ট্রেনের টিকেট এখন সোনার হরিণ। অনলাইন এবং কাউন্টারে টিকেট বিক্রির ঘোষণা দেয়া হলেও সাধারণ যাত্রীদের টিকেট দেয়া হয় খুবই কম। কাউন্টারের জবাব ‘টিকেট নেই’। আর অনলাইনে টিকেট পাওয়া যায় না। তবে সিন্ডিকেটের কাছ থেকে অধিক মূল্যে টিকেট কেনাবেচা হচ্ছে নিত্যদিন। অনেক যাত্রী কাউন্টারে টিকেট না পেলেও দেখা যায় অনেক সিট খালি নিয়েই ট্রেন চলে যাচ্ছে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ‘কালো ইঁদুর’ ধরার ঘোষণা দিয়ে নিজেই সে ইঁদুরের গর্তে পড়েছিলেন। এখন রেলওয়ে যেন ‘হোয়াইট ইদুঁরে’ ভরে গেছে। কমলাপুর স্টেশনের কুলি থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কাছেও প্রতারিত হচ্ছেন যাত্রীরা। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পরিবহনটি এখন কার্যক সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে গেছে। কমলাপুর রেলস্টেশনে কয়েকদিন সারেজমিন ঘুরে, বিভিন্ন যাত্রীর সঙ্গে কথা বলে এ চিত্র পাওয়া গেছে। সারাদেশের কয়েকটি স্টেশনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে সেখানেও টিকেট কালোবাজারে বিক্রি হচ্ছে।
কমলাপুর স্টেশনে কয়েকদিন ঘুরে ভুক্তোভোগী যাত্রীদের সঙ্গে কথা বললে তাদের বেশির ভাগই জানান, লাইনে দাঁড়িয়ে টিকেট পাননি। তবে দালালরা তাদের টিকেটের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এ জন্য দালালদের ৫০ টাকা থেকে ৩শ’ টাকা পর্যন্ত বেশি দিতে হচ্ছে। দালালদের কাছ থেকে টিকেট নেয়া একাধিক যাত্রী কমলাপুরে স্টেশনে কয়েকজনকে ঘুরাঘুরি করতে দেখে প্রতিবেদককে বলেন, ওই যে দেখছেন ঘুরাঘুরি করছে; ওরা ট্রেনের কালো বেড়াল। কাউন্টারে টিকেট না পেলেও ওদের কাছে গেলেই টিকেট পাবেন। বেসরকারি কোম্পানিকে টিকেট বিক্রির দায়িত্ব দেয়া হলেও ওই কোম্পানির কর্মচারীরাই দুই নম্বরী করে টিকেট দালালদের হাতে তুলে দেন। এটা কমলাপুর রেলস্টেশনের রেওয়াজে পরিণত হয়ে গেছে।
এ বিষয়ে টিকেট বিক্রির দায়িত্ব পাওয়া সহজ ডটকমের জনসংযোগ কর্মকর্তা ফারহাত আহমেদ ইনকিলাবকে বলেন, সহজের ব্যবস্থাপনায় কাউন্টার ও অনলাইনে টিকিট বিক্রির কার্যক্রম চলছে। সামনের কোরবানির ঈদে টিকেটের চাহিদা আরও বাড়তে পারে। ওই সময় যাতে কোন সমস্যা না হয় সেজন্য কাজ শুরু করেছি।
জানা যায়, এখনো জটিলতা কাটেনি ট্রেনের টিকিট নিয়ে। একজনের নামের টিকিট অন্যজনের, এক জায়গার স্থলে অন্য জায়গা। জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর বাধ্যতামূলক হলেও যেকোন নম্বর দিয়েই টিকিট কালবাজারিসহ নানা কারণে এখনো ট্রেনের টিকিট ব্যবস্থাপনায় সঙ্কট রয়েই গেছে। রাজধানীর কমলাপুরসহ সারা দেশের রেল স্টেশনগুলোতে সাধারণ যাত্রীরা টিকিট চাইলেই পাচ্ছেন না। এই সমস্যা ঢাকার বাইরে আরও প্রকট। টিকিট কাটতে গিয়ে না পেলেও ট্রেনে ওঠে দেখা যায় অনেক আসনই ফাঁকা। এ নিয়ে নানা মন্তব্য শুনা যায় যাত্রীদের মুখে।
একই আসনে একাধিক টিকিট বিক্রি, চাহিদা সত্ত্বেও আসন খালি রাখাসহ নানা ঘটনায় লোকসান গুনছে রেল। সাধারণ যাত্রীরা বহু কষ্টেও টিকিট কাটতে না পারলেও কালবাজারিরা ঠিকই মুহূর্তের মধ্যেই টিকিট কেটে নেয়। এতে টিকিট বঞ্চিত হন সাধারণ যাত্রীরা। এমনকি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্রাদিমির পুতিন, উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং উনসহ বিশ্বের নামিদামি লোকের নামেও টিকিট কাটা যায়। কিন্তু প্রয়োজনের সময় যাত্রীরা তাদের গন্তব্যে যেতে কাঙ্খিত টিকিটটি পান না। ট্রেনের টিকিট বিক্রিতে এই কেলেঙ্কারি-অনিয়ম ও কারিগরি ত্রুটির কারণে বিপুল রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। ট্রেনে অতিরিক্ত দুটি বগির কথা বলে টিকিট বিক্রি করায় সিট না পাওয়া ক্ষুব্ধ যাত্রীরা স্টেশনে ভাঙচুরের চেষ্টা চালানোর মতো ঘটনাও ঘটেছে। সাধারণ যাত্রীরা বলছেন, বছরে হাজার কোটি টাকা লোকসান দেয় রেল। দুর্নীতিবাজ, মুনাফাবাজ, টিকিট কালোবাজারি চক্রের হাত থেকে মুক্ত হতে পারেনি রেলওয়ে। সরকারের মন্ত্রী-আমলারা ও উচ্চ পদস্থ লোকজনের সহযোগিতার কারণেই রেলে দুর্নীতি ও লুটপাট বন্ধ হচ্ছে না।
অনেকেই বলছেন, গত ঈদের পর রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর আত্মীয়রা বিনা টিকেটে ভ্রমণ করতে গিয়ে একজন টিটিই’র হাতে জরিমানার শিকার হন। সেই টিটিইকে তাৎক্ষণিক অর্ডারে বরখাস্তের ঘটনায় রেলমন্ত্রী ও তার স্ত্রী শাম্মি আক্তার সমালোচিত হন। সারা দেশে এই সংবাদ নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠে। রেলের কালোবিড়াল এখনো ক্ষমতাধর রয়েছে এমন কথাও বলছেন তারা। মন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি তুলেছেন অনেকে। ব্যাপক সমালোচনার মুখে টিটিই’র বরখাস্তর আদেশ প্রত্যাহার করা হয়। সেই টিটিই কাজে যোগদান করেন আবার। পুনরায় যোগদানের প্রথমদিনেই জরিমানা আদায় করে রাষ্ট্রিয় কোষাগারে জমা দেন।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি রেলের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় যৌথভাবে সহজ-সিনোসিস-ভিনসেন। ২৫ মার্চ সন্ধ্যার পর থেকে নতুন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে টিকিট বিক্রির কার্যক্রম শুরু হয়। ২১ মার্চ সহজের কার্যক্রম শুরু হলেও প্রযুক্তিগত ও আনুষঙ্গিক কাজের জন্য বিশেষ বিবেচনায় জরিমানা মওকুফ করে ২১ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত রেলওয়ের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় টিকিট বিক্রি করা হয়। বর্তমানে সহজের মাধ্যমে কাউন্টার ও ওয়েবসাইটে টিকিট বিক্রি চললেও মোবাইল অ্যাপস কার্যকর হয়নি। গত ১৫ মে ধূমকেতু এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রীরা কমলাপুর স্টেশনের ৫ নম্বর প্ল্যাটফর্মে হট্টগোল করেন। ট্রেনের এক্সটা-২ ও এক্সট্রা-৩ নামে দুটি অতিরিক্ত কোচ সংযোজন করে টিকিট বিক্রি করে সহজ।
১১ মে ও ১৪ মে দুদিনে এসব অতিরিক্ত টিকিট বিক্রি করে দুই বগির নামে। বাস্তবে এসব বগি সংযোজনের জন্য রেল কর্তৃপক্ষ লিখিত ও মৌখিক কোনো অনুমতি দেয়নি। নির্ধারিত বগি না পেয়ে যাত্রীরা উত্তেজিত হয়ে ট্রেন ও স্টেশন ভাঙচুরের চেষ্টা চালায়। একই আসনে একাধিক টিকিট বিক্রিও হচ্ছে প্রায়ই। গত ১৪ এপ্রিল পারাবত এক্সপ্রেসের কাউন্টার থেকে ঢাকা-শ্রীমঙ্গল, ঞ/৪৪ এবং অনলাইন থেকে ঢাকা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ঞ/৪৩-৪৪ আসনে টিকিট বিক্রি হয়েছে। এ নিয়ে পরে ট্রেনে বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি হয়। ১২ এপ্রিল ইস্যুকৃত (যাত্রার তারিখ ১৬ এপ্রিল) পোড়াদহ-খুলনা রুটে পোড়াদহ স্টেশন থেকে সাগরদাড়ি এক্সপ্রেস ট্রেনের একই আসনে ৬টি টিকিট ইস্যু করা হয়।
দীর্ঘ ছয় বছর ধরে রেলওয়ে টিকেটিংয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন রেজাউল করিম। এ সুবাদে প্রতি ঈদে ২-৩ হাজার ট্রেনের টিকিট সরিয়ে নিতেন। যা কালোবাজারে বিক্রির মাধ্যমে প্রতি মৌসুমে আয় করতেন ১০-১২ লাখ টাকা। সহজ ডটকমে দায়িত্ব পাওয়া রেজাউল এর আগে সিএনএস বিডিতেও কর্মরত ছিলেন। গত ২৭ এপ্রিল ট্রেনের অনলাইন টিকিট জালিয়াতির অভিযোগে সহজ ডটকমের সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার মো. রেজাউল করিমকে আটক করা হয়। পরে তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে বিমানবন্দর স্টেশন থেকে সহযোগী এমরানুল আলম সম্রাটকে আটক করা হয়। তাদের দেয়া তথ্যে টিকিট কালোবাজারির বিষয়টি নিশ্চিত হয় র্যাব।
এদিকে, পাঁচ কর্মকর্তা-কর্মচারীর নামে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করায় খুলনা রেলওয়ের স্টেশন মাস্টার মানিক চন্দ্র সরকারকে শোকজ করা হয়েছে। গত ১৮ মে রাতে রেলওয়ের বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা (ডিটিও) পাকশি মো. আনোয়ার হোসেন তাকে শোকজ করেন। এর আগে ১৬ মে খুলনা মানিক চন্দ্র সরকার টিকিট কালোবাজারীর অভিযোগ এনে দু’জন সহকারী স্টেশন মাস্টারসহ ৫ কর্মকর্তা-কর্মচারীর নামে থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন।
গত ১৬ মে স্টেশন মাস্টার মানিক চন্দ্র সরকার খুলনার ৫ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে খুলনার জিআরপি থানায় সাধারণ ডায়েরিতে উল্লেখ করা হয়, খুলনা রেলওয়ে স্টেশনের সহকারী স্টেশন মাস্টার মো. আশিক আহম্মেদ ও সহকারী স্টেশন মাস্টার মো. জাকির হোসেন, টিএক্সআর বায়তুল ইসলাম, আইডব্লিউ অফিসের মো. জাফর মিয়া ও তোতা মিয়া কালোবাজারে টিকিট বিক্রি করেন এবং তারা বিশিষ্টজনের ভুয়া নাম ব্যবহার করে টিকিটের চাহিদা দেখিয়ে টিকিট গ্রহণ করেন। টিকিট না পেলে তারা বহিরাগতদের দিয়ে তার ওপর নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করেন। এমনকি তারা স্টেশন ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও তাকে মারধরের নীলনকশা করছে এবং মোবাইল ফোনে বিভিন্ন ধরনের হুমকি দিচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন।
তিন মেয়াদে টানা দেড় দশক বাংলাদেশ রেলওয়ের টিকিট ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিল কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেম (সিএনএস)। তবে টিকিট বিক্রিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনার অভিযোগ ছিল এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।
প্রায় দুই বছর আগে রেলের আহ্বান করা দরপত্রে সিএনএসের পরিবর্তে টিকিট ব্যবস্থাপনার জন্য যোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচিত হয় সহজ লিমিটেড জেভি।
গত ঈদে প্রথমবারের মতো অনলাইনে ট্রেনের টিকিট বিক্রি করেছে দীর্ঘদিন ধরে বাস ও লঞ্চের টিকিট বিক্রির অভিজ্ঞতা সম্পন্ন সহজ-সিনেসিস-ভিনসেন জেভির লিড পার্টনার সহজ লিমিটেড। তবে টিকিট বিক্রির শুরুতেই সার্ভার ডাউনসহ নানা জটিলতায় পড়তে হয় সহজকে। ঈদে টিকিট বিক্রি ও মানুষের ভোগান্তিসহ নানা বিষয়ে অসুবিধা দেখা দেয়। গত ঈদুল ফিতরে অনলাইনে ট্রেনের টিকিটের জন্য ১০ দিনে ওয়েবসাইটে ৩০ কোটির বেশি হিট করেছেন টিকিট প্রত্যাশীরা।
রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেছেন, টিকিট কালোবাজারি সংক্রান্ত অভিযোগ মন্ত্রী হবার পর থেকেই শুনছি। এ থেকে রেল মুক্ত হতে পারেনি। এজন্য অনেকগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। ২০০৭ সাল থেকে আমাদের টিকিটের বিষয়ে যারা সার্ভিস দিচ্ছিল (সিএনএস-বিডি) তাদের পরিবর্তে সহজডটকমকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। মাত্র দুই-তিন মাস হয়েছে। আমরা অপেক্ষা করতে চাই, দেখি তাদের সার্ভিসটা কতটুকু পাই। অভিযোগগুলো সম্পূর্ণ মেনে নিচ্ছি। তবে এগুলো সমাধানের জন্য পদক্ষেপ নিয়েছি। ইনশাআল্লাহ ভবিষ্যতে এধরনের সমস্যা থাকবে না।#
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন