সরকারের বিদ্যমান সিস্টেমকে দায়ী করে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, ঢাকায় যাদেরই জায়গা-বাড়ি বা ফ্ল্যাট আছে সবাই কালো টাকার মালিক। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, যে জমি আপনি কিনবেন, সেই জমি অল্প দামে রেজিস্ট্রি বা নিবন্ধন করতে হবে। যেই দামে কিনবেন, তার চেয়ে কম দামে রেজিস্ট্রি করতে হবে। আপনি বেশি দাম দিয়ে রেজিস্ট্রি করতে পারবেন না। কারণ, প্রত্যেকটা মৌজায় দাম ঠিক করে দেয়া আছে। এর চেয়ে বেশি দামে নিবন্ধন করা যায় না। এই যে বেশি দামে রেজিস্ট্রি করা যায় না, এখানেই তো কালো টাকা হয়ে আছে। অর্থমন্ত্রী বলেন, যে ফ্ল্যাট দুই বা তিন কোটি টাকায় নিবন্ধিত হচ্ছে, সেই ফ্ল্যাটের প্রকৃত দাম ১০ কোটি টাকা। ফলে সরকার বাড়তি প্রকৃত নিবন্ধন ফি ও কর পাচ্ছে না। এখানেই কালো টাকা সৃষ্টি হচ্ছে। এ বিষয়গুলো সবাইকে বুঝতে হবে। তবে বাজেট বাস্তবায়ন শুরু হলে পুঁজিবাজার চাঙ্গা হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন তিনি। পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনার যে সুযোগ রাখা হয়েছে তার সুফল পাওয়া যাবে পুঁজিবাজারে। সেটি ছাড়াও অন্যান্য সিদ্ধান্ত পুঁজিবাজারকে চাঙা করবে।
গতকাল অর্থনৈতিক বিষয় ও সরকারী ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এসব কথা বলেন। বৈঠকে ২ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৩টি ক্রয় প্রস্তাবের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) জন্য দেশের ৮টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ২৮ হাজার ৫০০ টন চিনি ও মশুর ডাল কেনার দুটি পৃথক প্রস্তাবের অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২৮১ কোটি ৬৮ লাখ ২০ হাজার টাকা। এছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত, কানাডা ও মরক্কো থেকে এক লাখ ৩০ হাজার টন সার ক্রয়ের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ৯৪ কোটি ৫৮ লাখ ৮১ হাজার ২০০ টাকা। খুলনা পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নয়নের পূর্ত কাজ যৌথভাবে পেয়েছে ভারত এবং বাংলাদেশের দুই প্রতিষ্ঠান। এতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৪২৬ কোটি ৭১ লাখ টাকা। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল আক্ষেপ করে বলেন, সরকারের সিস্টেম বা পদ্ধতিগত কারণে ঢাকায় যাদের বাড়ি, ফ্ল্যাট বা জমি আছে তারা সবাই কালো টাকার মালিক হয়ে গেছেন। তবে পুরো বিষয়টি সঠিকভাবে অটোমেশন করা গেলে এ খাতে কালো টাকার উৎস বন্ধ করা যেত। সিস্টেম বা পদ্ধতিগত সমস্যার কারণে সরকার যথাযথভাবে ফি ও কর পাচ্ছেনা। তবে আমাদেরকে এ অবস্থা থেকে বের হতে হবে। বাস্তবতার সঙ্গে মিল রেখে কাজ করতে হবে। তিনি জানান, মৌজা মূল্য বাড়ানোর চেষ্টা করেও তিনি পারেননি। ফলে যে ফ্ল্যাট ৩ কোটি টাকায় রেজিস্ট্রি হচ্ছে, সেটার দাম ১০ কোটি টাকা। স্ট্যাম্প ডিউটি বাড়ছে না, মাঝে রেজিস্ট্রেশন ফি সরকার পাচ্ছে। মাঝখানে টাকা হয়ে গেলো কালো টাকা। এই যে বিপুল পরিমাণ টাকা গোপন করা হলো, তাতে কালো টাকার উৎস তৈরি হচ্ছে, যাকে আমরা বলি অপ্রদর্শিত আয়। এটা হয়েছে সিস্টেমের কারণেই।
আগামী অর্থবছরের বাজেটে পাচার করা অর্থ দেশে আনার সুযোগ দিয়ে কোনো চাপে আছেন কি না, জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, আমি কোনো ধরনের চাপে নেই। যেটা বলেছি, সেটা করব। আমি অর্ধেক রাস্তা থেকে ফেরত আসার মানুষ না। এ আগে যখন প্রবাসীদের রেমিট্যান্সে ইনসেনটিভ দেয়ার সিদ্ধান্ত হলো, তখন অনেকেই সমালোচনা করেছেন। কিন্তু, ইনসেনটিভ দেয়ায় অনেক বেশি প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স এসেছে। তেমনি পাচার করা অর্থও দেশে ফেরত আসবে। পাচার করা টাকা দেশে আনার পর একটা অংশ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ হবে বলেও আশা ব্যক্ত করেন তিনি। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, যখন বিদেশে পাচার হওয়া কালোটাকা দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি, তখন বলা হচ্ছে, সরকার কালোটাকা সাদা করার ক্ষেত্রে প্রশ্রয় দিচ্ছে। আমি বারবার বলছি, এটা অপ্রদর্শিত টাকা, এখানে লাজলজ্জার কিছু নেই। সরকারের বিদ্যমান সিস্টেমই এ জন্য দায়ী। আমিও একসময় দায়িত্বে ছিলাম। ঢাকা শহরে জমির দাম বাড়ানো যায় কি না, সেটা নিয়ে চিন্তা করলেও শেষ পর্যন্ত দাম বাড়াতে পারিনি। যে দাম ছিল, এখনো সে দামই আছে। রফতানিমুখী তৈরি পোশাক খাতে বিদেশী পরামর্শকরা উচ্চ বেতন পাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা বের হয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে সাংবাদিকরা দৃষ্টি আকর্ষণ করলে অর্থমন্ত্রী বলেন, পোশাক খাতে এক সময় বিদেশী পরামর্শক প্রয়োজন হতো। কিন্তু এখন দেশে অনেক বিশেষজ্ঞ তৈরি হয়েছে। এ কারণে এখন আর বিদেশী পরামর্শকদের প্রয়োজন নেই। কিন্তু যারা কারখানা চালায়, তারা বলেছেন, বিদেশী এক্সপার্ট এখনও লাগবে। তা না হলে তাদের রফতানি বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এদিকে জ্বালানি তেলের দাম আবার বাড়ানো হতে পারে কি না, এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। হলে আমরা সিদ্ধান্ত নেব। তবে সরকার চায়, সাধারণ মানুষের কষ্ট যেন কম হয়, কিন্তু দাম বেশি বাড়লে মানুষের ওপর কিছুটা চাপাতে হয়, তা না হলে সরকারই তা বহন করে। পুঁজিবাজার প্রসঙ্গে আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, শেয়ারবাজার নিয়ে যেসব নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন করা হবে। আমাদের অর্থনীতি অনেক ভালোভাবে চলছে। প্রতিটি সূচকে আমরা বিশ্বের মধ্যে অনেক ভালো অবস্থানে আছি। পুঁজিবাজার ওঠানামা স্বাভাবিক নিয়ম। তবে এটি ভালোভাবে চলুক, আমরা সেটাই চাই।
২৮ হাজার টন চিনি ও মুশুর ডাল কিনবে টিসিবি
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সারাদেশে ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে প্রায় কোটি পরিবারে খাদ্যপণ্য বিক্রি করবে টিসিবি। এজন্য দেশের ৮টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ২৮ হাজার ৫০০ টন চিনি ও মশুর ডাল কেনার দুটি পৃথক প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২৮১ কোটি ৬৮ লাখ ২০ হাজার টাকা। ক্রয় সংক্রান্ত বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে অতিরিক্ত সচিব মো. জিল্লুর রহমান চৌধুরী জানান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) থেকে মেঘনা সুগার রিফাইনারি লিমিটেড এবং সিটি সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের কাছ থেকে ১৫ হাজার মেট্রিক টন চিনি সর্বমোট ১২৩ কোটি ৫ লাখ ৭০ হাজার টাকায় কেনার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এছাড়া টিসিবির অপর এক প্রস্তাবে এসিআই পিওর ফ্লাওয়ার লিমিটেড, সেনা কল্যাণ সংস্থা, এনএস কনস্ট্রাকশন, বাংলাদেশ ভোজ্যতেল লিমিটেড, নাবিল নাবা ফুডস লিমিটেড এবং ইজ সার্ভিসেস লিমিটেডের কাছ থেকে ১৩ হাজার ৫ শত টন মশুর ডাল সর্বমোট ১৫৮ কোটি ৬২ লাখ ৫০ হাজার টাকায় কেনার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এছাড়া এক হাজার ৯৪ কোটি ৫৮ লাখ টাকায় এক লাখ ৩০ হাজার টন সার ক্রয়ের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত, কানাডা ও মরক্কো থেকে এক লাখ এসব সার আনা হবে। খুলনা পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নয়নের পূর্ত কাজ যৌথভাবে পেয়েছে ভারত এবং বাংলাদেশের দুই প্রতিষ্ঠান। এতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৪২৬ কোটি ৭১ লাখ টাকা। বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ক্রয় কমিটির প্রস্তাবনাগুলোর মধ্যে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের ৪টি, কৃষি মন্ত্রণালয়ের ৩টি, স্থানীয় সরকার বিভাগের ২টি, জননিরাপত্তা বিভাগের ২টি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ২টি, শিল্প মন্ত্রণালয়ের ১টি, সেতু বিভাগের ১টি, বিদ্যুৎ বিভাগের ১টি এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ১টি প্রস্তাবনা ছিল। এরমধ্যে ক্রয় কমিটি ১৩টি প্রস্তাবের অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন