হুজুগে বাঙালি বলে বাঙালির ললাটে একটি তকমা বহুকাল আগে থেকেই কেউ একজন সেঁটে দিয়েছেন। কিন্তু এ তকমা গৌরবের না অপবাদের তা এক কথায় বিচার করা যায় না। কারণ, এই স্বভাব বাঙালির অনেক অর্জন ও বিসর্জনের নিমিত্ত। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মোহনগঞ্জ সুগার মিলকে (রংপুর সুগার মিল) কেন্দ্র করে সাঁওতাল উপজাতিদের সাথে যা ঘটছে তার সাথে এই উপমাটা চলে বৈকি। বাংলাদেশের মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবী সমাজের একাংশ যেভাবে সাঁওতালদের প্রতি সহানুভূতিতে অশ্রুপাত করছে তা কতটা সঙ্গত সেটা সংশয়ের ঊর্ধ্বে নয়। বিশেষ করে পুরো প্রক্রিয়ায় সাঁওতালদের স্বার্থ কতটুকু আর স্থানীয় বাঙালি ভূমিদস্যুদের স্বার্থ কতটুকু তা খতিয়ে না দেখে যারা অশ্রুপাত করছেন তাদের জন্য এই তকমা অসঙ্গত নয়।
প্রথমেই বলে নেয়া দরকার, সাঁওতাল সম্প্রদায় বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অন্যতম। ঐতিহ্যগতভাবে ভূমি তাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কাজেই ভূমি সংক্রান্ত তাদের সকল ন্যায্য দাবির প্রতি সমর্থন জানাচ্ছি। একই সাথে তাদের জীবনমানের উন্নয়নের জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে নেয়ার দাবি জানাচ্ছি। একই সাথে রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে তাদের মালিকানাধীন বা স্থায়ী বসতির সূত্রে দখলীয় কোনো জমি যদি অধিগ্রহণের প্রয়োজন পড়ে সেটি তাদের সাথে আলাপ-আলোচনা করে সমঝোতার মাধ্যমে ন্যায়ানুগ ক্ষতিপূরণের দাবি জানাচ্ছি।
কিন্তু যে কোনো বিষয়ের দুটি দিক থাকে। গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতালদের নিয়ে যে ঘটনার বর্ণনা বিভিন্ন মিডিয়ায় আলোচিত হচ্ছে তা একটি দিক। এর আরো একটি দিক রয়েছে। সেদিকের সন্ধানে কথাবলি গাইবান্ধার কয়েকজন সাংবাদিক, মোহনগঞ্জ সুগার মিলের কয়েকজন শ্রমিক নেতা, সুগার মিলের এমডি মো. আবদুল আওয়াল ও গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবদুস সামাদের সাথে।
সরকারি খাতায় রংপুর সুগার মিল নাম থাকলেও স্থানীয় ভাষায় এটি মাহিমাগঞ্জ সুগার মিল। গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মাহিমাগঞ্জে এর অবস্থান বলে এর এমন নামকরণ। স্থানটি লালমাটির। পূর্বে টিলা ও বনজঙ্গলে আকীর্ণ ছিল। পাকিস্তান আমলে যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় থাকাকালে কৃষিমন্ত্রী হন আহমদ আলী। তিনি নিজের এলাকায় এই চিনিকল স্থাপন করেন। ১৯৫৪-৫৫ সালে পাকিস্তান সরকার এই সুগার মিল স্থাপনের কাজে হাত দেয়। তখন মিলের আখের চাহিদা মেটানোর জন্য স্থানীয়ভাবে সাহেবগঞ্জ মৌজায় ১৮৪০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে খামারের কাজে ব্যবহৃত হয় ১৫৩২ একর।
স্থানীয় এক সাংবাদিকের মতে, অধিগ্রহণের পূর্বে এই জমির অধিকাংশের মালিকানা ছিল স্থানীয় বাঙালিদের ও সামান্য কিছু ছিল সাঁওতালদের দখলীয়। অধিগ্রহণের সময় যাদের জমি অধিগ্রহণ করা হয় পাকিস্তান সরকার তাদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দেয়। ক্ষতিপূরণ পাওয়ার পর বাঙালি ও সাঁওতালরা জমি ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। কিন্তু এ সময় অল্প কিছু ভূমিহীন সাঁওতাল সেখানে রয়ে যায়। মিল কর্তৃপক্ষ অধিগ্রহণকৃত জমির বন-জঙ্গল পরিষ্কার এবং চাষাবাদের প্রয়োজনে তাদের সেখান থেকে উচ্ছেদ না করে থাকতে দেয়। সেই থেকে তারা সেখানে অবস্থান করলেও কোনো ভূমির মালিক তারা নয়। অন্যদিকে মিল কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময়ে অধিগ্রহণকৃত জমির মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারযোগ্য কিছু জমি সেখানে স্থানীয় বাঙালিদের লিজ দেয়। সম্প্রতি মিল কর্তৃপক্ষ এই লিজ বাতিল করে জমি উদ্ধারের উদ্যোগ নিয়েছে। এতে লিজ পাওয়া বাঙালিরা বিক্ষুব্ধ হয়। তারা মিলকে জমি ছেড়ে না দিয়ে আরো জমি অধিগ্রহণের নিমিত্তে সেখানে নতুন করে সাঁওতাল বসতি স্থাপন শুরু করে। গত কোরবানির ঈদের ছুটির মধ্যে মিলের অধিকাংশ কর্মকর্তা ও শ্রমিক যখন অনুপস্থিত সেই সুযোগে আশপাশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে বিপুল সংখ্যক সাঁওতাল এনে মিলের চাষাবাদ করা জমিতে অস্থায়ী ছাপড়া তুলে বসিয়ে দেয়। মিল কর্তৃপক্ষ ঈদের পর ফিরে এসে দেখতে পায় বিপুল পরিমাণ জমিতে ছাপড়া তুলে নব্য বসতি স্থাপনকারী সাঁওতালদের বসিয়ে দেয়া হয়েছে। এ সময় নতুন সিজনে মিল কর্তৃপক্ষ আখের বীজ রোপণ করার জন্য জমি উদ্ধারে গেলে নতুন ও পুরাতন সাঁওতালরা এবং বাঙ্গালী ভূমি দস্যূরা এক হয়ে পুলিশ ও মিল কর্তৃপক্ষের ওপর তীর ধনুক নিয়ে হামলা করে। প্রথম দিকে তাদের হামলায় কিছু পুলিশ ও মিলের শ্রমিক আহত হলেও পরবর্তীতে অতিরিক্ত সদস্য আনিয়ে পুলিশ নব্য বসতি স্থাপনকারী বাঙালীও সাঁওতালদের আবাসন গুঁড়িয়ে দেয়। তবে পুরাতন সাঁওতালদের বসতিতে এখনো কোনো হস্তক্ষেপ করেনি পুলিশ। তারা সেখানে বহাল তবিয়তে রয়েছে। তার মতে, বাঙালি ভূমিদস্যুরা মিলের জমি গ্রাস করতে আশপাশ থেকে সাঁওতালদের এনে ওখানে বসিয়ে দিয়েছে। তারা আসলে সাঁওতালদের নামে জমি অধিগ্রহণ করিয়ে পরে তাদের উচ্ছেদ করে বা নামমাত্র মূল্যে ক্রয় করে ভোগদখল করার নিমিত্তে সেসব জমিতে সাঁওতালদের এনে বসিয়ে দিয়েছে। এর সাথে জড়িত রয়েছে সরকার দলীয় লোকজন।
জমির অধিগ্রহণ করা দলিলে জমি অন্য কাজে ব্যবহার করা হলে আগের মালিকদের ফিরিয়ে দেয়া হবে এমন কথা লেখা ছিল কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগে যারা ভোগদখল করত তাদের মধ্যে যারা সাঁওতাল তাদের কোনো মালিকানা কাগজ ছিল না। তারা ভোগদখল সূত্রেই মালিক ছিল। তবু পাকিস্তান সরকার তাদের উচ্ছেদ করার সময় ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। অন্যদিকে বেশির ভাগ জমির মালিক যে বাঙালিরা ছিল তাদের জমিও অধিগ্রহণে জমি অন্য কাজে ব্যবহার করা হলে তা মূল মালিকদের ফিরিয়ে দেয়া হবে এমন কোনো শর্ত ছিল না। মিল কর্তৃপক্ষ ও মিলের শ্রমিকদের সাথে কথা বলে তিনি এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছেন বলে জানান।
একই কথা বলেন রংপুর সুগার মিলের এমডি আবদুল আওয়াল। তিনি আমাকে জোর দিয়ে বলেন, তার কাছে মিলের অধিগ্রহণ করার যেসব কাগজ রয়েছে তাতে কোথাও এ ধরনের কথা নেই। স্থানীয় কিছু বিশেষ ভাবাদর্শের সাংবাদিক কোনো যাচাই-বাছাই না করে জমি দখলকারী বা অন্যান্য সূত্রের মৌখিক কথার ভিত্তিতে তারা এ ধরনের রিপোর্ট লিখছে বলেও তিনি জানান। তবে ভূমি অধিগ্রহণ প্রসঙ্গে তিনি একটু ভিন্ন কথা বলেন। অধিগ্রহণকৃত জমির মধ্যে সাঁওতালদের ভোগদখলীয় জমি খুবই সামান্য ছিল বলে তিনি জানান। তার মতে, মিলটি প্রতিষ্ঠার পরপরই চালু করা হয় এবং একটানা ২০০৪ সাল পর্যন্ত চলে। কিন্তু ২০০৪ সালে এসে মিলটিকে লে-অফ ঘোষণা করা হলে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বন্ধ থাকে। ২০০৬ সালে পুনরায় মিলটি চালু হয়ে এখন পর্যন্ত উৎপাদনে রয়েছে। মিলটি লে-অফ ঘোষণা করা হলে এর কিছু জমি সরকারি অনুমতি নিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে লিজ দেয়া হয়। পরে মিলটি পুনরায় উৎপাদনে গেলে কর্তৃপক্ষ এই লিজ বাতিল করে জমি উদ্ধারের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু ভূমির লিজ গ্রহীতারা এটা মেনে নিতে পারেনি। তারা দখলি বহাল রাখতে নানা অজুহাত সৃষ্টি করে। এটা তারই কুফল। তিনি আরো যোগ করে বলেন, ২০১৬ সালের ৩০ জুন তারিখে সাঁওতাল বিদ্রোহের ১৬১তম বার্ষিকী উপলক্ষে তারা এখানে বিভিন্ন এলাকা থেকে সাঁওতালদের এনে বড় ধরনের জমায়েত করে। তারপর দিন অর্থাৎ ১ জুলাই থেকে তারা মিলের জমিতে জোরপূর্বক প্রবেশ করে নতুন বসতি গড়ে তোলে। সঙ্গে সঙ্গে মিল কর্তৃপক্ষ প্রশাসনকে জানায় এবং তার প্রেক্ষিতে ১২ জুলাই একটি উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয় প্রশাসনের তরফ থেকে। কিন্তু পুলিশের সংখ্যা কম থাকায় তারা পুলিশকে তীর-ধনুক নিয়ে আক্রমণ করে বসে। এতে বেশ কয়েকজন পুলিশ ও মিলের শ্রমিক আহত হয়। ফলে পুলিশ পিছু হটতে বাধ্য হয়। এরপর তারা মিলের ওপর হামলা চালিয়ে মিলের নানা স্থাপনা ও যানবাহন ভাঙচুর করে। নিরাপত্তা রক্ষীদের বেদম প্রহার করে। এর প্রেক্ষিতে ১৩ তারিখ পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা করে। এরপর খামারের নিরাপত্তায় এখানে একটি অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। পুলিশের লোকজন এ সময় কোনো অভিযান পরিচালনা করেনি। এরই মধ্যে তারা পুরো ৪ মাস খামারের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে মিলের অনেক শ্রমিককে অপহরণ করে নিয়ে নির্যাতন করলেও পুলিশ কোনো অভিযান পরিচালনা করেনি। এরপর ১ সেপ্টেম্বর থেকে নতুন ইক্ষু বীজ রোপণের মৌসুম শুরু হলে কর্তৃপক্ষ সেখানে ইক্ষু রোপণ করতে গেলে তারা মিলের শ্রমিক ও কর্মকর্তাদের ওপর আক্রমণ করে তীরবিদ্ধ করে, তাদের ক্যাম্পে তুলে নিয়ে যায়। মিল কর্তৃপক্ষের রোপণ করা ইক্ষু তুলে নিয়ে যায়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের লিখিত নির্দেশ থাকার পরও পুলিশ এ সময় কোনো অভিযান পরিচালনা করতে যায়নি এই তীর-ধনুকের আঘাতে আহত হওয়ার ভয়ে এবং এখন যে ইস্যু তারা তুলেছে সেটার কথা বিবেচনা করে। সর্বশেষ গত ৬ তারিখে মিলের ২৭ একর জমিতে বীজ রোপণ করার জন্য চাষিদের নিরাপত্তায় পুলিশের সহায়তা চাওয়া হয়। এ সময় তারা ক্যাম্প থেকে ঢোল বাজিয়ে তীর-ধনুক সহকারে চাষি ও পুলিশের ওপর আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে এগোতে থাকে এবং মিলের গাড়ি ভাঙচুর করে। এ সময় পুলিশ আত্মরক্ষার্থে ফাঁকা গুলি ও রাবার বুলেট ছোঁড়ে। এ সময় এলাকাবাসীও পুলিশের সাথে যোগ দেয় এবং তাদের ধাওয়া দেয়। এ প্রেক্ষিতে সেখানে আরো অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। তখন তারা পিছু হটে চলে যায়।
কথা হয় গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক মো. আবদুস সামাদের সাথে। তিনি বলেন, অধিগ্রহণ আইন ১৯৪৮, ১৯৮৪ এবং সর্বশেষ ১৯৯৮ সালে সংশোধন করা হয়। সেই আইনে অধিগ্রহণ করা জমি ফেরত দিলে ডিসি বা কালেক্টর তার দায়িত্ব নেন এবং তারা সিদ্ধান্ত নেন কোন কাজে ব্যবহার করা হবে। যেহেতু ক্ষতিপূরণ দিয়ে কিনে নেয়া জমি তাই মালিকের ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে যদি পুরনো আইনের কথা বলা হয়, তাহলে তা উপযুক্ত আদালতে গিয়ে শুনানির পর আদালতের নির্দেশ নিয়ে আসতে হবে, এভাবে গায়ের জোরে দখল করা চলবে না। ওই সময়ের চুক্তিতে এমন কথা ছিল কিনা তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, যদি থেকেও থাকে তাহলেও সর্বশেষ আইন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত হবে, নতুবা আদালতের আদেশ নিয়ে আসতে হবে। তবে সেখানে এমন কোনো কথা ছিল না, সরকার সিদ্ধান্ত নেবে এমন কথা ছিল।
উপর্যুক্ত তিনজনের বক্তব্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অধিগ্রহণকৃত জমি অন্য কাজে ব্যবহার নয় বরং লিজ বা দখলীয় সূত্রে অন্য কাজে ব্যবহৃত অধিগ্রহণকৃত ভূমি মূল কাজে অর্থাৎ ইক্ষু চাষের কাজে ব্যবহারের জন্য পুনরুদ্ধার করতে গিয়েই সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু মিডিয়ায় আলোচিত হচ্ছে সম্পূর্ণ উল্টোটি। সে ক্ষেত্রে অন্য কাজে ব্যবহৃত জমি মূল মালিককে ফিরিয়ে দেয়ার দাবী অপ্রাসঙ্গিক।
বাংলাদেশে সাঁওতাল সম্প্রদায়
গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতালদের নিয়ে কিছু গণমাধ্যম ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের অংশ বিশেষ সাঁওতালদের একচেটিয়া আদিবাসী আখ্যা দিচ্ছে। এ তথ্যটি সম্পূর্ণ ভুল। বাংলাদেশে সাঁওতালরা কোনোভাবেই আদিবাসী নয়। সাঁওতালদের বাংলাদেশে আগমনের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ভারতবর্ষের প্রাচীন জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাঁওতাল অন্যতম হলেও বাংলাদেশে তাদের আগমন ব্রিটিশ আমলে। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, ব্রিটিশ সরকার রেল লাইন নির্মাণ কাজের জন্য ভারতের সাঁওতাল পরগনা থেকে সাঁওতালদের বাংলাদেশে নিয়ে আসে। এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রণীত বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সমীক্ষামালায় বাংলাদেশে সাঁওতালদের আগমন সম্পর্কে বলা হয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে সাঁওতালরা ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে বসবাস করছিলেন। ১৮৩৬ সালে ব্রিটিশ সরকার তাদেরকে নির্বিঘেœ বসবাসের জন্য একটি স্থায়ী এলাকা নির্ধারণ করে দেয়। এ এলাকা সাঁওতাল পরগনা নামে খ্যাত হয়। সাঁওতাল বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ার পর তাদের অনেকে সাঁওতাল পরগনায় থাকা নিরাপদ মনে না করে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েন। ড. পিয়ের বোসাইনেট উল্লেখ করেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) সাঁওতালদের অধিকাংশই সাঁওতাল পরগনা থেকে এখানে আগমন করেছেন। রাজশাহী বা উত্তরবঙ্গে সাঁওতালদের আগমনের ইতিহাস পর্যালোচনা করেও একই তথ্য পাওয়া যায়।
উপমহাদেশে সাঁওতালদের আদি নিবাস ছিল ভারতের দামিন-ই-কোহ অঞ্চল, কটক, ডালভূম, মানভূম, ছোটনাগপুর, পালামৌ, হাজারীবাগ, মেদনীপুর, বাকুরা, বীরভূম জেলায়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর সাঁওতালরা তাদের কালেক্টিভ ভূমির অধিকার হারিয়ে স্থানীয় জমিদারদের অন্যায় ও অত্যাচারের শিকার হয়। এর বিরুদ্ধে ১৮৫৫-৫৭ সালে উপমহাদেশে বিখ্যাত সাঁওতাল বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। বিদ্রোহকে সাঁওতালদের ভাষায় ‘হুল’ বলা হয়। কানু ও সিধুর নামে এই সাঁওতাল বিদ্রোহ প্রসিদ্ধ হলেও এর নায়ক ছিলেন চার ভ্রাতা সিধু-কানু-চাঁদ-ভৈরব এবং তাদের দুই বোন ফুলো মুর্মু ও ঝানো মুর্মু। ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন তাদের আহ্বানে ৪ শতাধিক গ্রামের প্রায় ১০ হাজার সাঁওতাল দামিন-ই-কোহ অঞ্চলের বর্তমান ঝাড়খন্ড রাজ্যের ভগনাডিহি গ্রামে জমায়েত হয় এবং ব্রিটিশ সরকার ও তাদের দেশীয় দালাল শ্রেণি জমিদার, সুদখোর, মহাজন, ব্যবসায়ী, কন্ট্রাক্টর, পুলিশ-দারোগা, ভূমি অফিসারের কর্মচারী এবং বরকন্দাজদের জুলুম অত্যাচার নির্যাতনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুক্তির সংগ্রাম গড়ে তোলে। এ সময় তারা ব্রিটিশ সরকারের কাছে তাদের দাবি তুলে ধরার উদ্দেশ্যে কলকাতার উদ্দেশ্যে পদযাত্রা শুরু করলে পথে অন্যান্য প্রতিবাদী জনগোষ্ঠীও তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। এতে এই পদযাত্রা বিপুল আকার ধারণ করে। কিন্তু জমিদাররা ভয় পেয়ে এই পদযাত্রায় আক্রমণ করলে কানু ও সিধু বিদ্রোহ ঘোষণা করে স্বাধীন সাঁওতাল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ডাক দেন। ফলে ব্রিটিশ সরকারও এ বিদ্রোহ দমনের উদ্যোগ নেয়। শুরুতে তীর-ধনুক দিয়েও সাঁওতালরা ব্রিটিশ বাহিনী ও স্থানীয় জমিদারদের কাবু করে ফেলতে সক্ষম হলেও পরে বিশাল ব্রিটিশ বাহিনীর আক্রমণে আর টিকতে পারেনি। বিদ্রোহের প্রধান নেতাদের আটক করে ব্রিটিশ সরকার গুলি করে ও ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে এ বিদ্রোহ দমন করে। সাঁওতাল বিদ্রোহের পর তাদের ওপর ব্রিটিশ সরকার ও জমিদারদের অত্যাচার আরো বেড়ে যায়। এ সময় কাজের সন্ধানে সাঁওতালরা পূর্ববঙ্গে আসতে শুরু করে। এ সময় ব্রিটিশ সরকার ঈশ্বরদী-পার্বতীপুর রেল লাইন নির্মাণ কাজে জঙ্গল পরিষ্কার ও মাটি কাটার জন্য ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে সাঁওতালদের পূর্ববঙ্গে নিয়ে আসে। স্থানীয় জমিদাররাও তাদের জমিদারির জঙ্গলাকীর্ণ জমি পরিষ্কার করে চাষাবাদের জন্য সাঁওতালদের ব্যবহার করতে শুরু করে। শুরুতে এরা বছরের নির্দিষ্ট সময় কাজ করে আবার তাদের আদি নিবাসে ফিরে যেত। কিন্তু ধীরে ধীরে তারা পরিত্যক্ত ও জমিদারির অব্যবহৃত জায়গায় অস্থায়ী বসতি গড়তে শুরু করে। সরকার ও জমিদাররাও তাদের কাজের সুবিধার্থে এই বসতিতে বাধা প্রদান করেনি। এদের মধ্যে যারা কিছুটা সম্পদশালী হন তারা বিভিন্ন স্থানে ক্রয়সূত্রে কিছু জমির মালিক হলেও সাধারণভাবে এই অঞ্চলের সাঁওতালরা কোনো জমির মালিক নয়। স্থানীয় এমপি, শিল্প সচিব ও গণমাধ্যমকে একই কথা বলেছেন। নওগাঁ, সাপাহার, পতœীতলা, জয়পুরহাট হয়ে হিলি পর্যন্ত বিস্তৃত সাঁওতালদের ক্ষেত্রে একই ইতিহাস প্রযোজ্য। ব্রিটিশ প্রশাসক ও প-িত এলএসএস ও’মেলে ১৯১৬ সালে তার প্রণীত রাজশাহী ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারে সাঁওতাল, মালপাহাড়ি, ওরাও, হো উপজাতির এ অঞ্চলে আগমন সম্পর্কে একই কথা বলেছেন।
অন্যদিকে আইএলও কনভেশন ১৬৯ অনুযায়ীও সাঁওতালরা আদিবাসী নয়। কেননা তাদের আগমনের ইতিহাস বিস্মৃতপূর্বকালের বা অজানা নয়। তারা বাংলাদেশে কোনো উপনিবেশ সৃষ্টির পূর্বেও আসেনি। কিংবা সাংস্কৃতিকভাবেও তারা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নয়। কারণ বাংলাদেশের সাঁওতালদের অধিকাংশই এখন আর তাদের আদি সাঁওতাল ধর্মের অনুসারী নয়। নিজস্ব ধর্ম অনুযায়ী সাঁওতালরা জড় উপাসক, যেখানে সূর্য তাদের মূল দেবতা। কিন্তু বর্তমানে সাঁওতালদের অধিকাংশই ধর্ম পরিবর্তন করে খ্রিস্টান হয়েছে। খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণ করায় তাদের ধর্মীয়, ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনযাপনে ও সংস্কৃতিতে আমূল পরিবর্তন এসেছে। তবে এ কথা ঠিক, বাংলাদেশের কোনো উপজাতি যখন ধর্ম পরিবর্তন করে ইসলাম গ্রহণ করে তখন তাকে আদিবাসী বলা হয় না, কিন্তু খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণ করলে তাকে আদিবাসী সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হতেও বাধার সম্মুখীন হতে হয় না। এই প্যারাডক্সের মূল্যায়ন দেশবাসী করবেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, মহল বিশেষ সাঁওতালদের কেন আদিবাসী আখ্যা দিতে উঠেপড়ে লেগেছে?
২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ৬১তম অধিবেশনে আদিবাসী বিষয়ক একটি ঘোষণাপত্র উপস্থাপন করা হয়। এ ঘোষণাপত্র উপস্থাপিত হলে ১৪৩টি দেশ প্রস্তাবের পক্ষে, ৪টি দেশ বিপক্ষে, ১১টি দেশ ভোটদানে বিরত এবং ৩৪টি দেশ অনুপস্থিত থাকে। ভোটদানে বিরত থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া দেশগুলো হচ্ছেÑ অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্র। এই ঘোষণাপত্রে সর্বমোট ৪৬টি অনুচ্ছেদ রয়েছে। এসব অনুচ্ছেদের বেশ কয়েকটি অনুচ্ছেদ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অগ্রহণযেপগ্য সার্বভৌমত্ব, অখ-তা, অস্তিত্ব, কর্তৃত্ব, সংবিধান ও আত্মপরিচয়ের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। অনুচ্ছেদগুলো এখানে উল্লেখ করা হলো :
অনুচ্ছেদ-৩ : আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার রয়েছে। সেই অধিকার বলে তারা অবাধে তাদের রাজনৈতিক মর্যাদা নির্ধারণ করে এবং অবাধে তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মপ্রয়াস অব্যাহত রাখে।
অনুচ্ছেদ-৪ : আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার উপভোগের বেলায়, তাদের অভ্যন্তরীণ ও স্থানীয় বিষয়ে তথা স্বশাসিত কার্যাবলীর অর্থায়নের পন্থা ও উৎস নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাদের স্বায়ত্তশাসন বা স্বশাসিত সরকারের অধিকার রয়েছে।
অনুচ্ছেদ-৫ : আদিবাসী জনগণ যদি পছন্দ করে তাহলে রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণের পূর্ণ অধিকার রেখে তাদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক, আইনগত, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান অক্ষুণœ রাখা ও শক্তিশালীকরণের অধিকার লাভ করবে।
অনুচ্ছেদ-৬ : আদিবাসী ব্যক্তির জাতীয়তা লাভের অধিকার রয়েছে।
অনুচ্ছেদ-১৯ : রাষ্ট্র আদিবাসীদের প্রভাবিত করতে পারে এমন আইন প্রণয়ন কিংবা প্রশাসনিক সংক্রান্ত পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়নের পূর্বে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর স্বাধীন ও পূর্বাবহিত সম্মতি নেয়ার জন্য তাদের প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সাথে আন্তরিকত্ব সদিচ্ছার সাথে আলোচনা ও সহযোগিতা করবে।
অনুচ্ছেদগুলো থেকে স্পষ্ট প্রতিভাত হয়, বাংলাদেশের সাঁওতাল বা অন্যান্য উপজাতীয় জনগোষ্ঠী আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি পেলে বাংলাদেশের ভেতর কমপক্ষে ৪৫টি স্বায়ত্তশাসিত বা স্বশাসিত অঞ্চল ও সরকার ব্যবস্থার সৃষ্টি হবে। এসব অঞ্চলে সরকার পরিচালনায় তারা নিজস্ব রাজনৈতিক কাঠামো, জাতীয়তা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, আইন প্রণয়ন ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার পাবে এবং এসব অঞ্চলের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের অধিকার ও কর্তৃত্ব ক্ষুণœ হবে।
এই ঘোষণাপত্রে আদিবাসীদের ভূমির ওপর যে অধিকারের কথা বলা হয়েছে তা আরো ভয়ানক। যেমন :
অনুচ্ছেদ-১০ : আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে তাদের ভূমি কিংবা ভূখ- থেকে জবরদস্তিমূলকভাবে উৎখাত করা যাবে না। আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে তাদের স্বাধীন ও পূর্ববহিত সম্মতি ছাড়া কোনোভাবে অন্য এলাকায় স্থানান্তর করা যাবে না এবং ন্যায্য ও যথাযথ ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে সমঝোতা সাপেক্ষে স্থানান্তর করা হলেও যদি কোনো সুযোগ থাকে, পুনরায় তাদেরকে সাবেক এলাকায় ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
অনুচ্ছেদ-২৬ : ১. আদিবাসী জনগোষ্ঠীর তাদের ঐতিহ্যগতভাবে মালিকানাধীন, দখলীয় কিংবা অন্যথায় ব্যবহার্য কিংবা অধিগ্রহণকৃত জমি, ভূখ- ও সম্পদের অধিকার রয়েছে।
২৬ : ৩. রাষ্ট্র এসব জমি, ভূখ- ও সম্পদের আইনগত স্বীকৃতি ও রক্ষার বিধান প্রদান করবে। সংশ্লিষ্ট আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রথা, ঐতিহ্য এবং ভূমি মালিকানা ব্যবস্থাপনা মেনে সেই স্বীকৃতি প্রদান করবে।
অনুচ্ছেদ-২৭ : রাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সাথে যৌথভাবে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আইন, ঐতিহ্য, প্রথা ও ভূমি মালিকানাধীন ব্যবস্থাপনার যথাযথ স্বীকৃতি প্রদান করবে।
অনুচ্ছেদ-২৮ : ১. আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমি, ভূখ- ও সম্পদ যা তাদের ঐতিহ্যগতভাবে মালিকানাধীন কিংবা অন্যথায় দখলকৃত বা ব্যবহারকৃত এবং তাদের স্বাধীন ও পূর্বাবহিত সম্মতি ছাড়া বেদখল, ছিনতাই, দখল বা ক্ষতিসাধন করা হয়েছে এসব যাতে ফিরে পায় কিংবা তা সম্ভব না হলে একটা ন্যায্য, যথাযথ ও উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পায় তার প্রতিকার পাওয়ার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার রয়েছে।
২৮ : ২. সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠী স্বেচ্ছায় অন্য কোনো কিছুতে রাজি না হলে ক্ষতিপূরণ হিসেবে গুণগত, পরিমাণগত ও আইনি মর্যাদার দিক দিয়ে সমান ভূমি, ভূখ- ও সম্পদ অথবা সমান আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে বা অন্য কোনো যথাযথ প্রতিকার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
অনুচ্ছেদ-৩০ : ১. আদিবাসী জনগোষ্ঠীর স্বেচ্ছায় সম্মতি জ্ঞাপন বা অনুরোধ ছাড়া ভূমি কিংবা ভূখ-ে সামরিক কার্যক্রম হাতে নেয়া যাবে না।
অনুচ্ছেদ-৩২ : ২. রাষ্ট্র আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমি, ভূখ- ও সম্পদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে এমন কোনো প্রকল্প অনুমোদনের পূর্বে, বিশেষ করে তাদের খনিজ, জল কিংবা অন্য কোনো সম্পদের উন্নয়ন, ব্যবহার বা আহরণের পূর্বে স্বাধীন ও পূর্বাবহিত সম্মতি গ্রহণের জন্য তাদের নিজস্ব প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সাথে আলোচনা ও সহযোগিতা করবে।
উদ্ধৃত অনুচ্ছেদগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশের সাঁওতাল বা অন্যান্য উপজাতীয় জনগোষ্ঠী আদিবাসী স্বীকৃতি পেলে উত্তরাঞ্চল ও পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারা দেশে নিজস্ব আইনে নিজস্ব ভূমি ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পারবে। এত দিন পার্বত্য চট্টগ্রামের মুষ্টিমেয় চিহ্নিত উপজাতিরা দাবি করছে, ঐতিহ্য ও প্রথাগত অধিকার বলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল ভূমির মালিক তারা। একই অধিকারবলে সমতলের উপজাতীয় অধ্যুষিত এলাকার সকল ভূমির মালিকানা সেখানকার উপজাতীয়রা দাবি করবে। এর শুরুটা হয়েছে সাঁওতালদের দিয়ে। সেখানে যেসব ভূমি সরকারি ও ব্যক্তিগত মালিকানায় (উপজাতিদের নয়) রয়েছে তা ফেরত দিতে হবে বা তার উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এমনকি উপজাতীয়রা রাজি না হলে সমতল থেকে সমপরিমাণ সমগুরুত্বের ভূমি ফেরত দিতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে যেহেতু ওই গোষ্ঠী সকল সামরিক স্থাপনা সরিয়ে নেয়ার দাবি জানাচ্ছে, সে কারণে সেখান থেকে সকল সামরিক স্থাপনা সরিয়ে নিতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও অন্যান্য উপজাতি অধ্যুষিত এলাকায় যেসব বাঙালি বসতি স্থাপন করেছে তাদের ফিরিয়ে আনতে হবে। ইউএনডিপিসহ কিছু বৈদেশিক সংস্থা ইতোমধ্যে প্রকাশ্যে এ দাবি তুলেছে।
অন্যদিকে সরকার ২০১৬ সালের ৬ অক্টোবর পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন-২০০১ এর সংশোধনী ২০১৬ পার্লামেন্টে পাস করেছে। এই আইনের ৬(ক) ধারায় বলা হয়েছে, “পুনর্বাসিত শরণার্থীদের ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ এবং অবৈধ বন্দোবস্ত ও বেদখল হওয়া ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী নিষ্পত্তি করা হবে।”
শান্তি চুক্তি, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ও জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক চার্টারের শর্তগুলো পাশাপাশি রেখে আলোচনা করলে আমাদের কাছে পুরো বিষয়টি অত্যন্ত পরিষ্কার হয়ে উঠবে। এসব দাবি ও আন্দোলনের ফোকাল পয়েন্ট হলো বাংলাদেশের উপজাতি বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকদের তাদের অধিকৃত বা বসতি বা দখলীয় জায়গার ওপর স্বায়ত্তশাসন, আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার, কর্তৃত্ব ও স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা করা। এর মাধ্যমে তারা সরকার ও রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব, মর্যাদা ও অধিকারকে ক্ষুণœ করে সংবিধান বিরোধী স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠায় লিপ্ত।
দখল যার জমি তার কিংবা প্রথা, রীতি অনুযায়ী জমির মালিকানার এই যে দাবি, এই যে দাবি আদায়ের সুর ও প্রক্রিয়া, সহিংসতা, গোয়ার্তুমির এই প্যাটার্নটি বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে আমদানি হয়েছে। এখানেও দখলীয় সত্ত্বকে প্রথা ও রীতির নামে মালিকানা বলে দাবী করা হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতীয় আঞ্চলিক সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে সেখানে একই পদ্ধতিতে ভূমি অধিকারের দাবিতে সশস্ত্র সংগ্রাম করে আসছে। এখন একই ধরনের আন্দোলন ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে সমতলেও। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, পাহাড়ে সশস্ত্র উপজাতীয় সংগঠনগুলোর আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন ব্যক্তি, সংগঠন, প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমগুলো গোবিন্দগঞ্জেও একইভাবে সমর্থন দিয়ে আসছে। এমনকি সন্তু লারমাসহ বিভিন্ন পাহাড়ি নেতা বর্তমানে বিভিন্ন ব্যানারে সমতলের উপজাতিদের অধিকারের দাবিতে সোচ্চার এবং তাদের আন্দোলনে সমর্থন জানাতে ছুটে যাচ্ছেন। পাহাড়ের মতো সমতলের উপজাতিদের জন্য একটি স্বতন্ত্র ভূমি কমিশন গঠনের জোর দাবিও জানানো হয়েছে। জাতীয় ভূমি নীতিমালার খসড়াতে উপজাতিদের আদিবাসী ঘোষণা করে তাদের ভূমি বিরোধ প্রচলিত রীতি ও প্রথা অনুযায়ী নিষ্পত্তির কথা বলা হয়েছে। এটি ভয়াবহ ও সুদূরপ্রসারী বিপর্যয় ডেকে আনবে। কাজেই বিষয়টি বিচ্ছিন্নভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। পাহাড়ের আন্দোলনকে এতদিন সমতলের মানুষ বিচ্ছিন্নভাবে অবজ্ঞা করেছে, আজ সেই আন্দোলনের ঢেউ সমতলে ছড়িয়ে পড়ছে। এখনই সময় বিষয়টাকে সামগ্রিক ও জাতীয়ভাবে গুরুত্বসহ পর্যবেক্ষণ ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের।
email: palash74@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন