শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সারা বাংলার খবর

কুষ্টিয়ায় বেড়েছে খুনোখুনি, উদ্বেগ আত্মহত্যা নিয়েও

কুষ্টিয়া থেকে স্টাফ রিপোর্টর | প্রকাশের সময় : ৬ জুন, ২০২২, ৩:০৩ পিএম

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এক সময়ের রক্তাক্ত জনপদ ছিল কুষ্টিয়া। খুনোখুনি ছিল এখানকার নিত্যদিনের চিত্র। তবে বর্তমান সরকারের সদিচ্ছা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর পদক্ষেপের কারণে এক যুগের বেশি সময় ধরে শান্তির সুবাতাস বইছে এ জেলায়। কিন্তু হঠাৎ করেই শান্ত এ জনপদ আবারও যেন অশান্ত হয়ে উঠেছে। একের পর এক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। চলতি মে মাসে কুষ্টিয়া জেলায় অন্তত নয়জন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।

এদিকে, হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি জেলায় উদ্বেগজনকহারে বেড়েছে আত্মহত্যার ঘটনাও। মে মাসে জেলাজুড়ে অন্তত ১০টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে।


পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত ২ মে ঈদের আগের দিন বিকেলে কুষ্টিয়া সদরের ঝাউদিয়া ইউনিয়নের আস্তানগর গ্রামে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুইপক্ষের সংঘর্ষে একপক্ষের তিনজনসহ চারজন নিহত হন। এ ঘটনায় উভয়পক্ষই একে-অপরকে দায়ী করে থানায় মামলা করে। মামলায় গ্রেফতারের পর কারাগারে পাঠানো হয় ঝাউদিয়া ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান মেহেদী হাসান ও সাবেক চেয়ারম্যান কেরামত আলীকে। দুটি মামলার ৯৮ আসামির মধ্যে সিংহভাগ আসামি জামিনে ছাড়া পাওয়ায় আবারও যে কোনো সময় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে ওই এলাকায়।

৫ মে কুমারখালী উপজেলার গড়াই ব্রিজের নিচ থেকে মাসুদ খাঁ নামে এক ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় থানায় প্রথমে অপমৃত্যু মামলা হলেও পরে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে মেলে হত্যার আলামত। পরে মামলাটি হত্যা মামলা হিসেবে আমলে নেয় পুলিশ।


১০ মে ভেড়ামারা উপজেলার ষোলদাগ গ্রামে জায়গা-জমি সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে খুন হন আব্দুল কুদ্দুস। মে মাসের আরেকটি আলোচিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে গত ১১ মে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলায়। স্থানীয় বাজার থেকে ভ্যানে বাড়ি ফেরার পথে দুর্বৃত্তরা জাসদ যুবজোট নেতা মাহবুব খান সালামকে কুপিয়ে হত্যা করে। এ ঘটনায় এক ইউপি চেয়ারম্যান, উপজেলা যুবলীগের সভাপতিসহ একই পরিবারের চার জনসহ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের আসামি করে মামলা হয়।

১৮ মে সদর উপজেলার দহকুলা গ্রামে খুন হয় জীবন আহমেদ নামে এক এসএসসি পরীক্ষার্থী। রাতে মোটরসাইকেলে করে বাড়ি থেকে বের হয় জীবন। পরদিন সকালে বাড়ি থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে তার মরদেহ উদ্ধার হয়। মোটরসাইকেলটি পাওয়া যায় পুকুর পাড়ে।


এছাড়া, ১৮ মে গভীর রাতে খোকসায় হেলথকেয়ার অ্যান্ড হাসপাতালের কর্মচারী মো. হিরনের মরদেহ পাওয়া যায়। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে হিরনের মৃত্যু হয়েছে বলে প্রচার চালানো হলেও পরিবারের দাবি, এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। এ ঘটনায় পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় হত্যার অভিযোগও করা হয়েছে। বিচারের দাবিতে এলাকাবাসী বিক্ষোভ-সমাবেশ করেছে।

২০ মে শহরের চর মিলপাড়ায় পারিবারিক কলহের জের ধরে মাদকাসক্ত সন্তানের হাতে খুন হন বাবু শেখ। ছেলের কাছে হাত খরচের টাকা চাওয়া ও বাড়িতে ঘর নির্মাণের জায়গা নিয়ে বিবাদে ইটের আঘাতে তার মৃত্যু হয়।

২১ মে সদর উপজেলার ঝাউদিয়া ইউনিয়নের কালিতলা এলাকায় পারিবারিক বিরোধে কুপিয়ে হত্যা করা হয় জসিম নামে এক ব্যক্তিকে। চাচাতো ভাই লালন ঝড়ে নুয়ে পড়া বাঁশ কাটতে গেলে জসিম সেটিকে নিজের দাবি করে বাধা দেন। এতে চাচাতো ভাই ও তার ছেলেদের সঙ্গে মারামারিতে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে জসিমের মৃত্যু হয়।

এই হিসেবে মে মাসে কুষ্টিয়ায় খুন হয়েছেন ৯ জন। এরমধ্যে সদর উপজেলাতেই ছয়জন। ভেড়ামারা, দৌলতপুর ও কুমারখালীতে একজন করে খুন হয়েছেন। এছাড়া খোকসার হিরনের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে ধোঁয়াশা এখনো কাটেনি।

এভাবে একের পর এক খুনের ঘটনা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন জেলার বাসিন্দারা। কুষ্টিয়া সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি রফিকুল আলম টুকু বলেন, সম্প্রতি কুষ্টিয়া জেলায় খুনোখুনির ঘটনা অনেক বেড়ে গেছে, যা চরম উদ্বেগজনক বলে আমি মনে করি। একের পর এক খুনের ঘটনায় পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হচ্ছে। আমি মনে করি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও তৎপর হতে হবে।

কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসগর আলী খুনোখুনির ঘটনা বৃদ্ধির কথা স্বীকার করে বলেন, সামাজিক দ্বন্দ্বের কারণেই অধিকাংশ খুনের ঘটনা ঘটছে। খুনোখুনি থামাতে হলে প্রশাসন, রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি ও সমাজকর্মীদের এক কাতারে দাঁড়াতে হবে।

তবে কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার মো. খাইরুল আলম এসব হত্যাকাণ্ডকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, যে কোনো মূল্যে জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো রাখার জন্য পুলিশের সব ইউনিটকে আরও বেশি তৎপর হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

হতাশ না হয়ে জনসাধারণকে পুলিশের প্রতি আস্থা রাখার অনুরোধ জানান জেলা পুলিশের এই শীর্ষ কর্মকর্তা।

এদিকে, কুষ্টিয়া জেলায় খুনোখুনির ঘটনার পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আত্মহত্যার ঘটনা। মে মাসে জেলাজুড়ে অন্তত ১০টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। আত্মহত্যাকারীদের তালিকায় যারা রয়েছেন তাদের বেশিরভাগই স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এ তালিকায় গৃহবধূও রয়েছেন।


গত ১৮ মে বেলা ১১টার দিকে কুষ্টিয়া শহরের বনফুড বেকারির পেছনের এম এম ছাত্রীনিবাস থেকে জান্নাত রহমান (২০) নামে এক শিক্ষার্থীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তিনি মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার তেঁতুলবাড়িয়া এলাকার জিল্লুর রহমানের মেয়ে। এইচএসসি পাসের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে ছাত্রীনিবাসে থেকে কোচিং করছিলেন জান্নাত।

ছাত্রীনিবাসের অন্য সদস্যরা জানান, জান্নাত তার প্রেমিকের সঙ্গে রাগারাগি করে কয়েকদিন ধরেই আত্মহত্যার চেষ্টা করছিলেন। এজন্য ১৭ মে রাতে তার সঙ্গে ছিলেন বান্ধবীরা। রাত ১টার পর তারা সবাই নিজ নিজ কক্ষে ঘুমাতে যান। সকালে উঠে বান্ধবীরা তাকে ডাকতে গিয়ে দরজা বন্ধ দেখতে পান। তারা আশপাশের লোকজনদের ডেকে দরজা ভেঙে ফেলার ব্যবস্থা করেন। পরে রুমের মধ্যে প্রবেশ করে দেখেন ওড়না পেঁচানো অবস্থায় ঝুলছেন জান্নাত।

গত ২৩ মে কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আবিদ বিন আজাদ নামের ফার্মেসি বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের এক শিক্ষার্থীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ওইদিন বিকেলে ৫টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেটের পাশের একটি ছাত্রাবাসের কক্ষের দরজা কেটে আবিদের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। প্রেমঘটিত কারণে তিনি আত্মহননের পথ বেছে নেন বলে ধারণা পুলিশের।

এ ঘটনার পরেরদিন গত ২৪ মে সকালে কুষ্টিয়া শহরের পুলিশলাইন স্কুলের পেছনে কমলাপুর এলাকার নিজ বাড়ি থেকে দুই সন্তানের জননী নুরজাহান পারভিন মিনুর (৪০) মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তিনি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নজরুল ইসলামের স্ত্রী। স্বামী-সন্তানসহ শহরের পুলিশলাইন স্কুলের পেছনে কমলাপুর এলাকায় বসবাস করতেন। পুলিশের দাবি, স্বামীর সঙ্গে পারিবারিক কলহের জেরে গলায় ফাঁস নিয়ে নুরজাহান আত্মহত্যা করেন। তবে স্বজনদের দাবি, নুরজাহানকে তার স্বামী নির্যাতন করে হত্যা করেছেন।

জেলায় হঠাৎ করেই আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বিষয়টি নিয়ে বিশিষ্ট লেখক, গবেষক ও কুষ্টিয়া পাবলিক লাইব্রেরির সাধারণ সম্পাদক ড. আমানুর আমান বলেন, কুষ্টিয়া জেলা আগে থেকেই আত্মহত্যাপ্রবণ এলাকা। তবে সম্প্রতি এ প্রবণতা অনেকটা বেড়ে গেছে। আত্মহত্যার অনেকগুলো কারণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সামাজিক অবক্ষয় ও পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা। এ থেকে বের হয়ে আসতে হলে কাউন্সিলিং প্রয়োজন। সেইসঙ্গে পারিবারিক বন্ডিং বাড়ানো গেলে আত্মহত্যার প্রবণতা অনেকাংশে কমে আসবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন