শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

বিনিয়োগের সুবর্ণ সুযোগ

দুই বছরের করোনায় অর্থনৈতিক সঙ্কট পরিত্রাণ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২৮ মে, ২০২২, ১২:০০ এএম

নতুন বাজেট আসছে। তার আগে অর্থমন্ত্রী দেশে বিনিয়োগের সুবর্ণ সুযোগের ইঙ্গিত দিয়েছেন। দেশের স্বার্থে কখনো কখনো যে উদার নীতি গ্রহণ করতে হয় সেটার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। কালো টাকা বা সাদা টাকা বিতর্ক নয়, বিদেশে যারা বিনিয়োগ করেছেন, বাড়ি-শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন এবং বিদেশে টাকা পাচার করেছেন তাদের সবাই বিনা বাধায় দেশে অর্থ ফিরিয়ে এনে নির্বিঘ্নে বিনিয়োগ করতে পারবেন। বিগত দুই বছর করোনায় অর্থনীতিতে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সেখান থেকে উত্তোরণের লক্ষ্যে এই উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। বাজেট ঘোষণার আগে অর্থমন্ত্রীর এমন ঘোষণা ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন দেশের ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা। গত ১২ মে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, বিভিন্ন সময় নানাভাবে যদি টাকা বিদেশে কেউ নিয়ে থাকে, সেগুলো দেশে ফেরত আসবে। এমন সুবিধা দেব, যাতে সবাই টাকা নিয়ে ফিরে আসে। এ ধারাবাহিকতায় গত ২৬ মে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকের পর অর্থমন্ত্রী জানান, বিদেশে টাকা পাচারকারীদের সাধারণ ক্ষমার আওতায় আনা হচ্ছে। একই সঙ্গে আগামী বাজেটে ট্যাক্স দিয়ে পাচার হওয়া টাকা বৈধ পথে দেশে ফিরিয়ে আনার সুযোগ দেয়া হবে। যারা টাকা পাচার করেছে তারা কি ট্যাক্স দিয়ে ‘রেকর্ড’ হতে চাইবে কিনাÑ সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, বিভিন্ন দেশে তো এ সুযোগ অনেকে নিয়েছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, এর মাধ্যমে অর্থ পাচারকারীরা কিছুটা উৎসাহীত হতে পারেন। তবে এটা গভীর পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। কারণ অর্থ পাচারকারীরা খুবই সাবধানী। এরা চট করে বেশি অঙ্কের টাকা নাও পাঠাতে পারেন। অল্প অল্প করে পাঠাবেন। সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। পাচারকারীরা একদিকে টাকা আনবে, অন্যদিকে নিয়ে যাবে। মাঝখানে আড়াই শতাংশ প্রণোদনা উপভোগ করবে।

বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি, এফবিসিসিআই’র সাবেক সহ-সভাপতি ও আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক মো. সিদ্দিকুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে পাচার হওয়া টাকা বৈধ পথে দেশে ফিরিয়ে আনার সুযোগ একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। দীর্ঘদিন বিভিন্ন দেশে পাচার হওয়া এ অর্থ দেশে আসলে দেশের অর্থনীতি আরো গতিশীল হবে।

মহামারি করোনার সংক্রমণ শুরুর পর আন্তর্জাতিক বাজারে ভোগ্যপণ্য, কাঁচামাল, জ্বালানি তেলসহ প্রায় সব পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। চলমান রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পণ্যের দাম আরো বেড়েছে। পাশাপাশি বেড়েছে জাহাজের ভাড়াও। এর প্রভাবে আমদানি ব্যয়ও লাগামহীনভাবে বেড়ে যাচ্ছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ পড়েছে। আমদানি ব্যয় পরিশোধের চাপে মার্কিন ডলারের ব্যাপক চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু সেই হারে বাজারে সরবরাহ না বাড়ায় নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়ছে ডলারের দাম। খোলাবাজারে ১০২ টাকায়ও ডলার বিক্রি হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বিক্রি করেও ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে পারছে না।

এদিকে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম খাত রেমিট্যান্স প্রবাহ কমছে। অপরদিকে আমদানি যে হারে বেড়েছে, রফতানি সে হারে বাড়েনি। রফতানি আয়ে প্রবৃদ্ধি ভালো থাকলেও যুদ্ধের কারণে এতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সার্বিকভাবে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হচ্ছে। ফলে প্রতি মাসে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। এ কারণে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে জোগান দিতে হচ্ছে আমদানির খরচ। এ অবস্থায় চলতি হিসাবের লেনদেন ভারসাম্যে সবচেয়ে বড় ঘাটতি তৈরি হয়েছে। চাপ বাড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর। যদিও জাতয়ি রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ইতোমধ্যে ১৩৫ বিলাসবহুল ও বিদেশি পণ্য আমদানিতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্কারোপ করেছে। পাশাপাশি গাড়ি ও ইলেকট্রনিকস ব্যবহার্য পণ্য আমদানিতে ৭০ শতাংশ টাকা জমা দেয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে ডলারের সঙ্কট কাটাতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বন্ধ করা হয়েছে। এ ছাড়া কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের বাস্তবায়ন পিছিয়ে দেয়ার কথাও ভাবছে সরকার।

আ হ ম মুস্তফা কামাল জানান, বিদেশে টাকা পাচারকারীদের সাধারণ ক্ষমার আওতায় আনা হচ্ছে। একই সঙ্গে আগামী বাজেটে ট্যাক্স দিয়ে পাচার হওয়া টাকা বৈধ পথে দেশে ফিরিয়ে আনার সুযোগ দেয়া হবে। যারা টাকা পাচার করেছে তারা কি ট্যাক্স দিয়ে ‘রেকর্ড’ হতে চাইবে কিনাÑ সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, বিভিন্ন দেশে তো এ সুযোগ অনেকে নিয়েছে। ইন্দোনেশিয়ায় যখন এমন একটি অ্যামনেস্টি (সাধারণ ক্ষমা) ঘোষণা করল, তখন অনেক টাকা ফেরত এলো। আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের এখান থেকে যারা টাকা নিয়ে গেছে, তারা এ সুযোগটি কাজে লাগাবে। তাদের জন্য এটি অত্যন্ত ভালো সুযোগ। আমাদের সমস্ত দিক থেকেই চেষ্টা করতে হবে। যেসব টাকা বিভিন্ন চ্যানেলে চলে গেছে, সেগুলো ফেরত আনার জন্য এ উদ্যোগ। এ ধরনের অ্যামনেস্টি (সাধারণ ক্ষমা) বিভিন্ন দেশ দিয়ে থাকে বলে জানান মন্ত্রী। অর্থমন্ত্রীর প্রত্যাশা ট্যাক্স দিয়ে পাচার হওয়া টাকা বৈধ পথে দেশে ফিরিয়ে আনার সুযোগে দেশে নতুন নতুন বিনিয়োগের পথ সৃষ্টি করবে।
সম্ভাব্য অর্থনৈতিক সঙ্কট এড়াতে অর্থমন্ত্রীর এ চিন্তাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন আর্থিক খাত সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, অর্থ পাচার বড় ধরনের অপরাধ। তবে এ মুহূর্তে পাচার করা টাকার কিছু অংশও ফেরত আসলে তা দেশের উপকারে আসবে। সে বিবেচনায় এই ছাড় একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। এতে কালো টাকা বা পাচারের অর্থ সহজেই দেশে ফেরত আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশিদুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতিও বিপর্যস্ত। ইতোমধ্যে খাদ্যপণ্যের দামে এর প্রভাব পড়েছে। হু হু করে বাড়ছে ভোগ্যপণ্যের দাম। চাপে রয়েছে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণি। তাই দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরত আনার অর্থমন্ত্রীর সময়োপযোগী এ চিন্তা ডলার সঙ্কট কমার পাশাপাশি বৈধপথে রেমিট্যান্সও বাড়াবে।

সূত্র মতে, স্বাধীনতার ৪৬ বছরে দেশ থেকে কমপক্ষে আট লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে বলে সম্প্রতি জানিয়েছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি। এই টাকা উদ্ধার করে তা দেশের জাতীয় বাজেটে খরচ করার প্রস্তাব দিয়েছে সংগঠনটি। ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালেই বাংলাদেশ থেকে ৪ হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ সোয়া ৪ লাখ কোটি টাকা। এছাড়া সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, শুধু সুইস ব্যাংকেই বাংলাদেশিদের টাকা জমা আছে প্রায় ৫ হাজার ২০৩ কোটি টাকা। দেশের আমলা, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীসহ যেসব বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই অর্থ পাচার করেছেন, নামমাত্র কর দিয়ে সেগুলো দেশে ফিরিয়ে আনাই সরকারের উদ্দেশ্য। আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে এ বিষয়ে অবতারণা করা হচ্ছে।

এর আগে গত অর্থবছরে অপ্রদর্শিত বা কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেয়ায় দেশের অর্থনীতিতে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ এসেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ২০ হাজার ৬০০ কোটি অপ্রদর্শিত বা কালোটাকা সাদা হয়েছে। প্রায় ১২ হাজার করদাতা এই টাকা সাদা করেছেন। সব মিলিয়ে সরকার কর পেয়েছে ১ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা। ওই সময়ে কালো টাকা সাদা করার তালিকায় ছিলেন চিকিৎসক, সরকারি চাকরিজীবী, তৈরি পোশাক রফতানিকারক, ব্যাংকের উদ্যোক্তা মালিক, স্বর্ণ ব্যবসায়ীসহ আরও অনেকে।

যদিও চলতি অর্থবছরেও ২৫ শতাংশ কর এবং ১০ শতাংশ জরিমানা প্রদান সাপেক্ষে কর বহির্ভূত অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। একই রকম শর্তে ফ্ল্যাট, ব্যাংক আমানত এবং সঞ্চয়পত্রের মতো অঘোষিত সম্পত্তিকে বৈধ করার সুযোগও রয়েছে। ফ্ল্যাটের আকার ও অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে জরিমানাসহ প্রতি বর্গ মিটারের জন্য ২০০-৬০০০ টাকা দিয়ে বৈধ করা যাবে। এছাড়া, কালো টাকা বন্ড, অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং হাইটেক পার্কে ১০ শতাংশ কর দেয়ার মাধ্যমে বিনিয়োগ করা যেতে পারে।

তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্র বলছে, অর্থ পাচারকারীদের তালিকা তৈরি করবে সরকার। তবে যারা নিজ থেকেই নিজেকে পাচারকারী বলে ঘোষণা দেবে, তাদের জন্য সাধারণ ক্ষমা থাকবে। একই সঙ্গে যারা নিজ থেকেই ঘোষণা দেবে তাদের পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরত আনার একটি কৌশল হচ্ছে সম্পদ বিদেশে রেখেই তাদের কাছ থেকে কর সংগ্রহ করবে সরকার। এটি হচ্ছে বাড়ি-গাড়ির মতো স্থাবর সম্পদের ক্ষেত্রে। অন্যটি হচ্ছে নগদ অর্থ ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে। বিদেশে ইতোমধ্যে যারা সম্পদ গড়েছেন, আয়কর রিটার্নে তারা তা দেখাতে পারবেন। এ জন্য তাদের কোনো প্রশ্ন করা হবে না।
গত ১২ মে অর্থমন্ত্রীর ঘোষণার পর ২৩ মে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রজ্ঞাপন জারি করে, এখন থেকে রেমিট্যান্স হিসাবে পাঠানো পাঁচ লাখ টাকার বেশি অর্থের উৎস দেশে-বিদেশে কোথাও জানতে চাওয়া হবে না। ফলে প্রবাসী আয় বাবদ দেশে যত অঙ্কের ডলার পাঠানো হোক না কেন, তার উৎস নিয়ে কোনো প্রশ্ন করবে না বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো। আবার এর বিপরীতে আড়াই শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনাও দেয়া হবে। এর আগে পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার বা পাঁচ লাখ টাকার বেশি রেমিট্যান্স পাঠাতে আয়ের নথিপত্র জমা দিতে হতো। যে কারণে এর চেয়ে বেশি অর্থ একবারে পাঠাতে পারতেন না বিদেশে থাকা বাংলাদেশিরা। নতুন সিদ্ধান্তের ফলে বিদেশ থেকে তাদের টাকা আনতে আর কোনো বাধা থাকবে না।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, পাঁচ হাজার ডলার অথবা পাঁচ লাখ টাকার বেশি প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে প্রণোদনা প্রদানে রেমিটারের কাগজপত্র বিদেশের এক্সচেঞ্জ হাউজ থেকে প্রেরণের বাধ্যবাধকতা আছে। তবে এখন থেকে বৈধ উপায়ে দেশে রেমিট্যান্স প্রেরণের বিপরীতে রেমিট্যান্স প্রণোদনা প্রদানে রেমিটারের কাগজপত্র ছাড়াই আড়াই শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা প্রযোজ্য হবে। প্রজ্ঞাপন জারির সঙ্গে সঙ্গে নির্দেশনাটি কার্যকর হয়েছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন