ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ও নিউ মার্কেট এবং আশপাশের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দুইদিনের বেশী সময় ধরে চলা সংঘর্ষ ও উত্তেজনা সাড়ে চারঘন্টার ম্যারাথন বৈঠকে সুরাহা হয়েছে। গত বুধবার রাত ১২টায় সায়েন্সল্যাবে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের সভাকক্ষে শুরু হওয়া বৈঠকে ছাত্র, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, স্বরাস্ট্র - শিক্ষামন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি মিলিয়ে প্রায় ৪০ জন উপস্থিত ছিলেন। তর্ক-বিতর্ক, পাল্টাপাল্টি দাবি ও বাকবিতন্ডার শেষে সাড়ে চারঘন্টা পর ভোররাত সাড়ে চারটায় মিলেছে সমাধান। এরআগে সংকট নিরসনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ছাত্র ও ব্যসায়ীদের সঙ্গে দফায় দফায় কথা বলে তাদের এক টেবিলে বসার উদ্যোগ নিয়েছেন।
বৈঠকে ছাত্ররা ১০ দফা দাবিসহ দোকান কর্মচারীদের স্মার্ট আইডি কার্ড ও সিসি ক্যামেরা স্থাপনের প্রস্তাব উত্থাপন করলে নয়টি দাবি এবং অন্য প্রস্তাব পূরণ করার শর্তে তারা নমনীয় হয়েছে। সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়া কোনো ছাত্রকে হয়রানি না করতে পুলিশকে শর্ত দিলে পুলিশ তা মেনে নিয়েছে। ব্যবসায়ীরা সম্মিলিত কোর কমিটি গঠন, সহাবস্থান ও ছাত্রদের কাছ থেকে সহনশীল আচারণের প্রস্তাব দিলে এতেও সায় দিয়েছেন বৈঠকে উপস্থিত শিক্ষার্থী প্রতিনিধিরা। সংঘর্ষের ঘটনায় নিউমার্কেট থানায় মোট তিনটি মামলা হয়েছে। একটি নিহত নাহিদের বাবা এবং অপর দুটি দায়ের করেছে পুলিশ। মামলায় ২৪ জনের নাম উল্লেখসহ মোট ১২’শ জনকে আসামি করা হয়েছে।
বৈঠকে উপস্থিত প্রতিনিধি সূত্রে জানা গেছে, রাত সাড়ে ১২টায় শুরু হওয়া বৈঠকে এক এক করে যোগ দেয় ঢাকা কলেজের শিক্ষকদের ৫ সদস্যের প্রতিনিধি, নিউমার্কেট এলাকার বিভিন্ন মার্কেটের মালিক সমিতির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের ২০ জনের প্রতিনিধি, ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থীদের ৮ সদস্যের প্রতিনিধি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রনালয়-শিক্ষামন্ত্রনালয়ের উর্ধ্বতন দুই প্রতিনিধি, পুলিশের পক্ষে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (দক্ষিণ) মাহবুব আলম এবং একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি। শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) মহাপরিচালক ও ঢাকা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক নেহাল আহমেদ। শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি দল বৈঠকে যোগ দেয় সবার শেষে। তারা একটু দেরিতে আশায় আনুষ্ঠানিকভাবে বৈঠক শুরু করতে একটু দেরি হয় বলে জানা গেছে। বৈঠকের শুরুতেই আগে শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো উত্থাপিত হয়।
বৈঠকে উপস্থিত ঢাকা কলেজের শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ড. কুদ্দুস শিকদার বলেন, ছাত্রদের ১০ দফা বৈঠকের আগেই সংবাদ সম্মেলন করে জানানো হয়েছিলো। এরইপ্রেক্ষিতে বৈঠকের শুরুতেই এই ন্যাক্করজনক হামলার উস্কানিদাতা, ইন্ধনদাতা ও হামলাকারীদের তদন্ত সাপেক্ষে চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার কথা বলা হয়। ব্যবসায়ীরা কোনো দ্বিধা ছাড়াই শর্তটি মেনে নেয়। এরপর নিহত ও আহতদের আর্থিক সহায়তা, নিহতদের পরিবারকে সমবেদনা জানানো এবং শিক্ষক ও অ্যাম্বুলেন্সে হামলার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি তোল হয়। দোকানীদের আচরণগত সমস্যার কারণে বেশিরভাগ ঘটনার সূত্রপাত হওয়ায় সেটি সমাধানে কাউন্সিলিংয়ের উদ্যাগ, ক্রেতা হয়রানি ও ইভটিজিং বন্ধ করতে মনিটরিং করা ও সব কর্মচারীর স্মার্ট আইডি কার্ড নিশ্চিত করতে বলা হয়। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে সেজন্য শিক্ষক, ব্যবসায়ী ও পুলিশের সমন্বয়ে একটি কোর কমিটি করতে বলা হয়। ব্যবসায়ীরাও সহনশীল অবস্থা বজায় রাখতে বিভিন্ন দাবি তোলেন। একটা পর্যায়ে গিয়ে সব পক্ষই সমঝোতায় চলে আসলে বৈঠক শেষ করা হয়।
মিটিংয়ে উপস্থিত ঢাকা নিউমার্কেট মালিক সমিতির সভাপতি ডা. দেওয়ান আমিনুল ইসলাম শাহিন বলেন, সোমবার দিবাগত রাতে শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ী-কর্মচারীদের মধ্যে সংঘর্ষের পর মঙ্গলবার আবারো সংঘর্ষ শুরু হলে, আমরা বুঝতে পারি বিষয়টি বড় আকার ধারন করতে যাচ্ছে। সংঘর্ষ রক্তক্ষয়ী পর্যায়ে গেলে আমিসহ ব্যবসায়ীদের একটি দল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসায় গিয়ে দেখা করি। মন্ত্রী তখন আশ্বস্ত করেন, যেকোনোভাবেই হোক সংঘর্ষের ঘটনার অবসান করা হবে। পরে আমরা আবার মার্কেটে ফিরে আসি। বুধবার শিক্ষা উপ-মন্ত্রী মহিবুল হাসান নওফেল আমাকে দুইবার ফোন করেন এবং সমঝোতা করার অনুরোধ করেন। এরমধ্যে আমরা সংবাদ সম্মেলন করে দুঃখ প্রকাশ করলেও ছাত্ররা সেটি প্রত্যাখান করে বসে।
ফলে রাত ১২টায় ব্যবসায়ী মালিকদের প্রতিনিধি, ঢাকা কলেজের শিক্ষকদের প্রতিনিধি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রনালয় ও শিক্ষামন্ত্রনালয়ের প্রতিনিধি, শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে আলোচনা শুরু হয়। শুরুতেই শিক্ষার্থীরা এ ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে। আমরা দুঃখ প্রকাশ করেছি। মিটিংয়ের আগে শিক্ষার্থীরা যে ১০ দফা দিয়েছিলো, তার মধ্যে ৯টি দাবি আমরা মেনে নিয়েছি। শুধুমাত্র চন্দ্রিমা সুপার মার্কেট ও নিউ সুপার মাকের্টে ঢাকা কলেজের সম্পদ লিজ বাতিল করে ফিরিয়ে দেয়ার বিষয়টি যেহেতু মালিকপক্ষের কাজ নয়, এজন্য এটি আমরা এড়িয়ে গেছি। শিক্ষার্থীরাও বুঝতে পেরেছে, লিজের সম্পদ ফিরিয়ে দেয়ার বিষয়টি জটিল প্রক্রিয়া। এজন্য তারাও আর এ বিষয়ে আলোচনা বাড়ায়নি। আর তারা যে দাবিগুলো জানিয়েছে, এরমধ্যে অনেকগুলো দাবি ব্যবসায়ীদের দাবির সঙ্গেও মিলে যায়। তাই আমরা সহজেই সেগুলো মেনে নিয়েছি।
এক প্রশ্নের জবাবে ডা. দেওয়ান আমিনুল ইসলাম শাহিন বলেন, শিক্ষার্থীদের একটি বড় দাবি ছিলো ডিএমপির রমনা বিভাগের ডিসি, এডিসি ও ওসি প্রত্যাহার করা এবং শিক্ষার্থীদের উপর হামলাকারী পুলিশ সদস্যদের বিচার নিশ্চিত করা। কিন্তু এটি ব্যবসায়ীদের কোনো বিষয়টি। পুলিশের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত কর্মকর্তা তাদের আশ্বস্ত করেছেন, তদন্ত সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মিটিংয়ে উপস্থিত বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি এবং ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম আহŸায়ক মহিউদ্দিন শিকদার লিপু বলেন, ব্যবসায়ী ও ছাত্রদের মধ্যে কোনো সমস্যা হলে সেটি যেন সংঘাতের পর্যায়ে না যায়, সেজন্য কোর কমিটির মাধ্যমে সমাধানের দাবি তোলা হয়। পাশাপাশি এখানকার সব কয়টি মার্কেট এলাকা সিসি ক্যামেরার আওতায় আনতে বলা হয়। থানায় যে মামলাগুলো দায়ের করা হয়েছে, সুনির্দিষ্ট প্রমান ছাড়া যাতে কোনো ছাত্রকে হয়রানি করা না হয় সে বিষয়ে নিশ্চয়তা চাওয়া হয়। ব্যবসায়ী ও পুলিশ আমাদের সব দাবি মেনে নেয়ায় আমরা সমঝোতা করতে রাজি হয়েছি। শুধুমাত্র চন্দ্রিমা সুপার মার্কেট ও নিউ সুপার মাকের্টে ঢাকা কলেজের সম্পদ লিজ বাতিল করে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি থেকে আমরা আপাতত সরে এসেছি। কারণ এর পেছনে আইনগত বিভিন্ন জটিলতা রয়েছে। আমাদের অন্য দাবিগুলো পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করবে ব্যবসায়ীরা। আগামী একমাস বা দ্রæত সময়ের মধ্যে দাবিগুলো মেনে নেয়া না হলে আমরা পরবর্তীতে কি করবো সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবো।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) সাজ্জাদুর রহমান বলেন, বৈঠকে পুলিশের প্রতিনিধি হিসেবে একজন যুগ্ম কমিশনার উপস্থিত ছিলেন। নিউমার্কেট এলাকায় আইনশৃঙ্খরা বজায় রেখে সবকিছু যাতে সুন্দরভাবে চলে সেজন্য তিনি শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ীদের কাছে বিভিন্ন মতামত তুলে ধরেছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন