রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

খাচ্ছি মাছ নাকি প্লাস্টিক

খাদ্যের সাথে গিলছে মাছেরা : যাচ্ছে মানুষের পেটে : ক্যান্সারসহ জটিল রোগের ঝুঁকি বঙ্গোপসাগর মৎস্যশূন্য হওয়ার আশঙ্কা : টনে টনে পড়ছে প্লাস্টিক-পলিথিন ‘সমুদ্রের পানির সব স্তরেই প্লাস্ট

শফিউল আলম | প্রকাশের সময় : ৩১ মে, ২০২২, ১২:০০ এএম

পলিথিন আর প্লাস্টিকের ‘রাজত্ব’ বড় হচ্ছে। বোতল, বক্স, শপিংব্যাগ থেকে শুরু করে নানারূপে নানান উপকরণ হিসেবে চারপাশে ছড়িয়ে আছে পলিথিন-প্লাস্টিক। শুধু তাই নয়। চারদিক থেকে আগ্রাসন চালাচ্ছে নীরব ঘাতকের মতো। পলিথিন-প্লাস্টিক নিছক পরিবেশ দূষণেই সীমিত নেই। রীতিমতো স্বাস্থ্যঘাতী তথা প্রাণঘাতী হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশে আইনে নিষিদ্ধ হলেও অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার কারণে কার্যত ‘নিয়ম-সিদ্ধ’ হয়ে গেছে পলিথিন। অবাধে বেচাকেনা বন্ধে কারও গরজ নেই। পলিথিন-প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও নেই। জনসাধারণ নিশ্চিন্ত মনে পলিথিন-প্লাস্টিক ব্যবহার করছে। ফেলছে যেখানে-সেখানে। এতে করে ভূপৃষ্ঠ-মাটি-পানি সর্বত্রই সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে প্লাস্টিক ও পলিথিন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বঙ্গোপসাগরে দৈনিক হাজারো টন ফেলা হচ্ছে প্লাস্টিক আর পলিথিনের বস্তু। সেই প্লাস্টিক-পলিথিনের বর্জ্য কণা (মাইক্রোপ্লাস্টিক) খাদ্যের সাথে গিলছে হরেক জাতের সামুদ্রিক মাছসহ প্রাণিকুল। আর, খাদ্যচক্রে মাছের সঙ্গে সহজেই ঢুকে যাচ্ছে মানুষের পেটে। যা ক্যান্সারসহ বিভিন্ন ধরনের মারাত্মক রোগ-ব্যাধির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সমুদ্রে প্লাস্টিক-পলিথিনের ব্যাপক ছড়াছড়ি। এর ফলে মাছের শরীর হয়ে ঘুরেফিরে শেষ গন্তব্য হিসেবে মানুষের শরীরেই তা ঢুকছে। দেশের নদ-নদী, খাল-বিল-হাওড়, পুকুর-জলাশয়েরও একই চিত্র। তাহলে খাচ্ছি মাছ নাকি প্লাস্টিক?

জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক অঙ্গসংস্থার তথ্য মতে, বার্ষিক ৮০ লাখ মেট্রিক টনেরও বেশি পরিমাণে প্লাস্টিক-পলিথিন দ্রব্য সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে। বাস্তবে এর পরিমাণ আরও বেশিই ধরা হয়। এরমধ্যে বঙ্গোপসাগরে কী পরিমাণে প্লাস্টিক-পলিথিন নিক্ষিপ্ত হচ্ছে তার সঠিক তথ্য নেই। এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ সাগর-মহাসাগরে মাছের চেয়ে প্লাস্টিক বর্জ্যরে পরিমাণই বেশি হবে বলে সতর্ক করেছে জাতিসংঘ। প্লাস্টিক-পলিথিনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কমপক্ষে ৬শ’ প্রাণী। এ ক্ষেত্রে ভয়াবহ ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ এবং দেশের সমুদ্র অঞ্চল। কেননা এ অবস্থায় মাছসহ সামুদ্রিক প্রাণিকুলের গলায় ও পেটে প্লাস্টিক-পলিথিন বর্জ্য আটকে মারা যাচ্ছে। ব্যাহত হচ্ছে বংশ বিস্তার। একইভাবে সী-গালসহ সমুদ্রে বিচরণশীল পাখীরাও নির্বংশ হচ্ছে।

এর পরিণতিতে সামুদ্রিক মাছসহ প্রাণিকুল, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে। পৃথিবীর বিভিন্ন সাগর-উপসাগরের মতো বঙ্গোপসাগর মাছশূণ্য হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা আর্থ ডে নেটওয়ার্ক-এর প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বের শীর্ষ প্লাস্টিক-পলিথিন দূষণকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। অবাধে এমনকি অপ্রয়োজনেও ব্যবহার করা হচ্ছে প্লাস্টিক-পলিথিন সামগ্রী। অথচ কেউই ভাবছে না ঘুরেফিরে তা মানুষেরই পেটে যাচ্ছে। পরিবেশ, জনস্বাস্থ্যহানি ছাড়াও ডেকে আনছে সাগরে ও নদ-নদী-জলাশয়ে মাছের স্বাভাবিক স্থিতি বা মজুদ ও বংশ বিস্তারে বিপর্যয়।

চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় সমুদ্র বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট এবং ইনস্টিটিউট অব ফিশারিজের সাবেক পরিচালক বিশিষ্ট সমুদ্রবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. হোসেন জামাল গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, সমুদ্রে প্লাস্টিক-পলিথিন বর্জ্য দূষণ সারাবিশে^ আলোচিত বিপদ। সমুদ্রে ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক-পলিথিন সামগ্রী প্রথমে বড় বড় টুকরা হিসেবে ভাসে বা পানির মধ্যে ঝুলে থাকে। এরপর সামুদ্রিক আবহাওয়ায় ভেঙে ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা (মাইক্রোপ্লাস্টিক) হিসেবে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এগুলো আরও ছোট হতে হতে প্রসার ঘটতে থাকে। পরীক্ষায় দেখা গেছে, মাছসহ সামুদ্রিক প্রাণিকুলের খাদ্যচক্রে মাইক্রোপ্লাস্টিকগুলো পেটে পাকস্থলীতে ঢুকে যায়। প্লাস্টিক-পলিথিন বড় সাইজ হলে গলায় আটকে মারা যায়। ক্ষুদ্র হলে মাছেরা গিলে ফেলে। সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো, আমরা যখন সেই মাছ বা সামুদ্রিক প্রাণীগুলো খাই, তখন মানবদেহে চলে আসছে। ড. হোসেন জামাল আরো বলেন, প্লাস্টিক-পলিথিনের টুকরোগুলো সামুদ্রিক আবহাওয়া, স্রোত ও ঘূর্ণিতে ক্রমাগত ভেঙেচুরে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে যাচ্ছে। এটা সামুদ্রিক মাছসহ প্রাণিকুলের সাথে সাথে মানুষের জন্যও বিপদ ডেকে আনছে। সমুদ্রের পানির প্রথম, দ্বিতীয়সহ সব লেয়ারেই (স্তরে) প্লাস্টিক-পলিথিন বর্জ্যরে দূষণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এতে করে সামুদ্রিক মাছসহ প্রাণিকুলের জন্য প্লাস্টিক-পলিথিন বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা বড় বিপদ ডেকে আনছে। এর সমাধান হলো অবিলম্বে যাবতীয় প্লাস্টিক-পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে বিকল্প খুঁজে বের করা।

এ বিষয়ে জাতীয় পুষ্টি ইনস্টিটিউটের পরিচালক চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সাবেক ভাইস প্রিন্সিপাল প্রফেসর ডা. নাসির উদ্দিন মাহমুদ ইনকিলাবকে বলেন, প্লাস্টিক-পলিথিন পচনশীল নয়। দীর্ঘকাল পরিবেশের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। খাল-বিল, নদী-নালা হয়ে সাগরের পানিতে গিয়ে পড়ছে প্লাস্টিক-পলিথিন। নদ-নদী ও সাগরের মাছ খাচ্ছে সেই প্লাস্টিক-পলিথিনের বর্জ্য কণা। ফুড চেইনের মাধ্যমে ঢুকছে মানুষের শরীরে। যা ক্যান্সার, কিডনি বিকলসহ নানাবিধ জটিল রোগব্যাধির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই অবিলম্বে প্লাস্টিক-পলিথিন সামগ্রীর অবাধ বেচাকেনা, ব্যবহার বন্ধ করা উচিৎ। এর উত্তম বিকল্প হিসেবে আমাদের সোনালী আঁশ পাটের তৈরি জিনিসপত্রের সুলভ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা জানান, অপচনশীল প্লাস্টিক-পলিথিনের আয়ুষ্কাল কমপক্ষে ৫শ’ বছর। প্লাস্টিক-পলিথিন ভেঙে ভেঙে ক্ষুদ্র কণায় পরিণত হয়। এই মাইক্রোপ্লাস্টিক খাদ্যচক্রের মাধ্যমে শেষ গন্তব্য হিসেবে মানুষের দেহে ঢুকছে। বাসা বাঁধছে হরেক রোগব্যাধি। দেশে দৈনিক প্রায় ১৮ হাজার মেট্রিক টন প্লাস্টিক-পলিথিনের বর্জ্য ছড়িয়ে পড়ছে। স্ট্যামফোর্ড বিশ^বিদ্যালয় বাংলাদেশের গবেষণায় বলা হয়, প্লাস্টিক-পলিথিনের বর্জ্য ও কণা দেশের নদ-নদী, খাল-বিল-নালা, পুকুর ও জলাশয়ে পড়ছে। সেখান থেকে গিয়ে মিশছে সমুদ্রে। বর্তমানে সাগরে সহজেই কুড়িয়ে পাওয়া যায় এমন সব ময়লা-আবর্জনার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মিলছে প্লাস্টিক। সমুদ্র সৈকত থেকে সংগৃহীত বর্জ্যরে ৮৫ শতাংশই প্লাস্টিক ও পলিথিন।

প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা খাদ্যের সাথে খাচ্ছে মাছ। মানুষ না জেনে সেই প্লাস্টিক-পলিথিনের ক্ষুদ্র কণা খাচ্ছে। হংকংয়ে গবেষকরা একটি মাছেই ৮০ টুকরো প্লাস্টিক পেয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ইন্দোনেশিয়ার বাজারে বিক্রীত ২৫ শতাংশ মাছে প্লাস্টিক-পলিথিনের কণা মিলেছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশে এখনও ব্যাপকভিত্তিক বা নিবিড় গবেষণা না হলেও উদ্বেগজনক অবস্থার শঙ্কা রয়েছে। এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (এসডো) ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট নগরীতে গবেষণা চালায়। এতে নদ-নদী, খাল-জলাশয়ের পানিতে প্লাস্টিক-পলিথিন পেয়েছে। তারা মাছের পাকস্থলী, মুখ ও ডিমে প্লাস্টিক-পলিথিন পায়। সমুদ্রে মাছ শিকারি জেলেরা অনেক সময়ই গলায় কিংবা পেটে প্লাস্টিক ও পলিথিন আটকে গিয়ে শ^াসরোধ হয়ে মৃত কিংবা আধমরা মাছ জালে ধরা পড়ার কথা জানান।

১৯৫০ সালে বিশে^ প্রথম প্লাস্টিক-পলিথিনের ব্যবহার শুরু হয়। বর্তমানে তা রমরমা ব্যবসায় রূপ নিয়েছে। বিশে^ প্লাস্টিক-পলিথিনের বর্জ্য দ্বারা সমুদ্র দূষণকারী শীর্ষ দেশগুলো হচ্ছে চীন, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, মিসর, মালয়েশিয়া, নাইজেরিয়া এবং বাংলাদেশ। গোড়া থেকেই প্লাস্টিক-পলিথিন উৎপাদন, বাজারজাত ও বর্জ্য দূষণকারী শীর্ষতম দেশ চীন। বাংলাদেশসহ গোটা বিশে^ প্লাস্টিক-পলিথিন বর্জ্যরে দূষণ জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ-প্রতিবেশ, জীববৈচিত্র্যের উপর ব্যাপক সমস্যা-সঙ্কট ও বিপদের কারণ হিসেবে চিহ্নিত। অথচ এর সমাধানের প্রচেষ্টা ও উদ্যোগ কার্যত অনুপস্থিত।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (8)
Bazlur Rashid ৩১ মে, ২০২২, ৭:৩০ এএম says : 0
একদম ঠিক। প্লাস্টিকের বিকল্প ব্যবহার বাড়াতে হবে। বিকল্পকেই জনপ্রিয় করে তুলতে হবে।
Total Reply(0)
Md Ali Azgor ৩১ মে, ২০২২, ৭:৩০ এএম says : 0
যত্রতত্র প্লাষ্টিক এবং প্লাস্টিকের বোতল ছুড়ে ফেলবেন না. সচেতন হন এখনি। জনসচেনতায় উদ্বুদ্ধ করুন আপনার পরিবার এবং আপনাদের প্রিয়জনদের.
Total Reply(0)
Md Parves Hossain ৩১ মে, ২০২২, ৭:৩১ এএম says : 0
সংবাদপত্রের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের একজন বিজ্ঞানী প্লাস্টিকের আবর্জনা থেকে বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি উৎপাদনের একটি প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও তাকে অনুপ্রাণিত করেছেন। আমাদের ভবিষ্যতকে সুরক্ষিত করার জন্য, তার প্রকল্পকে বিকাশের জন্য তাকে সব সহায়তা দিতে হবে।
Total Reply(0)
Ismail Sagar ৩১ মে, ২০২২, ৭:৩১ এএম says : 0
সব খাবারে আজ বিষ , জীবটা আজ বিষময় হয়ে গেছে। পেটে খেলে পিটে সয়, যাকে বলে মহাশয়।
Total Reply(0)
Mohamed Saleh ৩১ মে, ২০২২, ৭:৩২ এএম says : 0
The serious effect of having plastic indirectly or directly is on our reproductive organ. Plastic is phytoestrogen. Estrogen is female hormone. Phytoestrogen essentially mimics the same chemical structure as estrogen. So,male’s body is getting such female hormone, the result is we are losing our manlihood because estrogen suppresses our testosterone. Anyway, say no to plastic as possible by you and convince others as possible.
Total Reply(0)
s m shahed ullah ৩১ মে, ২০২২, ৭:৩২ এএম says : 0
আমরা নিজোরাঈ নিজেদের কে ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছি কেউ যদি সচেতন হয় তবে তার ফলাফল সে অবশ্যঈ পাবে. নাগরিক সচেতনতা তৈরির জন্য এঈ সংবাদগুলি গুরুত্তপূর্ণ ভুমিকা রাখে।
Total Reply(0)
হরেশ্বর বাবু ৩১ মে, ২০২২, ৭:৩২ এএম says : 0
আমরা মানুষগুল কাগজে কলমে সচেতন না হয়ে যদি সত্যিই সচেতন হতাম, এই সমস্থ সমস্যা তৈরিই হতোনা!
Total Reply(0)
Jalal Uddin Ahmed ৩১ মে, ২০২২, ৭:৩৩ এএম says : 0
‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ এই কথাটিক আগে ছিল, এখন হবে ‘মাছে-প্লাস্টিকে বাঙালি’।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন