ওলামা কাউন্সিলের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা দ্বীন শামসুদ্দীন জাকার্তায় সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প ইতোপূর্বে মুসলিমবিদ্বেষী একাধিক নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। এটি নির্বাচনের সময়ই আলোচিত হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের শিবির নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার মুখেই এটা মনে করা হয়েছিল যে, মার্কিন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটা ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। ট্রাম্পের সাথে যারা রয়েছেন তাদের একটি বড় অংশ হচ্ছে বিশ্ব সংঘাতের মূল হোতা ইহুদি। তাদের প্রধান স্বার্থের মধ্যে রয়েছে ইসরাইল। অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ। আজকের বাস্তবতা হচ্ছে, তথাকথিত সন্ত্রাস ও জঙ্গি তকমার কারণে সারা বিশ্বেই মুসলমানরা এক ধরনের নির্যাতনের শিকার। বর্ণবাদী হামলার পাশাপাশি ধর্মীয় কারণেও আজ বিশ্বের মুসলমানরা মানবাধিকার বঞ্চিত। ইরাক বা আফগানিস্তানের দ্বারা আমেরিকা আক্রান্ত হতে পারে এমন ধারণা বোধহয় পাগলেরও করার কোনো সুযোগ নেই। গোটা ইরাক দখল করে চষে বেড়ানোর পরও সেখানে সভ্যতার জন্য বিপর্যয়কর কোনো অস্ত্রের সন্ধান পাওয়া যায়নি। প্রমাণের অযোগ্য অভিযোগে আটক থাকা বর্বর নির্যাতনের শিকার গুয়েন্তানামো বে কারাগার থেকে মুক্তি দিতে হয়েছে অনেককেই। বন্দী শিবিরটি বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্তও হয়েছে। যাই হোক, ইরাক-আফগানিস্তান যুদ্ধের ক্ষত এখনো শুকায়নি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে যদি আবার একটি নতুন যুদ্ধের পাঁয়তারা করা হয় তার যে কি মারাত্মক পরিণতি হবে বোধকরি তা নিয়ে বিশ্বের শান্তিবাদী মানুষের এখনই ভাবা জরুরি। তাই বলা যায়, কেবল নারী বিবেচনায় যদি হিলারিকে ভোট না দেয়া হয়ে থাকে তাহলে তাকে সংরক্ষণবাদিতা না বলে হীনমন্যতাই বলা উত্তম। এতে মূলত মার্কিন সমাজ ও অর্থনীতির ভোগবাদী লাম্পট্যেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। একটি আদর্শহীন সমাজের নগ্নতাই ফুটে উঠেছে। এটা সভ্যতার কলঙ্ক।
যেমনটি বলা হয়েছে, সরকারি কিংবা সামরিক কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই এই প্রথম একজন ব্যক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হলেন। যোগ্যতা-অযোগ্যতার আলোচনার বাইরেও যে কথাটি এখানে বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে তা হলো, তার সম্পর্কে বলা হয়েছে, ধনকুবের ব্যবসায়ী থেকে প্রেসিডেন্ট। নির্বাচনের সময়ও বলা হয়েছিল, তার সাথে রয়েছে ডলার। তার ব্যক্তিগত পরিচয়ে বলা হয়েছে, সম্ভবত ডোনাল্ড ট্রাম্পই একমাত্র ব্যক্তি যিনি ব্যবসায়ী হিসেবে সরাসরি হোয়াইট হাউসের দখল নিলেন। তিনি রাজনীতির ধারেকাছেও হাঁটেননি। কখনো রিপাবলিকান আবার কখনো ডেমোক্রেট পার্টির সমর্থক ছিলেন। চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্টের সামরিক কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তিনি সরাসরি রাজনীতি থেকে এসেছেন। অবশ্য তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার ছাপ তিনি ইতোমধ্যেই রেখেছেন। ব্যবসাকে যদি অর্থনীতির বিবেচনায় দেখা যায় তাহলে অবশ্যই বলতে হবে, রাজনীতি আর অর্থনীতি পরস্পরের হাত ধরে চলে। এদিক থেকে বলা যায়, রাজনীতির মধ্যেই অর্থনীতি থাকছে। একটি দল কী ধরনের অর্থনীতির চর্চাকে পছন্দ করে তার ওপরই নির্ভর করে তার শাসন প্রক্রিয়ার বিন্যাস। আধুনিক অর্থনীতির জনক বলে পরিচিত এ্যাডম স্মিথ মনে করেন, বর্তমান বিশ্বে রাজনৈতিক যুদ্ধ করে দেশ জয়ের কোনো প্রয়োজন নেই। বরং অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদই এখন উত্তম পন্থা। গোটা বিশ্বকে দখলে রাখতে এই তত্ত্বের কোনো তুলনা হয় না। বিশ্বব্যাপী যে নয়া সা¤্রাজ্যবাদ বা উপনিবেশবাদ গড়ে তোলা হয়েছে তার ভিত্তি এটাই। এই বিবেচনায় যদি বাংলাদেশের দিকে তাকানো যায় তাহলে দেখা যাবে, রাজনৈতিক সমর্থনের নামে বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভারতনির্ভর। এই অঞ্চলে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যে অধিপত্য বিস্তার করেছিল তারাও ছিল ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ীরা কতটা সার্থক রাজনীতিবিদ তা এখনো প্রমাণিত সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তবে এ কথা সর্বজন সুবিদিত যে, একজন ব্যবসায়ীকে প্রধানত তার ব্যবসার প্রতি নজর দিতে হয় বিধায় তার কাছে কল্যাণ মানে হচ্ছে অর্থের প্রতিপত্তি অর্জন। ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) রাষ্ট্র ক্ষমতা পাওয়ার পর ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছিলেন। এখানেই নীতি-নৈতিকতার একটি বড় প্রশ্ন রয়েছে। বলা হয়েছে, ডোনাল্ড ট্রাম্প মুক্তবাজারবিরোধী একজন রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী। বর্তমান সময়ে মার্কিন অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে চীনা অর্থনীতি। চীনা ব্যবসায়ীরা বলতে গেলে দুনিয়া জুড়ে রেখেছে। ইরাক-আফগানিস্তানে মার্কিন হামলার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মূলে ছিল রিয়েল এস্টেট বাণিজ্য। যাই হোক, মার্কিন অর্থনীতির পরিণতি প্রাথমিকভাবে তারা ভোগ করলেও এর সাথে দুনিয়াজোড়া সম্পর্ক রয়েছে ডলারের। সাধারণভাবে মার্কিন জিডিপিকে সর্বাধিক মনে করা হলেও মার্কিন অর্থনীতিতে চীনাদের রয়েছে ব্যাপক ভূমিকা। এবারের নির্বাচনেও এসব প্রসঙ্গ যে ওঠেনি তা কিন্তু নয়। মার্কিন জনগণকে এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা অবহিত করেছেন। তবে শেষ পর্যন্ত মার্কিন জনগণ ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নির্বাচিত করে যে নতুন বার্তা দিয়েছেন তার পরিণতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা হয়তো এক্ষুণি বলা যাবে না বা বলা সঙ্গতও হবে না। বিশ্লেষকগণও সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত টানতে নারাজ। কারণ তারা এর মধ্যে যদিও অনেক কিছু দেখছেন। কথা যাই হোক, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার দিক থেকে নবীন হওয়ার কারণেই ট্রাম্পকে অবশ্যই প্রশাসন তথা গোয়েন্দাদের ওপরই অধিকতর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হবে। এটিই বিপদের সবচেয়ে বড় দিক। কারণ মার্কিন প্রশাসনের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে সিআইএ। এই সংস্থায় ইহুদি প্রভাব নিয়ে ইতোমধ্যে এক ধরনের ঠা-া যুদ্ধ শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে থাকার কারণে বিষয়টি আগের অবস্থায় নেই। এই প্রভাবের মূল কারণ শুধু ফিলিস্তিন নয়. বরং আরো কিছু অন্তর্নিহিত বিষয় রয়েছে। দুনিয়াব্যাপী ইহুদি স্বার্থ রক্ষার্থে মার্কিন প্রশাসনকে ব্যবহারে ইহুদি কৌশলের অংশহিসেবেই এটা করা হয়ে আসছে। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা না থাকলে সূক্ষ্ম এ বিষয়ে নজর রাখা খুবই দু:সাধ্য। সেদিক থেকে যদি মার্কিন নির্বাচন বিবেচনা করা যায় তাহলে অবশ্যই বলতে হবে, বিশ্বে গুপ্তহত্যার মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। বিশ্ব রাজনীতিতে অনিশ্চয়তা এবং সংঘাত আরো মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে, যার প্রভাব অন্যত্র পড়তে বাধ্য।
হিলারির পরাজয়ের কারণ হিসেবে মেয়াদের বিষয়টিকেও দেখা হচ্ছে। অর্থাৎ দুই মেয়াদের বেশি কোনো দলকে ক্ষমতায় রাখার ইতিহাস মার্কিনিদের নেই। কে কতটুকু করতে পারছে তার একটা ব্যারোমিটার হিসেবে এই মেয়াদকালকে বিবেচনায় নেয়া হয়ে থাকলেও এটা বলতে হবে, ক্ষমতা দীর্ঘমেয়াদি করার একটা মারাত্মক বিপজ্জনক দিক রয়েছে। এটা বলা প্রয়োজন, যেসব বিবেচনা থেকে হিলারিকে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিল, হতে পারে, তার মধ্যেও হয়তো গলদ থাকতে পারে। সে সুযোগ হয়তো ট্রাম্প শিবির নিয়েছে। এ কথাও বলা দরকার, ইলেকটোরাল ভোট ও প্রত্যক্ষ ভোট এক নয়। সে কারণেই হয়তো জনমত জরিপের ফলাফলের সাথে মেলেনি। অথবা বিভ্রান্তি সৃষ্টির কৌশলও কোনো কোনো মহল নিয়ে থাকতে পারে। যাই হোক, এ কথা ঠিক যে, যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তা নিয়ে কোনো মহলের বিরোধ নেই। নির্বাচনের মাত্র কদিন আগে যে ট্রাম্প তাকে বিজয়ী ঘোষণা করতে বলেছিলেন, নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন এমনকি নির্বাচনে যার ছেলে কারচুপির সাথে জড়িত বলে ধরা পড়েছে তিনি বিজয়ী হওয়ার পর যেমনি নির্বাচন মেনে নিয়েছেন তেমনি যার বিজয় সম্পর্কে ভোট গ্রহণের আগ পর্যন্তও আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছিল সেই হিলারি পরাজিত হওয়ার পর ফলাফল মেনে নিয়েছেন। এই মেনে নেয়ার একমাত্র কারণ হচ্ছে নির্বাচনের ওপর আস্থা। যদিও এটি বলা হয়েছে যে, ইলেকটোরল পদ্ধতির মূলে ছিল কালোদের হঠানো। নির্বাচনী ব্যবস্থার আস্থার বিষয়টি বাংলাদেশের জন্যও খুব জরুরি। মার্কিন নির্বাচনের ফলাফলের পর নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে অভিনন্দন জানিয়েছেন দেশের সরকার, বিরোধী সকল মহলই। বাণীতে প্রধানমন্ত্রী আশা প্রকাশ করছেন, ট্রাম্পের বিজয় দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় স্বার্থের আরো উন্নয়ন এবং আগামী প্রজন্মের জন্য নিরাপদ বিশ্ব গড়ে তোলা ও শান্তিপূর্ণভাবে সমৃদ্ধি অর্জনে তার সাথে কাজ করতে তিনি তাকিয়ে আছেন। মার্কিন নির্বাচনের সূত্র ধরে আওয়ামী লীগের আরো কেউ কেউ কথা বলছেন। বোধকরি, দুই দেশের প্রকৃত সম্পর্কের উন্নয়নে আমাদের দেশেও একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। কেবলমাত্র গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হলেই তাকে সমমর্যাদার সরকার বলা যায়। অন্তত এতটুকু নিশ্চিত করতে যদি একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায় তাহলে সেটা হবে একটা বড় পাওয়া।
awalthakur@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন