মুহাম্মদ ফারুক খান এমপি
নিজেদের অধিকার আদায় করার লক্ষ্যে লড়াই করা মানব জাতির সবচেয়ে সাধারণ সহজাত প্রবৃত্তি। তাই যুগ যুগ ধরে যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই আছে। সমরশাস্ত্রের শিক্ষার্থীবৃন্দ, সামাজিক বিজ্ঞানীগণ, ঐতিহাসিকগণ যুদ্ধকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন। যুদ্ধবিগ্রহ এমনি একটি কঠিন বিষয় যা সাধারণত অনভিজ্ঞ লোকের পক্ষে করা সম্ভব নয়। যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী না হয়েও যুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং সুযোগ্য নেতৃত্ব দিয়ে যুদ্ধে সফলতা অর্জন করতে পেরেছে এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে খুবই কম আছে। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে গৌরবম-িত ব্যতিক্রম হচ্ছেন আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.), যিনি তার জীবদ্দশায় বাধ্য হয়ে বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। যদিও আল্লাহর নবী হিসেবে মহানবী (সা.)-এর প্রথম যুদ্ধ হলো বদরের যুদ্ধ, তথাপি সপ্তম শতাব্দীতে অনুষ্ঠিত তার নবী জীবনের দ্বিতীয় যুদ্ধ ‘ওহুদের যুদ্ধ’ ইসলামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ হিসেবে আজও বিবেচ্য। এ যুদ্ধের শিক্ষা কেবল মাত্র সে যুগের জন্যই নয় বরং আজও সকলের জন্য, বিশেষ করে সমরশাস্ত্রের শিক্ষার্থীদের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
আজ থেকে চৌদ্দশত বছর পূর্বে, ৩য় হিজরির ৮ সাওয়াল, ৬২৫ খ্রিস্টাব্দের ২৩ মার্চ শনিবার, মদিনা হতে ছয় মাইল দক্ষিণে, লোহিত সাগর থেকে প্রায় দু’শ মাইল পূর্বে এবং মক্কা হতে প্রায় দু’শ মাইল উত্তরে ‘ওহুদ’ নামক পার্বত্য এলাকায় মদিনার মুসলমান এবং মক্কার কাফেরদের মধ্যে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল।
বদরের যুদ্ধে পরাজয়ের গ্লানি সহ্য করতে না পেরে এ যুদ্ধের পরেই কাফেররা অপর একটি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। তায়েফ এর কাছে থাকিব, আবদ মানাত, আহবীসসহ বিভিন্ন গোত্রের কাছে দূত প্রেরণ করা হয় যুদ্ধে সাহায্যের জন্য। এভাবে ৬২৫ খ্রিস্টাব্দের ১১ মার্চ কাফেররা তিন হাজার লোকের একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠন করে, যাদের মধ্যে ছিল যুদ্ধের পোশাক পরিহিত ৭০০ সৈন্য, তিন হাজার উষ্ট্র এবং ২০০ ঘোড়া। গুপ্তচরের মাধ্যমে মুহাম্মদ (সা.) তাদের প্রস্তুতির খবরাখবর সংগ্রহ করেন। ৬২৫ সালের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে মক্কা থেকে কাফেররা যুদ্ধযাত্রা করে এবং যখন তারা জুল-হুলাইফা পৌঁছে তখন কিছু ছদ্মবেশী সাহসী মুসলমান তাদের সাথে যোগদান করে মদিনায় সংবাদ প্রেরণ করতে থাকে। ২১ মার্চ কাফেররা মদিনার উত্তরে ওহুদ নামক স্থানে অবস্থান নেয়। এ অবস্থায় যুদ্ধের কৌশল নির্ধারণের জন্য ২২ মার্চ রোজ শুক্রবার সকালে মুহাম্মদ (সা.) এক সভা আহ্বান করেন এবং যুদ্ধ-সংক্রান্তÍ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এ সভায় নেতৃস্থানীয় এবং বয়স্ক মুসলমানগণ মদিনা নগরীকে ব্যবহার করে প্রতি বাড়িতে বাড়িতে যুদ্ধের পক্ষে মত দেন, অন্যদিকে যুবক শ্রেণির মুসলমানগণ শহরের বাইরে শত্রু মোকাবেলার এবং যুদ্ধের পক্ষে মত দেন। অধিকাংশ মুসলমানই শহরের বাইরে যুদ্ধের প্রস্তাবে মত দেওয়ায় মুহাম্মদ (সা.) তা গ্রহণ করেন। ৬২৫ সালের ২২ মার্চ বিকেলে মুহাম্মদ (সা.) এক সহ¯্র সৈন্যের একটি দল নিয়ে ওহুদের প্রান্তরের দিকে রওনা করেন। ওহুদে যাওয়ার সাধারণ পথ ব্যবহার না করে তিনি পাহাড়ের দুর্গম পথ দিয়ে ‘সাওয়াত’ নামক স্থানে পৌঁছান। ওখানে আবদুল্লাহ বিন উবাই তার প্রায় ৩০০ জন ইহুদি অনুসারী নিয়ে মুসলমানদের দল ত্যাগ করে। তাদের দল ত্যাগের ব্যাপারে পরস্পরবিরোধী কারণ পাওয়া যায়। যেমনÑ
(ক) মেজর জেনারেল আকবর খান রচিত তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘ডিফেন্স স্ট্রেটেজি ইন ইসলাম’-এ বর্ণনা করেন যে, আবদুল্লাহ বিন উবাইয়ের পরিকল্পনা ছিল মুহাম্মদ (সা.)-কে এমন বুঝানো যাতে তিনি ওহুদে যাওয়ার সর্ব সাধারণের ব্যবহৃত পথ অনুসরণ করেন এবং যুদ্ধ ক্ষেত্রে যাওয়ার পূর্বেই কাফেরদের ফাঁদে পড়ে সমূলে ধ্বংস হন। মুহাম্মদ (সা.) উবাইয়ের পরিকল্পনা মোতাবেক ওহুদ যাত্রার পথ গ্রহণ করেননি। এ জন্যই উবাই তার অনুসারীদেরসহ মুসলমানদের দল ত্যাগ করে।
(খ) ইতিহাসবিদ ডব্লিউ মন্টোগুমারী ওয়াট তার ‘মুহাম্মদ এট মদিনা’ বইতে উল্লেখ করেন যে, মুহাম্মদ (সা.) ইচ্ছা করেই ইহুদিদের পরিহার করেছিলেন কারণ তারা ছিল অবিশ্বাসী এবং আবদুল্লাহ বিন উবাইর দুষ্কর্মের সহযোগী। যুদ্ধ ক্ষেত্রে তাদের দ্বারা সমস্যা সৃষ্টি এবং বিশ্বাসঘাতকতা করার সম্ভাবনা ছিল।
(গ) মাওলানা মুফতি মোহাম্মদ শাফি তার ‘তফসিরে মারেফুল কুরআন’-এ বর্ণনা করেন যে, মুহাম্মদ (সা.) আবদুল্লাহ বিন উবাই এবং তার অনুসারীদের পরামর্শ অনুযায়ী মদিনা নগরীতে যুদ্ধ না করার কারণে দলত্যাগ করেছিল।
যাই হোক, একজন সুযোগ্য সেনা অধিনায়কের মত মুহাম্মদ (সা.)-এর নেতৃত্বে মুসলমান সৈন্য বাহিনী দুর্গম অথচ নিরাপদ পথ অনুসরণ করে রাতে ‘সাওখায়ান’ নামক স্থানে পৌঁছে। এখানে মুহাম্মদ (সা.) তার বাহিনীকে সংগঠিত ও পরিদর্শন করেন। মদিনা নগরীর সুরক্ষার জন্য তিনি আরও কিছু মুসলমান সৈন্যকে মদিনায় ফেরত পাঠান। তারপর তিনি বানু হারিচা গ্রাম থেকে আবু হসম্যান আল হারিসী নামে এক ব্যক্তিকে পথপ্রদর্শক হিসেবে নেন এবং পাহাড়ের গোপন পথ দিয়ে মুসলিম বাহিনীকে ওহুদের যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে যান। এভাবে মুসলমান সৈন্যবাহিনী কখন কীভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হয়েছিল তা কাফেররা বুঝতেই পারেনি। মুহাম্মদ (সা.) ওহুদ-এর জাবল-ই আইনান এর পাদদেশে অবস্থিত ঝরনার কাছে ওহুদ পাহাড়কে পেছনে এবং জাবল-ই আনিয়েন পাহাড়কে সামনে রেখে তার সেনাবাহিনীকে মোতায়েন করেন।
তিন সহ¯্র উষ্ট্রারোহী সৈন্য এবং দুইশত অশ্বারোহী সৈন্যের সমন্বয়ে গঠিত কাফেরদের বাহিনীর নেতৃত্বে ছিল আবু সুফিয়ান। কিছু সংখ্যক ক্রীতদাসকেও এ বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল এবং বলা হয়েছিল তারা সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করলে তাদেরকে যুদ্ধের পরে মুক্ত করে দেয়া হবে। তাদের মধ্যে ছিল ওয়াশি নামক এক ক্রীতদাস যে বর্শা নিক্ষেপে খুব পারদর্শী ছিল। সাতশত পদাতিক এবং পঞ্চাশজন অশ্বারোহী সৈন্যের সমন্বয়ে মুসলিম সেনাবাহিনী গঠন করা হয়েছিল, যারা অস্ত্রশস্ত্রে কম হলেও মনোবলে বলীয়ান ছিলেন। কাফেরদের সুশিক্ষিত সেনাদল যুদ্ধের গতানুগতিক নিয়মমাফিক অবস্থান গ্রহণ করেছিল। অশ্বারোহীদের দুটি দলে বিভক্ত করে প্রত্যেক দলে একশত ঘোড়া রাখা হয়েছিল। খালেদ বিন ওয়ালিদের নেতৃত্বে একটি দল পদাতিক বাহিনীর ডানে এবং আকরমা বিন জাহেলের নেতৃত্বে অপর দলটি পদাতিকের বাম পাশে অবস্থান নিয়েছিল। পতাকা বহনকারী আবদাদ-দার গোত্রের তালহা পদাতিক দলের সাথে ছিল।
মুহাম্মদ (সা.) যুদ্ধ বিদ্যায় আনুষ্ঠানিকভাবে প্রশিক্ষিত না হয়েও কাফেরদের অস্ত্রশস্ত্রের শক্তি এবং অশ্বারোহীদের মাধ্যমে চলাচলের শক্তি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তিনি কাফেরদের এ শক্তির ধার কমানোর লক্ষ্যে এবং মুসলমানদের অধিকতর নিরাপত্তার জন্য পাহাড়ের উঁচু ঢাল ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি যুবায়ের বিন আওয়ামের নেতৃত্বে কিছু সুদক্ষ তীরন্দাজ এবং ৫০ জন অশ্বারোহীর একটি ছোট দলকে পর্বতের ঢালের সম্মুখ ভাগে মোতায়েন করেন। হযরত হামজাকে পদাতিক বাহিনীর অধিনায়ক এবং মুসাব বিন ওমরকে পতাকা বহনকারী হিসেবে পর্বতের পাদদেশে মোতায়েন করেন। মুহাম্মদ (সা.) ধারণা করেন যে, শত্রুর অশ্বারোহী বাহিনী পার্শ্ব ভাগ দিয়ে মুসলমানদের ওপর আক্রমণ করতে পারে। তাই তিনি আবদুল্লাহ বিন জুয়ায়েরের নেতৃত্বে ৫০ জন তীরন্দাজের একটি দল আইনীন পর্বতের গিরিপথে মোতায়েন করেন এবং তাদেরকে নিম্ন লিখিত নির্দেশ দেন :
(১) আইনীন পর্বতের দিকে অগ্রগামী শত্রুকে যে কোনো মূল্যে প্রতিহত করা।
(২) শত্রুকে আইনীন পাহাড়ের ঝরনা ব্যবহার করতে না দেয়া।
(৩) যে কোনো পরিস্থিতিতে এই গিরিপথ দখলে রাখা।
যুদ্ধটি প্রাথমিক অবস্থায় সে সময়ের ঐতিহ্যগতভাবে মল্লযুদ্ধ দিয়ে শুরু হয়। মল্লযুদ্ধে মুসলমানদের পক্ষে হযরত আলী, হযরত হামজা, জুহরা গোত্রের সাদ এবং আউছ গোত্রের আছিম ইবনে থাবিত অংশ নেন। তারা কাফেরদের পতাকাবাহী তালহা, তার দুই ভাই এবং চার ছেলেকে হত্যা করে। এর পরেই প্রকৃত যুদ্ধ শুরু হয়। কাফেররা মুসলমানদের অনিয়মতান্ত্রিক সৈন্য মোতায়েন দেখে অবাক হয়েছিল। পরিকল্পনা অনুযায়ী তৎকালীন কাফের নেতা খালিদ বিন ওয়ালিদ এবং আকরামা তাদের অশ্বারোহী সৈন্যদল নিয়ে পার্শ্বদিক থেকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে আক্রমণ রচনা করে। যদিও খালিদ নির্ধারিত সময়েই তার আক্রমণ রচনা করেছিল কিন্তু আকরামা মুসলমান সৈন্যদলের মোতায়েন সম্পর্কে জানতে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে এবং এ কারণে দেরিতে আক্রমণ করে। ওহুদের পাদদেশে অবস্থানরত মুসলমান বাহিনীর ধনুকের আঘাতে খালিদের অশ্বারোহী বাহিনী বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং মনোবল হারিয়ে ফেলে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মুসলিম অশ্বারোহীদের আক্রমণে খালিদের বাহিনী আরও ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় পশ্চাদপসারণ করে। আকরামার আক্রমণও একইভাবে প্রতিহত হয় এবং সেও পশ্চাদপসারণ করেন। যুদ্ধের পরিস্থিতি অনুকূলে দেখে মুহাম্মদ (সা.) হামজার নেতৃত্বে মুসলিম পদাতিক বাহিনীকে নির্দেশ দেন আক্রমণ রচনা করার জন্য। একজন সাহসী ও যোগ্য নেতা হিসেবে মুহাম্মদ (সা.) নিজেও আক্রমণে অংশগ্রহণ করেন। মুসলমান সৈন্যদের আক্রমণের মুখে কাফেররা টিকতে না পেরে বাধ্য হয়ে পশ্চাদপসারণ করে এবং পলায়ন করতে উদ্যত হয়।
আব্দুল্লাহ বিন জুবায়েরের নেতৃত্বে ৫০ জন তীরন্দাজ মুসলমানের পেছনে আইনীন গিরিপথ এলাকায় পাহারায় রত ছিল। পাহাড়ের পাদদেশ দিয়ে কাফেরদের পালাতে দেখে এই তীরন্দাজ দল আনন্দিত হয়ে ওঠে। তাদের অধিকাংশই আবদুল্লাহর নির্দেশ উপেক্ষা করে বিজয়ে শামিল হওয়ার লক্ষ্যে এবং যুদ্ধে কাফেরদের ফেলে যাওয়া মালামাল দখলের জন্য স্থান ত্যাগ করে। তীরন্দাজ এবং অশ্বারোহীদের দ্বারা খালিদ বিন ওয়ালিদের দল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও তিনি তার অশ্বারোহী দলকে পুনর্গঠনের পর যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কিছু দূরে অপেক্ষা করছিল। মুসলমানদের আইনীন গিরিপথ পরিত্যাগ করার দৃশ্য তার সুচতুর চোখে ধরা পড়ে এবং তিনি তার অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে পেছন দিয়ে মুসলমানদের ওপর আক্রমণ করে। এখানেই যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। আব্দুল্লাহ এবং তার সাথে যে দশজন মুসলমান আইনীন গিরিগথে তখনও পাহারারত ছিলেন তারা সকলেই যুদ্ধ করে শাহাদৎবরণ করেন। মালামাল সংগ্রহে ব্যস্ত মুসলমান সৈন্যরা এ আক্রমণে বিস্মিত হন। প্রচ- যুদ্ধ শুরু হয়। পলায়নরত কাফের দলও ঘুরে দাঁড়ায় এবং সমস্ত মুসলমানগণ শত্রু বাহিনীর অশ্বারোহী ও পদাতিক দলের মাঝখানে পতিত হয়। এ পর্যায়ে যুদ্ধে ৭০ জন মুসলমান শহীদ হন। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিনদা বদরের যুদ্ধে তার ভাই উদবাহকে হত্যা করার প্রতিশোধ গ্রহণের লক্ষ্যে মক্কার ক্রীতদাস ওয়াসিকে নিযুক্ত করেছিল হযরত হামজাকে হত্যা করার জন্য। ওয়াসি সুযোগ খুঁজছিল। এই সময় সে দূর থেকে বর্ষা নিক্ষেপ করে হযরত হামজাকে হত্যা করে।
যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে কাফেরদের অতর্কিত আক্রমণে বিস্মিত হয়েও মুসলমান বাহিনী তাৎক্ষণিকভাবে যুদ্ধ শুরু করে। মুহাম্মদ (সা.) কতিপয় অনুসারীকে সাথে নিয়ে সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেন। ধীরে ধীরে তারা ওহুদের পাহাড়ের উপরের ঢালে অবস্থান নেন। কাফেরদের অনেকে মুসলমানদের তাড়া করে ওহুদ পাহাড়ের পাদদেশ পর্যন্ত পৌঁছে। এ অবস্থায় মুসলমান সৈন্যরা পাহাড়ের উচ্চস্থান থেকে তাদের প্রতি তীর, বল্লম ও পাথর নিক্ষেপ করতে থাকে। কাফেররাও তীর এবং পাথর নিক্ষেপ শুরু করে। এ পর্যায়ে মুহাম্মদ (সা.)-এর মুখে একটি পাথরের আঘাত লাগলে তাঁর দুটো দাঁত ভেঙে যায় এবং তিনি গর্তে পড়ে যান। এ দৃশ্য দেখে মুসলমানদের মনোবল ভেঙে পড়লেও মুহাম্মদ (সা.) শীঘ্রই সুস্থ হন এবং মুসলমানরা আবার সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করতে থাকে। মক্কাবাসী ভেবেছিল যে মুহাম্মদ (সা.) মারা গেছেন তাই তারা যুদ্ধ ক্ষেত্র ত্যাগ করে। অল্প পরেই মুসলমানদের নব উদ্যমে যুদ্ধ করতে দেখে মক্কাবাসী বুঝতে পেরেছিল যে, মুহাম্মদ (সা.) মারা যাননি। কাফেররাও তাদের প্রভূত ক্ষতির জন্য মনোবল ভেঙে যাওয়ার কারণে আর যুদ্ধ পরিচালনা করতে ব্যর্থ হয়। এই অবস্থাকে মক্কার কাফের নেতাদের অন্যতম আমর বিন আল আস এভাবে ব্যাখ্যা করেছে (আল ওয়াজিদি কর্তৃক বর্ণিত) “আমরা যখন আবার মুসলমানদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালিয়েছি তখন তারা বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা ছত্রভঙ্গদেরকে একটি দলে একত্রিত করে। কুরাইশরা তখন একত্রে পরামর্শ করে, জয় আমাদেরই এবং চল প্রস্থান করি। তাছাড়া আমাদের অনেকে আহত হয়েছিল এবং তীরের আঘাতে আমাদের সব ঘোড়া জখম হয়েছিল। সুতরাং তারা সবাই প্রস্থানে একমত হয়।”
কাফেররা যুদ্ধ ক্ষেত্র ত্যাগ করলে মুহাম্মদ (সা.) তাদের অনুসরণ করার জন্য হযরত আলী (রা.)-কে এক প্লাটুন সাহাবিসহ পাঠান। মুহাম্মদ (সা.) গুরুতর আহত হওয়া সত্ত্বেও যুদ্ধক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত অবস্থান করেন এবং কাফেরদের গতিবিধির সংবাদ প্রাপ্তির পর মৃতদেহ সংগ্রহের আদেশ দেন। অমুসলমানদের মৃতদেহ পূর্ণ মর্যাদায় সমাহিত করা হয় এবং অমুসলমানদের মৃতদেহগুলোকেও যথারীতি মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। এ যুদ্ধে মুসলমান মহিলাগণ তীর সংগ্রহ করে এবং আহতের সেবা শুশ্রƒষা করে মুসলিম সৈন্যদের নানাভাবে সাহায্য করেন। যুদ্ধক্ষেত্রে মুসলমানরা কাফেরদের মৃতদেহ যথাযত সমাহিত করলেও কাফেররা মুসলমানদের মৃতদেহকে ক্ষতবিক্ষত করে অসম্মান করেছিল। মুহাম্মদ (সা.) তার সৈন্যদল নিয়ে বিকেলে মদিনায় ফিরলেও একজন দূরদর্শী সামরিক অধিনায়কের ন্যায় কাফেরদের পরবর্তী আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তাদের অনুসরণের সিদ্ধান্ত নেন। এটা ছিল সক্রিয় প্রতিরক্ষার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এ কৌশল কাফেরদের পুনরায় আক্রমণ থেকে বিরত রাখে। হযরত আলীর (রা.) নেতৃত্বে একদল মুসলমান সৈন্য কাফেরদের পরবর্তী দুই দিন অনুসরণ করে। দিনের বেলা কাঠ সংগ্রহ করে রাতে বেশি করে আগুন জ্বালিয়ে তারা কাফেরদের দেখাত যে, মুসলমানদের দল অনেক বড়। এ সময় খুজাহ গোত্রের এক বন্ধুপ্রতিম বেদুইন কাফেরদের কাছে মুসলমানদের সংখ্যা অতিরঞ্জিত করে তাদের মনোবল নীচু রাখতে সাহায্য করে।
যুদ্ধের বিশ্লেষণ :
ওহুদের যুদ্ধকে সাধারণভাবে মুসলমানদের জন্য পরাজয় হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু সুগভীর বিশ্লেষণে এই যুদ্ধের ফলাফল অন্য রকম প্রমাণিত হবে।
ক। লক্ষ্য অর্জনের দিক থেকে বিবেচনা করা হলে এটা প্রমানিত যে, কাফেররা তাদের লক্ষ্য অর্জনে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছিল। একমাত্র একটি বিষয়ে তারা সফল হয়েছিল তা হলো বদরের যুদ্ধে তাদের ৭০ জন মৃত্যুর প্রতিশোধ নেয়া। এ যুদ্ধের মাধ্যমে মুহাম্মদ (সা.)-এর সামরিক নৈপুণ্য এবং মুসলমানদের রণদক্ষতা পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এ ছাড়াও ইসলামকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ব্যর্থ হওয়ায় এ অঞ্চলের অন্যান্য গোত্রের নেতাদের মুসলমানদের প্রতি সম্মান বৃদ্ধি পায়। তারা বুঝতে পারে যে, ইসলাম ও মুহাম্মদ (সা.) স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে।
মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনের সুরা আনফাল-এর ৬০ আয়াতে ঘোষণা করেছেন “তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে অর্থাৎ সর্বশক্তি নিয়ে প্রস্তুত থাক, অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে, আল্লাহর দুশমন, তোমাদের দুশমন এবং অন্য সব দুশমন যাদের তোমরা চেনো না, তবে আল্লাহ চেনেন, এদের ধ্বংস করার জন্য। মনে রেখ আল্লাহর পথে তোমরা যা খরচ করবে তার উত্তম প্রতিদান তোমরা পাবে এবং তোমাদের প্রতি কোনো অন্যায় করা হবে না।”
খ। ওহুদের যুদ্ধ থেকে বিশেষ করে সৈনিকদের জন্য অনেক শিক্ষণীয় আছে। এ যুদ্ধের বিভিন্ন পর্বে মুহাম্মদ (সা.) যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তা থেকে নিম্নলিখিত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বাস্তব শিক্ষা লাভ করা যায় :
(১) যুদ্ধ ক্ষেত্র নির্বাচন : অধিকাংশ সাহাবি এবং বিশেষ করে যুবক শ্রেণিদের পরামর্শক্রমে খোদ মদিনা নগরীর ভিতর যুদ্ধ করার পরিবর্তে ওহুদের পার্বত্য এলাকায় যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন হযরত মুহাম্মদ (সা.)। এ যুদ্ধ সংঘটনের জন্য মুহাম্মদ (সা.) ওহুদের পার্বত্য এলাকা কেন নির্বাচন করেছিলেন তা বিশ্লেষণ করা একটি আকর্ষণীয় ব্যাপার। এমন কোনো সাক্ষী নেই যে, তিনি এ উদ্দেশ্যে কোনো টহল দল বা গোয়েন্দা দল প্রেরণ করেছিলেন। আমার মনে হয় তিনি এই এলাকাটা নির্বাচন করেছিলেন তার পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে। আজও বিশ্বের সকল মিলিটারি একাডেমিতে শিক্ষা দেওয়া হয় যে, যখনই কোনো ভূমি দেখবে তা একজন সমরবিদের দৃষ্টিতে দেখবে যে ভূমি কোনো ধরনের যুদ্ধের কৌশলের জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। মুহাম্মদ (সা.) কোনো মিলিটারি একাডেমিতে শিক্ষা না নিলেও এই জ্ঞানের ব্যবহার করেছিলেন।
২। গুরুত্বপূর্ণ এলাকার নিরাপত্তা : যুদ্ধে যাওয়ার পূর্বে মুহাম্মদ (সা.) একদল মুসলমানকে মদিনা নগরীর নিরাপত্তার জন্য মদিনা রেখে যান। এই সিদ্ধান্ত নিম্নোক্ত সুবিধাগুলো নিশ্চিত করেছিলÑ
(ক) নগরীটি নিরাপদ ছিল এবং নির্দোষ মানুষের কোনো অসুবিধা হয়নি।
(খ) অমুসলিম গোত্রগুলোও নিরাপত্তা পেয়েছিল যা মুসলমানদের প্রতি তাদের শ্রদ্ধাবোধ বৃদ্ধি করেছিল।
(গ) বানু সালালের ইহুদি গোত্র যারা আবদুল্লা বিন উবাইয়ের নেতৃত্বে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করেছিল তারাও কোনো প্রকার বিরোধী ভূমিকা রাখতে পারেনি।
৩। দুর্গম রাস্তার ব্যবহার : মুহাম্মদ (সা.) মদিনা থেকে ওহুদের প্রান্তরে যাওয়ার জন্য সনাতন রাস্তা ব্যবহার না করে দুর্গম এবং অব্যবহৃত রাস্তা দিয়ে ওহুদ যান। এর ফলে কাফেররা মুসলমান সৈন্যদের গতিবিধি জানতে পারেনি এবং ক্ষতিও করতে পারেনি।
৪। উঁচু ভূমি দখল : মুহাম্মদ (সা.)-এর নির্দেশে আইনান পর্বত এবং তার আশপাশের ঝরনাগুলো মুসলিম বাহিনী রাত্রিকালীন সময়েই দখল করে যখন মুসলিম সৈন্যরা সকাল বেলা যুদ্ধের বেশে বের হয়ে আসে তখন সূর্যের আলো কাফের যোদ্ধাদের মুখের ওপর পড়ায় তাদের পর্যবেক্ষণ বিঘিœত হয়। এ ছাড়াও মুহাম্মদ (সা.) যেহেতু তার বাহিনীকে পাহাড়ের সম্মুখ ঢালে মোতায়েন করেন এবং বাতাস সাধারণত পাহাড়ের ওপর থেকে নিচের দিকে প্রবাহিত হয় সুতরাং বাতাস মুসলিম তীরন্দাজদের নিক্ষিপ্ত তীরের লক্ষ্যভেদে সাহায্য করে। এসব আজও যুদ্ধের কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এরকম সুবিধাজনক অবস্থানের কারণেই যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে যখন কাফেরদের নেতা খালিদ বিন ওয়ালিদ এবং আকরামা তাদের অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে মুসলমান সৈন্যদের ডান এবং বাম পাশে আক্রমণ করে, তখন উঁচু ভূমিতে মুসলমান মোতায়েনকৃত তীরন্দাজ বাহিনী তাদের প্রতিহত এবং প্রভূত ক্ষতিসাধন করতে পেরেছিল। ওহুদ পর্বতের উঁচু ভূমি মুসলিম সৈন্যের জন্য প্রতিরক্ষা ও জীবন রক্ষায় সাহায্য করেছিল। এর সব কিছুই সম্ভম হয়েছিল মুহাম্মদ (সা.)-এর যথার্থ উপলব্ধি এবং স্থান নির্বাচনের ফলে।
৫। যুদ্ধ কৌশলে অপ্রচলিত ধারা অবলম্বন : তখনকার দিনে সাধারণত সমতল ভূমিতে যুদ্ধ সংঘটিত হতো। সে অনুসারে কাফেররা তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাবাহিনী সমবেত করে এবং যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু মুহাম্মদ (সা.) উঁচু ও সমতল ভূমির যথার্থ ব্যবহারের মাধ্যমে এ যুদ্ধের জন্য অপ্রচলিত কৌশল ব্যবহার করেন যা কাফেরদের বিস্মিত করে। এ কারণেই কাফেরদের অশ্বারোহী বাহিনীর এক অধিনায়ক আকরামা হতবাক হয়ে পড়ে এবং আক্রমণে বিলম্ব করে। এই বিলম্ব মুসলিম বাহিনীকে অনেকটা রক্ষা করেছে। যদি খালেদ এবং আকরামার অশ্বারোহী বাহিনী একসাথে আক্রমণ করত তবে মুসলমানদের অনেক ক্ষতির সম্ভাবনা ছিল।
৬। কৌশলগত ভূমির নিয়ন্ত্রণ : মুহাম্মদ (সা.) যথার্থ উপলব্ধি করে আইনান পর্বতের গুরুত্বপূর্ণ গিরিপথ দখলে রাখার সিদ্ধান্ত নেন এবং সেখানে আবদুল্লাহ বিন যুবায়েরের নেতৃত্বে ৫০ জন তীরন্দাজের একটি দল নিয়োগ করেন এবং যে কোনো অবস্থায় ওই স্থান ত্যাগ না করার নির্দেশ দেন। কিন্তু মুহাম্মদ (সা.)-এর আদেশ অমান্য করার ফলে মুসলমান সেনাদল ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মুহাম্মদ (সা.)-এর নির্দেশ মানলে এ ক্ষতি হতো না বরং এ যুদ্ধে একটি বড় বিজয় হতো।
ছ। আইনান পর্বতের দখল : ওহুদ এলাকার একমাত্র ঝরনা মুসলিমদের দখলে থাকার কারণে তা প্রশাসনিকভাবে তাদের সাহায্য করে পক্ষান্তরে কাফেরদের সৈন্য এবং উটের জন্য প্রচ- কষ্টের কারণ হয়।
উপসংহার :
১) ওহুদ যুদ্বের চূড়ান্ত ফলাফল কী ছিল? বাহ্যিক দৃষ্টিতে ক্ষতির দিক বিবেচনা করলে এ যুদ্ধে ৭০ জন সাহসী মুসলমানের শাহাদাতের কারণে এটাকে পরাজয় বলা যায়। কিন্তু কৌশলগত (স্ট্র্যাটেজি) ভাবে বিবেচনা করলে এটা ছিল মুসলমানদের জন্য একটি সুকৌশলী বিজয়। যুদ্ধের বিশ্লেষণাত্মক সমালোচনা প্রমাণ করে এ যুদ্ধে কাফেরদের অধিকাংশ উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়েছে, পক্ষান্তরে মুসলমানদের সকল উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। উপরন্তু মুহাম্মদ (সা.)-এর যুদ্ধ-সংক্রান্ত জ্ঞানের গভীরতা এবং এর বাস্তব ও কার্যকরী প্রতিফলন মুসলমানদের জন্য উঁচু মনোবল ও আত্মবিশ্বাস এবং কাফেরদের জন্য ভীতি এবং নীচু মনোবলের কারণ হিসেবে দেখা দেয়। কাফের এবং অন্যান্য গোত্রের নেতৃবৃন্দ মুহাম্মদ (সা.) এবং মুসলমানদের সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতে থাকে এবং সর্বোপরি ইসলাম ধর্ম সুপ্রতিষ্ঠা লাভ করে।
২। আধুনিক যুদ্ধ জয়ের জন্য যুদ্ধের নীতির (চৎরহপরঢ়ষবং ড়ভ ডধৎ) ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে আমরা নেপোলিয়ান বোনাপাট, মন্টগোমারী রোমেনের কথা শুনি। আমরা কি জানি যে, মুহাম্মদ (সা.) চৌদ্দশত বছর পূর্বেই এ যুদ্ধে ‘যুদ্ধের নীতি’সমূহ ব্যবহার করেছিলেন, যা নিম্নের বিষয়গুলো দ্বারা নিশ্চিত হয়।
ঘটনা যুদ্ধের নীতি অনুসরণ
১। মুহাম্মদ (সা.) যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন কিন্তু যুদ্ধ ক্ষেত্র কোথায় হবে তা অগ্রিম জানান নেই।
২। যুদ্ধ এলাকায় রাত্রিতে চলাচল।
৩। আইনান পর্বতের উঁচু স্থান দখল করে অশ্বারোহী সৈন্য সমাবেশ, সকালের সূর্য এবং বাতাসের অনুকূল ব্যবহার, খালেদ এবং আকরামার অশ্বারোহী বাহিনী ডান ও বাম পার্শ্ব থেকে আক্রমণ প্রতিহতকরণ।
৪। তীরন্দাজ বাহিনী আইনান পর্বতের গিরিপথে নিয়োগ রাখা।
৫। পানি সংগ্রহের স্থান দখল।
৬। পদাতিক তীরন্দাজ এবং অশ্বারোহী বাহিনী সমন্বিত ব্যবহার, মুসলমান মহিলাদের যুদ্ধ ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে সাহায্য একটি সমন্বিত যুদ্ধে প্রমাণ করে।
৭। সর্বোপরি যদি মুহাম্মদ (সা.) আহত হয়েছিলেন এবং হযরত হামজাসহ ৭০ জন বীর মুসলমান শাহাদাতবরণ করেছিলেন। তারপরও সাহসিকতা এবং সফলতার সাথে সৈন্য পরিচালনা করে মুহাম্মদ (সা.) প্রমাণ করেন যে, নেতার প্রতি বিশ্বাস প্রচ- সাহসের সঞ্চার করে, যা সম্মুখ যুদ্ধে বিজয়ের সব থেকে বড় উপকরণ।
৩। ওহুদের যুদ্ধের ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণ প্রমাণ করে কতই না নিপুণতার সাথে মুহাম্মদ (সা.) যুদ্ধের জন্য তৈরি হয়েছিলেন, যুদ্ধ করেছিলেন এবং যুদ্ধ শেষ করেছিলেন। এ যুদ্ধকে যে কোনো আধুনিক যুদ্ধের সাথে তুলনা করা যায়। প্রকৃতপক্ষে সকল যুগের সামরিক অধিনায়কদের এ যুদ্ধের ঘটনাবলি থেকে যথেষ্ট শেখার আছে। যুদ্ধটি বিশেষভাবে নেতৃত্ব, সমন্বয়, উচ্চ মনোবল গতানুগতিকতার ঊর্ধ্বে উঠে অপ্রচলিত রণকৌশল প্রয়োগ এবং শৃঙ্খলা এবং শৃঙ্খলাহীনতার শাস্তি প্রভৃতির একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এ নীতিগুলোই ১৯৪২ সালে ‘আল আমিন যুদ্ধের’ ফিল্ড মার্শাল মন্টোগুমারী দ্বারা এবং মিসরীয়দের দ্বারা ১৯৭৩ সালে রমজানের যুদ্ধে ইসরাইলের বিরুদ্ধে সার্থকভাবে প্রয়োগ করা হয়েছিল। ১৯৯০ সালে ইরাক ওকুয়েতের ওপর বহু জাতিক বাহিনী কর্তৃক “ডেজার্ট শিল্ড” এবং ডেজার্ট স্ট্রোম অপারেশনে এই নীতিগুলোরই প্রয়োগ, আধুনিক যুদ্ধে এর প্রয়োগের কিছু আধুনিক দৃষ্টান্ত।
৪। সারা বিশ্বের মুসলমানদের দুরবস্থা দেখে সত্যি দুঃখ হয়। আজ মুসলমানরা সন্ত্রাসী অশিক্ষিত গরিব বোকা হিসেবে পরিচিত। এসবের কারণ মুসলমানরা ইসলামের পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে। ইসলাম আমাদেরকে জ্ঞানার্জনের জন্য লেখাপড়া এবং অন্যকে সাহায্যের শিক্ষা দিয়েছে। আরও শিক্ষা দিয়েছে , সততা ও নিষ্ঠার এবং সকল অন্য্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে। কিন্তু আজ বাংলাদেশে এবং বিশ্বের সবখানে মুসলমানরা সব থেকে বেশি অশিক্ষিত।
যেখানেই মুসলমানরা আক্রান্ত তা প্যালেস্টাইনেই হোক অথবা আপনার বাসার পাশে বা রাস্তায়, অন্য এক মুসলমান সাহায্য করে না। সততায় আমরা বিশ্বের সব থেকে নিচে। কিন্তু এমন ছিল না আজ থেকে পাঁচশত অথবা হাজার। বারশত বছর আগে। এই পৃথিবীর জ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল মুসলমানরা। গণিত, বীজগণিত, জ্যামিতি, ত্রিকোনোমিতি, চিকিৎসা শাস্ত্র, দর্শন, আকাশ শাস্ত্র যাই বলুন তাতে মুসলমানরাই নেতৃত্বে ছিল। আর এসবের কারণ ছিল একটাইÑ লেখাপড়া ও জ্ঞান অর্জন। মহান আল্লাহও পবিত্র কোরআন অবতীর্ণের সময় প্রথম যে সবকটি অবতীর্ণ করেছিলেন তাও ছিল ‘ইকরা’ অর্থাৎ পড়। কিন্তু আমরা পড়ি না। আমরা স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় কোরআন-হাদিস পড়ি কিন্তু বুঝি খুবই কম এবং বাস্তব জীবনে এ শিক্ষার প্রয়োগ আরও কম। বাংলাদেশসহ মুসলমান রাষ্ট্রের সৈনিকরা জানে যুদ্ধের নীতি সঠিক প্রয়োগে যুদ্ধ জয় করা যায়। তারা জানে এ নীতিগুলোর উদ্ভাবন ঘটেছে নেপোলিয়ান, ফিল্ড মার্শাল রোমেল, ফিল্ড মার্শাল মন্টোগুমারী, জেনারেল প্যাটান, জেনারেল ম্যাকআর্থার প্রভৃতি সমর বিশারদের থেকে। কিন্তু জানে না যে, আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাদের থেকে বহু শত বছর আগেই যুদ্ধের নীতি সঠিকভাবে ব্যবহার করে যুদ্ধে জয়লাভ করেছেন।
আমি সমস্ত মুসলমানকে শিক্ষা অর্জনের চেষ্টা করার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। পবিত্র কোরআন এবং হাদিস পডুন, মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনী পড়–ন, বোঝার চেষ্টা করুন, শুধু বেহেস্তে যাওয়ার জন্য নয়, এ বিশ্বে মাথা উঁচু করে সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার জন্য।
লেখক : প্রেসিডিয়াম সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, সাবেক মন্ত্রী বাণিজ্য, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন