পূর্ব ইউক্রেনের লুহানস্ক প্রদেশের প্রায় ৯৭ ভাগই রাশিয়ার দখল করে নিয়েছে বলে জানিয়েছেন রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু। মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য নিশ্চিত করেন তিনি। এদিকে, রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বলেছেস, ইউক্রেনের সাথে বৈঠকে প্রস্তুত রাশিয়া, তবে এটি হবে প্রতীকী।
সামরিক অভিযানের শুরু থেকেই রাশিয়া বলে আসছিল- তাদের একমাত্র লক্ষ্য ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চল বা দোনবাস দখলমুক্ত করা। কারণ, সেখানে রুশ ভাষাভাষী এবং মতাদর্শ পোষণকারীরা নিপীড়নের শিকার। সে উদ্দেশেই পুতিনের সেনাদল অভিযান চালাচ্ছে। দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আরও জানান, দোনবাসের একাংশ লুহানস্কের প্রায় শতভাগই তাদের দখলে। কয়েকদিনের তুমুল লড়াইয়ের পর ইউক্রেনীয় বাহিনীর নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়েছে অঞ্চলটি।
সের্গেই শোইগু বলেন, স্বাধীন ঘোষিত দোনেৎস্ক ও লুহানস্কের বেশিরভাগ শহর এখন মুক্ত। গুরুত্বপূর্ণ শহর এবং ১৫টি বসতি রয়েছে এ তালিকায়। অভিযানের অন্যতম লক্ষ্য- সেভেরোদোনেৎস্কের আবাসিক এলাকা পুরোপুরি রাশিয়ার দখলে। শিল্প এলাকা এবং কাছাকাছি বসতিগুলোও শিগগিরই নিয়ন্ত্রণে আসবে। লুহানস্ক প্রজাতন্ত্রের ৯৭ ভাগ দখলমুক্ত করেছে রাশিয়া।
সেভেরোডোনেৎস্ক থেকে পালাতে বাধ্য হলো ইউক্রেনীয় বাহিনী : ইউক্রেনীয় বাহিনী প্রধান পূর্বাঞ্চলীয় শহর সেভেরোডোনেৎস্ক থেকে রাশিয়ান সৈন্যদের হামলার মুখে গতকাল পালাতে বাধ্য হয়। যদিও আঞ্চলিক গভর্নর জোর দিয়েছিলেন যে, তারা এখনও শহরের ‘প্রতি সেন্টিমিটারের জন্য’ লড়াই করছে। যুদ্ধের প্রথম দিনগুলিতে কিয়েভে হামলার মাধ্যমে সবার দৃষ্টি সেখানে নিবদ্ধ করে রাশিয়া তার ফোকাস কয়লা খনি এবং কারখানার অঞ্চলে স্থানান্তরিত করেছে। এই অঞ্চলটি আংশিকভাবে রাশিয়া-সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে বছরের পর বছর ধরে।
লুহানস্কের গভর্নর সের্হি হাইদাই বুধবার সেভেরোডোনেৎস্কের অসুবিধাগুলি স্বীকার করেছেন, অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে বলেছেন যে, ‘হয়তো আমাদের পিছু হটতে হবে, তবে এই মুহূর্তে শহরে যুদ্ধ চলছে।’ ‘রাশিয়ান সেনাবাহিনীর কাছে যা কিছু আছে - আর্টিলারি, মর্টার, ট্যাঙ্ক, বিমান চালনা - এর সবই তারা সেভেরোডোনেৎস্কে ব্যবহার করছে যাতে করে শহরটিকে পৃথিবীর মুখ থেকে মুছে ফেলা যায় এবং এটি সম্পূর্ণরূপে দখল করা যায়,’ তিনি বলেছিলেন।
বৈঠকে প্রস্তুত রাশিয়া, তবে এটি হবে প্রতীকী : রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ গতকাল তার তুর্কি প্রতিপক্ষ মেভলুত কাভুসোগলুর সাথে আলোচনার পর একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন রাশিয়ার পক্ষ ইস্তাম্বুলে ইউক্রেনের সাথে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় একটি বৈঠকের জন্য প্রস্তুত, তবে বৈঠকটি আসলে শস্য সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে প্রতীকী হবে। ‘ইস্তাম্বুলে (শস্য রপ্তানির ইস্যুতে) অতিরিক্ত মিটিং সম্পর্কে বলব, আমরা এই ধরনের বৈঠকের জন্য প্রস্তুত। আমরা জাতিসংঘের কোনোভাবে জড়িত হওয়ার আগ্রহের প্রশংসা করি, এর উপস্থিতি চিহ্নিত করা, কিন্তু, সত্যি বলতে, এটি প্রতীকী ছাড়া আর কিছুই হবে না,’ ল্যাভরভ বলেছেন।
রাশিয়ান মন্ত্রী যেমন জোর দিয়েছিলেন, এই সমস্যা সমাধানের জন্য যা দরকার তা হল ‘ইউক্রেনীয়রা নিরাপদ করিডোর নির্মূল বা চিহ্নিত করে জাহাজগুলিকে তাদের বন্দর ছেড়ে যেতে দেবে।’ ‘আর কিছুর প্রয়োজন নেই,’ তিনি সংক্ষিপ্ত করে বললেন। ল্যাভরভ এবং তার তুর্কি সমকক্ষ মেভলুত কাভুসোগলুর মধ্যে বুধবার আঙ্কারায় বৈঠক করেন। আশা করা হচ্ছে যে আলোচনায় ইউক্রেন থেকে শস্য রপ্তানি, রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে আলোচনা পুনরায় শুরু করার সম্ভাবনা এবং উত্তর সিরিয়ায় নতুন সামরিক অভিযান শুরু করার তুরস্কের পরিকল্পনার উপর আলোকপাত করা হবে।
ইউক্রেনে সফলভাবে কামিকাজে ড্রোন ব্যবহার : রাশিয়ান কেইউবি এবং ল্যানসেট কামিকাজে ড্রোনগুলি ইউক্রেনে যুদ্ধ অভিযানে নিবিড়ভাবে নিযুক্ত করা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় প্রযুক্তি কর্পোরেশন রোস্টেক গতকাল বার্তা সংস্থা তাসকে জানিয়েছে। ‘কেইউবি এবং ল্যানসেট ড্রোনগুলি যুদ্ধের পরিস্থিতিতে তাদের মূল্য প্রমাণ করেছে। উভয় ড্রোনই বেশ দ্রুত, নিঃশব্দ, ব্যবহার করা সহজ, দশ কিলোমিটার দূরত্ব কভার করতে সক্ষম এবং উচ্চ নির্ভুলতা বৈশিষ্ট্যযুক্ত,’ রোস্টেক বলেছে। ড্রোনগুলি মূলত দূরবর্তী স্থল লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করার জন্য ব্যবহৃত হয়। ‘বিশেষ করে, ল্যানসেট অত্যন্ত স্বায়ত্তশাসিত এবং একটি অপটিক্যাল-ইলেক্ট্রনিক সিস্টেম বহন করে যা স্বাধীনভাবে একটি লক্ষ্যবস্তু বের করতে এবং ধ্বংস করতে সহায়তা করে,’ তারা ব্যাখ্যা করে।
নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করতে তেল রপ্তানি বাড়িয়েছে রাশিয়া : এশীয় ক্রেতাদের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞার প্রভাব কমানোর লক্ষ্যে রাশিয়া তার প্রধান পূর্বাঞ্চলীয় বন্দর কোজমিনো থেকে তেল রপ্তানি প্রায় এক পঞ্চমাংশ বৃদ্ধি করছে, বিষয়টির সাথে পরিচিত তিনটি সূত্র রয়টার্সকে জানিয়েছে।
মস্কো বলেছে যে, তারা পশ্চিম থেকে এশিয়ায় জ্বালানি রপ্তানি পুনরায় রুট করার আশা করছে, তবে ইউরোপীয় সমুদ্র বন্দরগুলি থেকে দীর্ঘ ট্যাঙ্কার ভ্রমণের মাধ্যমে এটি করা ব্যয়বহুল এবং ইউক্রেনের সংঘাতের জন্য পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে জটিল এবং সময়সাপেক্ষ হচ্ছে। রাশিয়ার পাইপলাইন একচেটিয়া ট্রান্সনেফ্ট ইতিমধ্যেই তার প্রধান এশিয়ান তেল রুট, পূর্ব সাইবেরিয়া প্যাসিফিক মহাসাগর (ইএসপিও) পাইপলাইনে কোজমিনোতে পাম্প করা অপরিশোধিত তেলের পরিমাণ বাড়িয়েছে, তেল প্রবাহের গতি বাড়াতে রাসায়নিক সংযোজন ব্যবহার করে প্রতিদিন ৭০ হাজার ব্যারেল করে উত্তোলন করছে।
মস্কো মেগেট থেকে রেলের মাধ্যমে কোজমিনোতে তথাকথিত ইএসপিও ব্লেন্ড ক্রুডের অতিরিক্ত ৮০ হাজার ব্যারেল প্রতিদিন পাঠানোর পরিকল্পনা করেছে, এ রুটটি পূর্বে ইএসপিও পাইপলাইন তৈরির সময় কোজমিনো এবং গার্হস্থ্য শোধনাগার সরবরাহের জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল, সূত্র জানিয়েছে। মইইউ গত সপ্তাহে রাশিয়ার তেলের উপর নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দিয়ে বলেছে যে, তারা বছরের শেষ থেকে রাশিয়া থেকে ৯০ শতাংশ তেল এবং পণ্য আমদানি বন্ধ করবে। চীনের কোম্পানিগুলো, যারা মস্কোর উপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার বারবার সমালোচনা করেছে এবং ভারতে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে দামের পতনের মধ্যে আরও বেশি রাশিয়ান তেল কিনছে। ইএসপিও পাইপলাইন, যা রাশিয়ার সাইবেরিয়ার তেলক্ষেত্রকে কোজমিনো এবং চীনা ক্রেতাদের সাথে স্থলপথে সংযুক্ত করে, এর সামগ্রিক ক্ষমতা প্রতিদিন ১৬ লাখ ৪০ হাজার ব্যারেল।
রাশিয়া-নীতি নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই ম্যার্কেলের : ইউক্রেন সঙ্কটের প্রেক্ষাপটে জার্মানির রাশিয়া নীতিকে কেন্দ্র করে জোরালো বিতর্ক শুরু হয়েছে। বিশেষ করে সাবেক চ্যান্সেলর ম্যার্কেলের আমলেও জার্মানি যথেষ্ট কড়া মনোভাব দেখায় নি বলে অভিযোগ উঠছে। বরং রাশিয়ার জ্বালানির উপর জার্মানির নির্ভরতা বেড়েছে।
শুধু ম্যার্কেল নয়, জার্মান প্রেসিডেন্ট ফ্রাংক-ভাল্টার স্টাইনমায়ারকেও এমন ‘রাশিয়া প্রীতি’-র অভিযোগ শুনতে হচ্ছে। এমনকি সেই কারণে কিয়েভ সফরের পরিকল্পনা করেও তাকে ইউক্রেনের নেতৃত্বের শীতল আচরণের কারণে পিছিয়ে আসতে হয়েছে। এমনই প্রেক্ষাপটে রাশিয়া-নীতি ও অন্যান্য প্রসঙ্গে মুখ খুলেছেন ম্যার্কেল। মঙ্গলবার বার্লিনে এক মঞ্চে দর্শকদের সামনে এক খোলামেলা সাক্ষাৎকারে তিনি ইউক্রেনের উপর রাশিয়ার হামলার নিন্দা করেছেন।
নিজের আমলের রাশিয়া-নীতি নিয়ে ম্যার্কেলের অবশ্য কোনো আক্ষেপ নেই। কী করলে বর্তমান পরিস্থিতি এড়ানো যেতো, তা অবশ্যই তাকে ভাবাচ্ছে। তবে ম্যার্কেলের মতে, পশ্চিমা বিশ্ব এমন কোনো নিরাপত্তা কাঠামো সৃষ্টি করতে পারতো না, যা রাশিয়াকে সন্তুষ্ট করতে পারতো। ফলে নিজের নীতির কারণে ক্ষমা প্রার্থনার কোনো কারণ দেখছেন না ম্যার্কেল। তিনি বলেন, কূটনীতিতে কাজ না হলে সেই কূটনীতি মোটেই ভুল বলে গণ্য করা চলে না।
এমনকি ২০২১ সালেও রাশিয়া বার বার ইউক্রেনের উপর হামলার ইঙ্গিত দিলেও সেই উত্তেজনা কমাতে কূটনৈতিক সমাধানসূত্র খোঁজার চেষ্টা করেছেন বলে দাবি করেন তিনি। ব্যক্তি হিসেবে পুতিনের মূল্যায়নেও নিজের কোনো ভুলভ্রান্তির অবকাশ দেখছেন না ম্যার্কেল। রুশ ভাষায় পারদর্শী সাবেক জার্মান চ্যান্সেলর জার্মান ভাষায় পারদর্শী পুতিনকে চেনার অনেক সুযোগ পেয়েছেন। ম্যার্কলের মতে, পুতিন এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভেঙে দিতে চেয়েছেন, যে বিষয়ে তিনি ইউরোপীয় নেতাদের বার বার সতর্ক করে দিয়েছেন। সাবেক চ্যান্সেলর হিসেবে ম্যার্কেল বর্তমান সরকারের নীতি নিয়ে সরাসরি মুখ না খুললেও তিনি চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎসের নেতৃত্বে বর্তমান সরকারের প্রতি পূর্ণ আস্থা প্রকাশ করেন। সূত্র : ডয়চে ভেলে, রয়টার্স, এপি, ডেইলি সাবাহ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন