শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মুক্তাঙ্গন

ইসলামে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গুরুত্ব

প্রকাশের সময় : ১৬ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আমিনুল ইসলাম হুসাইনী

মানব জাতির ঊষালগ্ন থেকে এ পর্যন্ত এ পৃথিবীতে আল্লাহ প্রদত্ত কিংবা মানবসৃষ্ট যতগুলো ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেসব ধর্মসমূহের মধ্যে বর্তমানকালে কেবলমাত্র ইসলামই একমাত্র ধর্ম, যা মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে ধর্ম হিসেবে মনোনীত হয়েছে। তাই সত্য সন্ধানীগণ আজও একের পর এক ইসলামের শীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিয়ে পুলকিত হচ্ছেন। কারণ তারা জানেন, ইসলাম শান্তির ধর্ম, ইসলাম মানবতার ধর্ম। সাম্য, সম্প্রীতি ইসলামের অনন্য বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এক শ্রেণীর লোক আছে যারা ইসলামের এই অব্যাহত বিজয়কে মেনে নিতে পারছে না। বিশ্বব্যাপী ইসলামের এই বিজয়ই যেন তাদের গাত্র জ্বলার অন্যতম কারণ। আর সে জন্যই তারা একের পর এক গর্হিত কর্মকা-ের মাধ্যমে ইসলামের অবমাননা করে চলছে। তাদের এই হীন কর্মকা- চলছে বিশ্বময়। তারা কখনো নাটক-সিনেমায় মহান আল্লাহকে কটুক্তি করে, কখনো কার্টুন প্রদর্শনে ইসলামের প্রাণ পুরুষ নবী মুহাম্মাদ (সা.)কে ব্যঙ্গ করে। আবার কখনো ইসলামের প্রাণকেন্দ্র পবিত্র কাবাকে অবমাননা করে তাদের অপকর্মের ধারাকে অব্যাহত রাখছে। ফলে প্রতিটি দেশের সমাজ ব্যবস্থায় বিরাজ করছে সাম্প্রদায়িক অস্থিতিশীলতা। কিন্তু এসব দেখার যেন কেউ নেই। বরং এই সাম্প্রদায়িকতার মধ্য দিয়েই এক শ্রেণির মানুষ আছে যারা তাদের নিজ স্বার্থ উদ্ধারে কুণ্ঠাবোধ করে না।
অথচ মানবতার ধর্ম ইসলাম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে সবসময়ই শ্রদ্ধাশীল। ইসলাম নিজ অবমাননাকে যেমন বরদাশত করে না, তেমনি অন্য কোনো ধর্মের অবমাননাকেও পছন্দ করে না। ইসলাম তার অনুসারীদের সংকীর্ণ মানসিকতা পরিহার করে উদারতার শিক্ষা দেয়। ইসলামের প্রাণ পুরুষ নবী মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন, “যারা মানুষকে সাম্প্রদায়িকতার দিকে ডাকে, যারা সাম্প্রদায়িকতার জন্য যুদ্ধ করে এবং সাম্প্রদায়িকতার জন্য জীবন উৎসর্গ করে তারা আমাদের সমাজভুক্ত নয়।” (আবু দাউদ, হাদিস : ৫১২৩)
তবে সম্প্রতি ব্রাহ্মনবাড়িয়ার নাসিরনগরে বিশ্ব মুসলিমের হৃদয়স্পন্দন পবিত্র কাবাকে অবমাননা করার ফলে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর যে অমানবিক আচরণ করা হয়েছে তা সত্যিই নিন্দনীয়। যারা এহেন কর্মকা- করেছে ইসলামে যে তাদের কোনো স্থান নেই এ কথা স্পষ্ট। কেন না মহান আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা মুসলমানদের হুঁশিয়ার করে বলে দিয়েছেন, “আল্লাহকে ছেড়ে যাদেরকে তারা (মূর্তিপূজক) ডাকে, তাদেরকে তোমরা গালি দিও না। তাহলে তারা সীমালংঘন করে অজ্ঞানতাবশত আল্লাহকেও গালি দিবে” ( সূরা : আন‘আম, ১০৮)।
হ্যাঁ এ কথা ঠিক যে, ইসলাম মূর্তিপূজা অপছন্দ করে, কিন্তু তাই বলে অন্যের পূূজায় ব্যাঘাত ঘটানোর আদেশ করবে এমন কথা ইসলামের কোথাও নেই। ইতিহাস তালাস করলে দেখা যায়, ইসলাম বিজয়ী অবস্থায়ও তার অনুসারী অর্থাৎ মুসলিম শাসকগণ অমুসলিমদের অধিকার সংরক্ষণ করে গেছে। ভারতবর্ষে আটশত বছর এবং স্পেনে আটশ বছর মুসলমানদের শাসন চালু ছিল। অথচ ইসলামী শাসনের পতনের পর এই দুটি দেশে অমুসলিমদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বহাল রয়েছে এখনো। এ থেকেও কি প্রমাণিত হয় না যে, মুসলিম শাসকরা অমুসলিমদের ওপর দমননীতি চালিয়ে নিজেদের শাসন পাকাপোক্ত করার কোন চেষ্টা করেনি। করলে এত দীর্ঘকাল পরেও অমুসলিমদের অস্তিত্ব থাকতো কি?
একটা গল্প বলছি। কোনো কাল্পনিক গল্প নয়, সত্যি গল্প। গল্পটা পড়েই বুঝতে পারবেন ইসলাম কতটা উদার। মুসলিম সেনাপতি হযরত আমর ইবনে আ’স (রা.)-এর সময়ের কথা। একদিন সকালবেলা আলেকজান্দ্রিয়ার খ্রিস্টান পল্লীতে হইচই পড়ে গেল। দেখা গেল সবাই বাজারে জটলা হয়ে আছে। উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় চলছে। সেখান থেকে খ্রিস্টানদের স্থানীয় আর্চ ‘বিশপ’ বাজারের ঘটনা অবগত করার জন্য আমর ইবনে আ’স (রা.)-এর বাসভবনে গেলেন। তার সাথে আরও অনেকেই গেলেন। সেখানে গিয়ে বিশপ জানালেন, গত রাতে কেউ একজন বাজারের যিশু খ্রিস্টের মূর্তির নাক ভেঙে দিয়েছে। এ মূর্তিটা আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা ধরে নিয়েছি যে এটা মুসলমানদেরই কাজ।
আমর ইবেন আ’স এ কথা শুনে অত্যন্ত দুঃখিত হলেন। তিনি বললেন, “আমি খুবই লজ্জিত ও ব্যথিত। সত্যি কথা বলতে, ইসলামে মূর্তিপূজা জায়েজ না ঠিক, কিন্তু অন্য ধর্মের উপাস্যকে গালি দেয়াও যে ইসলাম হারাম করেছে। অনুগ্রহ করে আপনি মূর্তিটা পুনর্নির্মাণ করে নিন। এতে যত খরচ হয় আমি তা দিয়ে দেব।” বিশপ বললেন, “এ মূর্তি রিপেয়ার করা যাবে না।”
আ’স বললেন, “তবে নতুন করে বানান। আমি খরচ দেব।” “না, সেটাও হবে না। আপনি জানেন, যীশু ঈশ্বরপুত্র। তার মূর্তির এমন অবমাননা সহ্য করা যায় না। একটাই ক্ষতিপূরণ, আমরা আপনাদের মুহাম্মাদ (সা.)- এর মূর্তি বানিয়ে সেটার নাক ভাঙ্গব।”
রাগে জ্বলে গেল আ’স (রা.)-এর গা। তিনি কিছুক্ষণ নীরব থেকে বিশপকে বললেন, “আপনি যা বললেন সেটা সম্ভব না। আমাদের সম্পদ, পরিবারের চেয়েও মুহাম্মাদ (সা.)কে বেশি ভালবাসি। আমার অনুরোধ, এ প্রস্তাব ছাড়া অন্য যেকোনো প্রস্তাব করুন আমি রাজি আছি। আমাদের যেকোনো একজনের নাক কেটে আমি আপনাদের দিতে প্রস্তুত, যার নাক আপনারা চান।”
খ্রিস্টান নেতারা সবাই এ প্রস্তাবে সম্মত হলো। পরদিন খ্রিস্টান ও মুসলমান বিরাট এক ময়দানে জমায়েত হলো। মিসরের শাসক সেনাপতি আমর (রা.) সবার সামনে হাজির হয়ে বিশপকে বললেন, “এ দেশ শাসনের দায়িত্ব আমার। যে অপমান আজ আপনাদের, তাতে আমার শাসনের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। তাই এই তরবারি গ্রহণ করুন এবং আপনিই আমার নাক কেটে দিন।”
এ কথা বলেই বিশপকে একখানি ধারালো তরবারি হাতে দিলেন, বিশপ সেটা পরীক্ষা করলেন। জনতা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, খ্রিস্টানরা স্তম্ভিত। চারদিকে থমথমে ভাব। সে নীরবতায় নিঃশ্বাসের শব্দ করতেও যেন ভয় হয়।
হঠাৎ সেই নীরবতা ভঙ্গ করে একজন মুসলিম সৈন্য এগিয়ে এলো। চিৎকার করে বলল, “আমিই দোষী, সেনাপতির কোনো অপরাধ নেই। আমিই মূর্তির নাক ভেঙেছি। এই দেখুন আমার হাতে এখনো সেই নাকটি রয়েছে। সবার দৃষ্টি মূর্তির ভাঙ্গা নাকের দিকে। নাক হাতে সৈন্যটি বললেন, মূর্তি ভাঙার কোনো ইচ্ছা আমার ছিল না। মূর্তির মাথায় বসা একটি পাখি ছিল। আমি ভাবলাম যদি এই পাখিটা মলত্যাগ করে মূর্তিটাকে অসুন্দর করে দয়। তাই পাখিটার দিকে তীর নিক্ষেপ করতে গিয়ে এ দুর্ঘটনাটি ঘটেছে।”
সৈন্যটি এগিয়ে এসে বিশপের তরবারির নিচে নাক পেতে দিল। নির্বাক সবাই। বিশপের অন্তরাত্মা রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। তরবারি ছুড়ে বিশপ বললেন, “ধন্য সেনাপতি, ধন্য হে বীর সৈনিক, আর ধন্য আপনাদের মুহাম্মদ (সা.), যার মহান আদর্শে আপনাদের মতো মহৎ উদার নির্ভীক ও শক্তিমান ব্যক্তি গড়ে উঠেছে।
সুতরাং এ ঘটনা থেকেই অনুমেয় যে, ইসলাম অন্য ধর্ম, ধর্মের উপাস্য এবং ধর্মের অনুসারীদের ওপর কতটা উদার। সুতরাং মন্দিরে ভাঙচুর করার মতো এহেন গর্হিত কাজের সমর্থন ইসলাম দেয়নি, দিতে পারে না।
কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, এইযে মূর্তি ভাঙা নিয়ে সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীগণ, ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া এত বলাবলি, লেখালেখি ও হৈ চৈ করে অন্যায়ের প্রতিবাদ করল, তাদের সেই প্রতিবাদে পবিত্র কাবা অবমাননার কথাটি একটিবারও ওঠে আসল না। অবস্থা এমন হয়েছে যে, তাদের সেই হৈচৈয়ে কাবা অবমাননার প্রসঙ্গটাই অনেকে ভুলে গেছেন। এ যে কতটা বেইনসাফি হয়েছে তাকি সুশীল সমাজ বুঝবে না?
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না বাংলাদেশ একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এখানে একজন মুসলমান যতটুকু অধিকার পায়, ততটুকু অধিকার পায় একজন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীও। এখানে হিন্দু-মুসলিম পরস্পরের প্রতি যেই সৌহার্দতা রয়েছে বিশ্বের অন্য কোথাও তার নজির নেই। সে জন্যই কবি নজরুল ইসালাম এদেশের হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির তৃপ্তিতে লিখেছিলেন, ‘মোরা একই বৃন্তের দুইটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান।’
অতএব, যে ধর্মেরই অবমাৃননা হোক না কেন তার প্রতিবাদে আমাদের সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। আর সরকারকেও নিতে হবে কঠিন পদক্ষেপ। নতুবা, সারা বিশ্বে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বাংলাদেশের যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রয়েছে, তা অচিরেই কলঙ্কজনক অধ্যায়ে পরিগণিত হবে।
ষ লেখক : ইমাম ও খতিব, আদ্রা জামে মসজিদ, কসবা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Sadiqul Alam ২৩ জুলাই, ২০১৯, ১১:৫৬ এএম says : 0
পোস্টটি অনেক সুন্দর হয়েছে। আল্লাহ আপনার জ্ঞান গরীমা বৃদ্ধি করুন।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন