অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, দেশের আর্থিক খাতে কোনো দুর্বৃত্তায়ন নেই। তিনি বলেন, সারাবিশ্বে সঙ্কটের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতি অন্যদের তুলনায় ভালো গতিতে এগিয়েছে। এর আগে আর্থিক খাত দুর্বল নেতৃত্বে চলছে বলে মন্তব্য করেছিলেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, আমি তার (ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য) প্রতি সম্মান ও বিশ্বাস রেখে বলতে পারি, সারাবিশ্বে সঙ্কটের মাঝে বাংলাদেশের অর্থনীতি যেভাবে আমরা এগিয়ে নিয়েছি আমার মনে হয় দিস ইজ বেস্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এটাই সেরা প্রশাসন)।
গতকাল সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী এসব কথা বলেন। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, অন্যদের সঙ্গে তুলনা করলেও বুঝতে পারবেন, আমরা ভালো আছি। কেউ যদি ভালো সময়ের সঙ্গে এই সময় মিলানোর চেষ্টা করে, তাহলে মিলানো যাবে না। এটা যদি একই রকম না হয় তাহলে কার সঙ্গে কার কম্পেয়ার (তুলনা) করবেন? আসন্ন বাজেট নিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, আসন্ন ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাবে অনিশ্চয়তা। বিশ্ব অর্থনীতিতে যে অনিশ্চয়তা বিরাজমান এর মধ্যে কেমন করে আমাদের অর্থনীতিতে আমরা জায়গা করে নিতে পারি, আমরা আরও কীভাবে গতিশীল করতে পারি- সেগুলো বাজেটে জায়গা পেয়েছে। যে চ্যালেঞ্জিং সময় মোকাবিলা করে যাচ্ছি এসময়ে আমাদের দেশের মানুষকে যতটা পারি সহায়তা করবো। ন্যায়সঙ্গত হবে না এমন কিছু তাদের ওপর চাপিয়ে দেবো না। একই সঙ্গে বাজেট নিয়ে আমরা কোনো চাপ বোধ করছি না। আমরা যুদ্ধ (রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ) নিয়ে চাপ বোধ করছি। আমরা চাই যুদ্ধটি শেষ হোক।
অর্থনীতিতে করোনা মহামারির প্রভাব নিয়ে তিনি বলেন, কোভিড শেষ করলাম, কোভিড যা ক্ষতি করার করেছে। কোভিডের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ অর্থনীতিতে আমরা যখন বিভিন্ন দিকে মগ্ন ছিলাম, সেই সময় আবার যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো। এটা ঠিক যে, আমাদের বাহ্যিক যে দুর্বলতাগুলো রয়েছে, সে সম্পর্কে প্রজেকশন (ধারণা) করা যায় না। প্রজেকশন করতে তো এজামপশন (অনুমান) করা লাগে। কিন্তু যুদ্ধের কারণে সেটি করতে পারবো না। এতটুকু চাপ তো অবশ্যই। সবাইকে কিন্তু এটি নিয়ে ভাবতে হচ্ছে।
বাজেটে সরকারি বা প্রকল্পের খরচ কমাতে কোনো নির্দেশনা থাকবে কিনা জানতে চাইলে আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, বাজেটে যেগুলো যুক্ত করা দরকার, সেগুলো যুক্ত করবো। সরকারি সিদ্ধান্ত আমরা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির চাপ কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, পলিটিক্যাল ইন্ডিকেশন (রাজনৈতিক নির্দেশ) কেন লাগবে? একটা ডিসিশন (সিদ্ধান্ত) হলে, সেটা নিয়ে সারাদেশের মানুষই অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়বে, এখানে রাজনীতি নেই। দেশের সব মানুষ ঐক্যবদ্ধ জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের বিদ্যমান যে অবস্থা, সেখান থেকে সুন্দরভাবে জনগণকে সঙ্গে নিয়েই আমরা যাতে এগুতে পারি সেজন্য এ কাজটি করতে পারি। আমি মনে করি না, আমাদের অন্য কোনো চিন্তা আছে। আমাদের চিন্তাই হলো এটাকে মোকাবিলা করতে হবে।
রেমিট্যান্স নিয়ে আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, আমরা গণমাধ্যমে দেখেছি, রেমিট্যান্স বেশি আসছে। আমাদের এক্সপোর্ট (রফতানি) বেড়ে গেছে। কোনো না কোনো চ্যালেঞ্জিং টাইম (সময়) থাকবেই। এগুলো একদিকে যেমন কঠোর, আরেক দিক থেকে এগুলো আমাদের সুযোগ সৃষ্টি করে। আমাদের এই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। তিনি বলেন, এই কোভিড আর ইউক্রেনের যুদ্ধ অনেক সম্প্রসারিতভাবে সুযোগ সৃষ্টি করবে। সেগুলো আমাদের কাজে লাগাতে হবে। আমি মনে করি, যেকোনো অর্থনীতিবীদ এর বাইরে চিন্তা করতে পারে না। এর বাইরে চিন্তা করার কিছু নেই।
বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম বাড়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, আমি বলবো আপনারা অপেক্ষা করেন। পাকিস্তান কী করলো সেটা আমরা করতে পারবো না। তাদের চাহিদা এবং আমাদের চাহিদা তো ভিন্ন। তাদের যেটা প্রয়োজন সেটা আমাদের প্রয়োজন নাও হতে পারে। সেটি নিরূপণ করে আমরা কাজটি করবো। তিনি বলেন, আমি আগেই বলেছি আমরা অন্য কোনো দেশের সঙ্গে সম্পর্ক করবো তখনই যখন আমরা লাভবান হতে পারি। যুদ্ধ থেমে গেলে রাশিয়া বা ইউক্রেন থেকে সরাসরি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যেমন- জ্বালানি, ভোজ্যতেল আনতে পারলে আমরা লাভবান হবো। ‘বিদ্যুৎ-জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি অর্থনীতির জন্য আত্মঘাতী হবে’, ব্যবসায়ীদের এমন বক্তব্য প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, এ বিষয়ে আমার সঙ্গেও আলোচনা হয়েছে। এ বিষয়ে আমি ভিন্ন মতামত দিতে চাই না। গত সপ্তাহে এটি নিয়ে মিডিয়ায় কথা হয়েছে।
এদিকে বিদ্যুৎ বিভাগের ১১টি ক্রয় প্রস্তাবসহ ১৬ ক্রয় প্রস্তাবে অনুমোদন দিয়েছে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। এতে ব্যয় হবে ২ হাজার ৮৭৬ কোটি ৬১ লাখ ২ হাজার ৫৫০ টাকা। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে কমিটির ভার্চুয়াল সভায় ক্রয় প্রস্তাবগুলোতে অনুমোদন দেয়া হয়। সভা শেষে অর্থমন্ত্রী বলেন, সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি’র ১৮তম সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। কমিটির অনুমোদনের জন্য ১৭টি প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়। প্রস্তাবগুলোর মধ্যে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের ১১টি, স্থানীয় সরকার বিভাগের ২টি, জননিরাপত্তা বিভাগের ১টি, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের ১টি, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের ১টি এবং বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের ১টি প্রস্তাব ছিল। তিনি বলেন, কমিটির অনুমোদিত ১৬টি প্রস্তাবে মোট অর্থের পরিমাণ ২ হাজার ৮৭৬ কোটি ৬১ লাখ ২ হাজার ৫৫০ টাকা। মোট অর্থায়নের সম্পূর্ণ অর্থই জিওবি থেকে ব্যয় হবে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. জিল্লুর রহমান চৌধুরী বলেন, জননিরাপত্তা বিভাগের ‘ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি)-এর জন্য ‘পার্ট প্রকিউরমেন্ট অব ইন্টিগ্রেটেড লফুল ইন্টারসেপশন (এলআই) সিস্টেম-জিও লোকেশন সিস্টেম অ্যান্ড রিলেটেড সার্ভিসেস’ ক্রয়ের প্রস্তাবে অনুমোদন দিয়েছে কমিটি। এতে ব্যয় হবে ১৭২ কোটি ১৯ লাখ ৬৮ হাজার ৭৯৬ টাকা। সভায় স্বাস্থ্য বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন ১৪ হাজার ১৪টি কমিউনিটি ক্লিনিকের জন্য সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে ২৭ (সাতাশ) প্রকার ওষুধ কেনা’ একটি প্রস্তাবে অনুমোদন দিয়েছে কমিটি।
সভায় সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের ‘মধুপুর-ময়মনসিংহ জাতীয় মহাসড়ক যথাযথ মান ও প্রশস্ততায় উন্নীতকরণ’ প্রকল্পের প্যাকেজ নং-ডব্লিউপি-০১ এর পূর্ত কাজ ক্রয়ের প্রস্তাবে অনুমোদন দিয়েছে কমিটি। টিইসি সুপারিশকৃত রেসপনসিভ সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠান তাহের ব্রাদার্স প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। এতে ব্যয় হবে ১৪২ কোটি ৬ লাখ ৪৬ হাজার ৮৪৮ টাকা।
সচিব আরও বলেন, ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন-২০১০’ (২০২১ সালের সর্বশেষ সংশোধনীসহ) এর আওতায় স্পট মার্কেট থেকে (২০২২ সালের ১৪তম) এলএনজি আমদানির প্রত্যাশাগত অনুমোদন দিয়েছে কমিটি। দরপত্রের সব প্রক্রিয়া শেষে প্রস্তাব প্রক্রিয়াকরণ কমিটি’র (পিপিসি) সুপারিশে সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠান সিঙ্গাপুরভিত্তিক মেসার্স গানভর প্রাইভেট লিমিটেডের নাম সুপারিশ করে। প্রতিষ্ঠানটি প্রতি এমএমবিটিইউ ২৪ দশমিক ২৫ মার্কিন ডলার হিসেবে ৩৩ লাখ ৬০ হাজার এমএমবিটিইউ এলএনজি কিনতে মোট ব্যয় হবে ৮৩৮ কোটি ৯১ লক্ষ ৮০ হাজার ৮০০ টাকা।
এছাড়াও সভায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধির (বিশেষ আইন, ২০১০ (২০২১ সনের সর্বশেষ সংশোধনসহ) আওতায় সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেডের (এসজিএফএল) বাস্তবায়নাধীন ‘কেলাশটিলা ৮নং কূপ (অনুসন্ধান কূপ)’ খনন শীর্ষক প্রকল্পের বিভিন্ন কাজের পৃথক ১০টি ক্রয় প্রস্তাবে অনুমোদন দিয়েছে কমিটি। এতে মোট ব্যয় হবে ৩৩ কোটি ৮৯ লাখ ৬৬ হাজার ৭৮৭ টাকা।
সভায় ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা স্থাপন প্রকল্পের’ প্যাকেজ নং-ডব্লিউ-২ এর আওতায় পূর্ত কাজ ক্রয়ের একটি প্রস্তাবে অনুমোদন দিয়েছে কমিটি। এতে ব্যয় হবে ৮৩১ কোটি ২১ লাখ ৪৩ হাজার ৩৫ টাকা।
তিনি বলেন, একই প্রকল্পের আওতায় প্যাকেজ নং-ডব্লিউ-৩ এর আওতায় পূর্ত কাজ ক্রয়ের প্রস্তাবে অনুমোদন দিয়েছে কমিটি। প্রকল্পের আওতায় পূর্ত কাজ ক্রয়ের জন্য এক ধাপ দুই খাম পদ্ধতিতে দরপত্র আহ্বান করা হলে দুটি প্রতিষ্ঠান দরপত্র দাখিল করে। তার মধ্যে আর্থিকভাবে একটি প্রস্তাব রেসপনসিভ হয়। দরপত্রের সব প্রক্রিয়া শেষে টিইসি একমাত্র রেসপনসিভ দরদাতা প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে (১) ইসিইসি (২) সিসিইসিসি এবং (৩) টিসিইএল এর নাম সুপারিশ করেছে। কমিটি তাতে অনুমোদন দিয়েছে। এতে ব্যয় হবে ৬৪৮ কোটি ৮৮ লাখ ৬৮ হাজার ৯২৯ টাকা।
এছাড়াও সভায় ক্রয়কার্যে আরও বেশি সংখ্যক দরদাতা, বিশেষ করে দেশি দরপত্রদাতা প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার বিষয়ে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের একটি প্রস্তাব ছিল। প্রস্তাবটি নিয়ে আলোচনা শেষে তা কমিটি সব সদস্যদের মতামত নেয়ার জন্য ফেরত দেয়া হয়েছে। সদস্যরা মতামত দেওয়ার পর বিষয়টি পরবর্তী সভায় উপস্থাপন করা হবে।##
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন