মধ্যপ্রাচ্যে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, সিরিয়ায় রিজিম চেঞ্জ’র নামে গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গত পাঁচ বছরে অন্তত ৫ লাখ নিরপরাধ মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে। তথাকথিত মানবাধিকারের প্রবক্তাদের কাছে মুসলমানদের রক্ত, মানবাধিকার ও জীবন যেন ইতর প্রাণীর চেয়েও মূল্যহীন। সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া ও ইয়েমেন থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ প্রাণভয়ে সমুদ্রপথে ইউরোপে পাড়ি দিচ্ছে। এদের মধ্যে শত শত মানুষ সামুদ্রিক ঝড়-ঝঞ্ঝাসহ নানা ধরনের দুর্বিপাকে পড়ে প্রাণ হারাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের গৃহযুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের টার্গেটেড জনগোষ্ঠীর বাইরে এ মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে নিগৃহীত জনগোষ্ঠীর নাম মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমান। মিয়ানমারে সামরিক জান্তা সরকার আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন ও একঘরে হয়ে সামরিক শাসনের কঠোর নিয়ন্ত্রণের আড়ালে রাখাইন রাজ্যের সংখ্যালঘু মুসলমানদের বিতাড়িত করে সেখানে হিংস্্র, বর্বর সাম্প্রদায়িক বৌদ্ধদের অবস্থানকে নিরঙ্কুশ করার মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে। অর্ধশত বছরের সামরিক শাসনের জগদ্দল পাথর ভেঙে জাতিগত হিং¯্রতা ও বৈষম্য দূর করে মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক নেত্রী অং সান সুচির নেতৃত্বে যখন গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের নিরাপত্তার প্রত্যাশা বড় হয়ে উঠেছিল, তখন মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানরা বিশ্ব ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যা ও মানবাধিকার বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। মিয়ানমার বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী রাষ্ট্র এবং রোহিঙ্গারা মুসলমান হওয়ায় রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর পৈশাচিক নির্মমতার ঘটনাগুলো বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষকে ব্যথিত, ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত করছে। শুধু বাংলাদেশিরাই নয়, মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর সে দেশের সামরিক বাহিনীর জাতিগত নিশ্চিহ্নকরণ অভিযানের মর্মস্পর্শী ঘটনাগুলো এখন পুরো মানব সভ্যতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে। নির্বাচনের মাধ্যমে, গণতন্ত্রে প্রবেশ করলেও দীর্ঘদিনের সামরিক শাসনে আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন বা ‘পেরিয়াহ স্টেট’র তকমা থেকে মিয়ানমার এখনো বেরিয়ে আসতে পারেনি। তদুপরি রাখাইন রাজ্যটি ভূপ্রাকৃতিকভাবেই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের জন্য একটি দুর্গম এলাকা। রাখাইনের স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম কর্মীদের পক্ষে সেখানকার প্রকৃত চিত্র তুলে আনা অত্যন্ত কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় সেখানকার প্রকৃত চিত্র বিশ্ব সম্প্রদায় জানতেও পারছে না। বহু দশক ধরে অমীমাংসিত রোহিঙ্গা ইস্যুর রাজনৈতিক সমাধান এবং একটি রিকনসিলিয়েশনের জন্য জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে মিয়ানমার সরকারের সাথে কাজ করতে গিয়ে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান ইতোমধ্যে অত্যন্ত তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন। যদিও তিনি এখনো হাল ছেড়ে দেননি। রাখাইনে নতুন করে এথনিক ক্লিনজিং শুরু হওয়ার প্রেক্ষাপটে কফি আনান গত সপ্তায় যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন সেখানে তিনি বার্মিজদের একটি বর্বর জাতি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
রাখাইনের আদিবাসী জাতিগুলোর মধ্যে প্রধান দুটো জাতির একটি রোহিঙ্গা মুসলিম অন্যটি মগ। আমাদের দেশও এক সময় মগদের হত্যা, লুণ্ঠন ও ডাকাতির শিকার হয়েছিল। সেই থেকে ‘মগের মুল্লুক’ অন্যায়-অবিচারের সমার্থক শব্দ হিসেবে আমাদের কাছে পরিচিত। মূলত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মগরাই রাখাইনের আদিবাসী রোহিঙ্গাদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী। শত শত বছর ধরে আরাকানে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করে তারা সেখানে একক জাতিগোষ্ঠী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে চায়। মগ এবং ধর্মান্ধ ও সহিংস বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সাইকোলজি বুঝে মিয়ানমারের সেনা শাসকরা শুরু থেকেই রাখাইনের রোহিঙ্গাদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য এথনিক ক্লিনজিং অপারেশন চালিয়ে এসেছে। গত বছর মিয়ানমারে ঐতিহাসিক নির্বাচনে গণতন্ত্রপন্থি নেত্রী অং সান সুচির এনএলডি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা র মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসার পর রাখাইনে একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন অত্যাসন্ন বলে ধরে নেয়া হয়েছিল। সে ধারণা ভূল প্রমাণিত হয়েছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী সংখ্যাগরিষ্ঠ বার্মিজদের সমর্থন পাওয়ার লক্ষ্যে রোহিঙ্গাবিরোধী তৎপরতা জোরদার করেছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ইচ্ছায় কফি আনানের নেতৃত্বে রোহিঙ্গা ইস্যু সমাধানের জন্য গঠিত কমিটি কাজ শুরু করার পর থেকে সেখানে বৌদ্ধদের সহিংসতা এবং সেনাবাহিনীর এথনিক ক্লিনজিং বেড়ে যাওয়ার ঘটনা থেকে এটা অনুমান করা যায়, এসব ঘটনায় সেখানকার রাজনৈতিক বাস্তবতা ও সেনাবাহিনীর কাছে নির্বাচিত এনএলডি সরকার ও অং সান সুচির ব্যর্থতা ও অসহায়ত্ব ধরা পড়ে। নভেম্বরের ১০ তারিখে গ্লোবাল ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন অনলাইনে প্রকাশিত রিপোর্টে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তার জনসমর্থন বাড়াতে রাখাইনদের ওপর যুদ্ধের কৌশল গ্রহণ করেছে বলে জানিয়েছে।
খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতক থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত আরাকান রাজ্য ২২ হাজার বর্গমাইলের মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ স্বাধীন রাজ্য ছিল। সে সময় আরাকান স¤্রাট নারামেখলার উত্তরসূরিরা কক্সবাজারের রামু ও চট্টগ্রাম দখল করে নিয়েছিল বলে জানা যায়। স¤্রাট নারামেখলা রাজনৈতিক কারণে ২৪ বছর বাংলায় নির্বাসিত জীবন কাটানোর পর বাংলার সুলতান জালালুদ্দিন মুহম্মদ শাহের সামরিক সহায়তা নিয়ে পুনরায় আরাকানের সিংহাসনে আরোহণ করেন। সে সময় নারামেখলার সাথে অনেক মুসলমান আরাকানে গিয়েছিল এবং নারামেখলা নিজেও ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন বলে জানা যায়। এসব কারণে চট্টগ্রামের ভাষা এবং ধর্মীয় সংস্কৃতির সাথে রোহিঙ্গাদের অনেক মিল পাওয়া যায়। রোসাঙ্গ রাজদরবারে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা আমাদের সাহিত্যের ইতিহাসের অংশ। পরবর্তীকালে মিয়ানমারের রাজা বোদাওফায়া এ রাজ্য দখল করে এখানকার রোহিঙ্গাদের ওপর বৌদ্ধ ধর্ম চাপিয়ে দিয়েছিল। পরবর্তীতে বৃটিশদের কলোনি হওয়ার পরও মুসলমানদের নির্মূল করার রাজনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত ছিল। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বরতা শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সালে বৃটিশদের কাছ থেকে মিয়ানমারের স্বাধীনতা লাভের পর। এর আগে বৃটিশরা বার্মায় বসবাসরত সব জাতিগোষ্ঠীর একটি তালিকা তৈরি করেছিল যেখানে ১৩৯টি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাম ছিল না। মূলত মিয়ানমারের জান্তা সরকারের রোহিঙ্গা উচ্ছেদ এবং মিয়ানমারের আদি বাসিন্দা হিসেবে রোহিঙ্গাদের অবস্থান অস্বীকার করার প্রবণতার বিষবৃক্ষ বৃটিশরাই রোপণ করে রেখে গিয়েছিল। আজকের কাশ্মীর সমস্যা, বেলুচিস্তান সমস্যা, কুর্দি সমস্যা এবং ফিলিস্তিন সমস্যার বীজও বৃটিশদের রোপিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানিসহ ইউরোপে নাজি দখলদার বাহিনীর হাতে লাখ লাখ ইহুদি গণহত্যার শিকার হয়েছিল। বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনের আরব মুসলমানদের ভূমিতে ইহুদিদের জন্য একটি স্বাধীন আবাসভূমি গড়ে তোলার পুরনো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয় ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র গঠনের মধ্য দিয়ে। যুদ্ধে হিটলারের বাহিনীর হাতে ইহুদি গণহত্যা বা হলোকস্ট ইহুদিদের প্রতি বিশ্ব সম্প্রদায়ের এক ধরনের সিম্প্যাথি তৈরি করেছিল বলেই আরব ভূমিতে জবরদস্তিমূলক ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বেআইনি পরিকল্পনার বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছিল। জার্মান জাতীয়তাবাদী নাৎসিদের হাতে গণহত্যার শিকার হওয়া ইহুদিরা ইসরাইলে একত্রিত হয়ে প্রতিবেশী মুসলিমদের ওপর হত্যা-নির্যাতনের পথ বেছে নিয়েছিল। গত শতকের চল্লিশের দশক থেকে শুরু হয়ে এখনো ফিলিস্তিনে ইহুদিদের মুসলিম নিধন ও মুসলমানদের ভূমি দখলের ধারাবাহিক পরিকল্পনার বাস্তবায়ন অব্যাহত আছে। মুসলমানদের হত্যা ও বিতাড়ন করে ফিলিস্তিনে নতুন নতুন ইহুদি বসতি গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে সেখানে ইহুদিদেরকে সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিগোষ্ঠী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জায়নবাদি প্রোগ্রাম সাত দশক ধরে চলমান থাকলেও বিশ্বসম্প্রদায়ের যেন এই মাৎস্যন্যায়ের বিপরীতে কিছুই করণীয় নেই। এমনকি বিশ্বের শতাধিক মুসলমানের প্রতিনিধিত্বশীল অর্ধশতাধিক মুসলিম রাষ্ট্রের সরকারগুলোর নীরবতাও বিস্ময়কর। ওআইসি, আরব লীগের মতো সংস্থাগুলো মূলত মুসলমান রাষ্ট্রগুলোর সমন্বয়ে মুসলমানদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও মানবিক অধিকারের স্বার্থে গঠিত হলেও মুসলমানদের এসব আন্তর্জাতিক সংস্থাও যেন ইহুদিবাদী পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছে।
বিশ্বে প্রতিনিয়ত রাজনৈতিক মানচিত্রের পরিবর্তন ঘটে চলেছে। গত তিন দশকে বিশ্ব মানচিত্রে অন্তত ২৫টি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে মধ্য এশিয়ায় কয়েকটি মুসলিম রাষ্ট্র আত্মপ্রকাশ করলেও স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের ক্রীড়নক বিশ্ব সম্প্রদায় আর কোনো মুসলমান রাষ্ট্রের অভ্যুদয় দেখতে চায় না। এ কারণেই ভারতের কাশ্মীরিরা, চীনের কাশগরিরা, আরাকানের রোহিঙ্গারা দশকের পর দশক রক্তঝরা লড়াই করে অস্তিত্বের সংকটে পড়েও স্বাধীনতা পাচ্ছে না। অন্যদিকে পূর্ব তিমুরে, দক্ষিণ সুদানের খ্রিস্টান সংখ্যালঘুরা পশ্চিমাদের সমর্থনে খুব সহজেই স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা পেয়ে গেছে। ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ফুলের মতো শিশুদের ওপর ইসরাইলি বর্বরতার দৃশ্য এখন আর কারো হৃদয়ে তেমন দাগ কাটে না। সাম্প্রতিক বিশ্ব ইতিহাসে গণহত্যা ও সাম্প্রদায়িক নিধনযজ্ঞের শিকার হওয়ার ঘটনাগুলোর নব্বই শতাংশই ঘটছে মুসলিম অধুষ্যিত দেশে ও জনপদে। নব্বইয়ের দশকে বসনিয়া-হার্জেগোভিনায় মুসলিম গণহত্যা বা পরিকল্পিত এথনিক ক্লিনজিং-এর ঘটনা সমকালীন বিশ্ব ইতিহাসের ন্যক্কারজনক বর্বরতার দলিল। সাবেক যুগোশ্লাভিয়ায় সার্ব, ক্রোট এবং মুসলিমদের প্রায় সমানুপাতিক ও ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান থাকলেও যুগোশ্লাভিয়া ভেঙে যাওয়ার পর বসনিয়া-হার্জেগোভিনায় সার্ব ও ক্রোয়েটদের টার্গেট ছিল সেখান থেকে মুসলমানদের বিতাড়িত করে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোকে ভাগ করে নেয়া। ফেডারেশন অব বসনিয়া-হার্জেগোভিনা থেকে একে একে স্লোভেনিয়া, সার্বিয়া, ক্রোয়েশিয়া, মন্টিনেগ্রো ও মেসিডোনিয়া স্বাধীন হয়ে গেলেও ২০০৮ সালে সার্বিয়া থেকে কসোভোর স্বাধীনতার স্বীকৃতি পাওয়ার আগে কসোভোর হাজার হাজার পরিবারকে নির্মম মৃত্যু ও বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। প্রায় এক দশক ধরে চলা জাতিগত সংঘাতে বসনিয়ায় লক্ষাধিক মানুষকে হত্যা ও ২০ লাখের বেশি মানুষকে বাস্তুহীন করার অপরাধে সার্ব নেতা রাদোভান কারাদজিস, ক্রোয়েট নেতা স্লোভোদান মিলোসেভিস আন্তর্জাতিক আদালতে শাস্তির সম্মুখীন হয়েছেন। ত্রিশের দশকে স্পেনিশ গৃহযুদ্ধের সময় (১৯৩৭) হিটলার ও মুসোলিনীর সর্মথনপুষ্ট স্পেনিশ বাহিনী গুয়ের্নিকা নামের একটি বাস্ক গ্রামে বোমা হামলা চালিয়ে প্রায় ৮০০ বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করার ঘটনা সারা বিশ্বের গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক পরিম-লে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। পাবলো পিকাসোর বিখ্যাত গুয়ের্নিকা চিত্রকর্ম, পল এলুয়ারের কবিতা এবং প্যাট্টিক অ্যাসিওন, লুই ব্যারনের মতো সঙ্গীত তারকাদের সঙ্গীতে গুয়ের্নিকা গণহত্যার ঘটনা ইউরোপীয় সাহিত্যে একটি নতুন ধারার প্রতিবাদী সাহিত্যচিন্তার জন্ম দেয়। অথচ ১৯৯৫ সালের জুলাই মাসে সার্ব ও ক্রোটদের হাতে বসনিয়ার সেব্রেনিসায় অন্তত ১০ হাজার বেসামরিক মানুষ পরিকল্পিত গণহত্যার শিকার হলেও এই মৃত্যুর মূল্য যেন অনেক কম। বসনিয়া-হার্জেগোভিনার গৃহযুদ্ধে প্রাণ হারানো ৫ লক্ষাধিক মানুষের বেশির ভাগই মুসলমান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর নতুন আমেরিকান সা¤্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থায় প্রতি দশকেই তৃতীয় বিশ্বের কোনো না কোন দেশ গৃহযুদ্ধ ও গণহত্যার শিকার হয়েছে। এসব রাজনৈতিক টারময়েলের পেছনে যেসব ভৌগোলিক ও জাতিগত বিষয় কাজ করেছে তার পেছনে যেমন সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তির প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ইন্ধন ছিল, অথবা সংঘাত শুরু হওয়ার পর দ্রুত নিষ্পত্তির সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তারা মীমাংসার উদ্যোগ না নিয়ে নীরব দর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করে পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তোলার ক্ষেত্রে নেপথ্য ভূমিকা পালন করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিশেষত যেসব মুসলমান জনগোষ্ঠী দশকের পর দশক ধরে গৃহযুদ্ধ ও স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে তার প্রায় সবগুলোই প্রধানত বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের ক্ষতচিহ্ন বহন করছে। বিশ্বের বৃহত্তম সেক্যুলার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকার মুসলিমবিদ্বেষী নানা আইনকানুন ও রাজনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে। তারই অনুসরণে মিয়ানমারে বৌদ্ধদের উগ্র জাতীয়তাবাদের আগুনে পুড়ছে রোহিঙ্গা মুসলমানরা। এমনকি গণতন্ত্র ও বহুত্ববাদী সেক্যুলার সমাজের রোল মডেল হিসেবে গণ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উগ্র শ্বেতাঙ্গ খ্রিস্টান জাতীয়তাবাদের রুদ্র চেহারা দেখা যাচ্ছে।
হাজার বছর ধরে বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। ঔপনিবেশ উত্তর ভারতে প্রতি বছর শত শত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হলেও বাংলাদেশে তা বিরল ঘটনা। এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কমেছে। এর প্রধান কারণ হতে পারে এ দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতা, বাংলাদেশি হিন্দুদের জন্য ভারতে সহজলভ্য অভিবাসন নীতি এবং হিন্দুদের ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কার। সেই সাথে কিছু রাজনৈতিক দুর্বৃত্ত ও স্বার্থান্বেষী মহল হিন্দুদের সম্পত্তি গ্রাস করার কুমতলবে তাদেরকে ভিটেমাটি ছাড়তে বাধ্য বা প্ররোচিত করার বাস্তবতাও বিদ্যমান আছে। সাম্প্রতিক সময়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে এক হিন্দু যুবকের ফেজবুকে ইসলাম অবমাননাকর আপত্তিজনক ছবি পোস্ট করার কারণে যে দুঃখজনক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে তার পেছনে সরকারি দলের দুই গ্রুপের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এসব ঘটনায় বাংলাদেশ সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও দেশের সব রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার পক্ষে জোরালো ভূমিকা পালন করার পরও ভারতের পক্ষ থেকে বিশেষ তাগিদ উচ্চারিত হয়েছে। ইতিপূর্বে বিভিন্ন সময়ে মেকি ও তুচ্ছ ঘটনায়ও বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ তুলে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের ঔদ্ধত্য ও অসৌজন্যমূলক দাবি তুলেছে ভারতের রাজনীতিক নেতারা। পক্ষান্তরে মিয়ানমারের মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করার দুরভিসন্ধির বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সকল নাগরিক সমাজসহ বিশ্ব সম্প্রদায়ের ব্যাপক জনমত গড়ে উঠলেও বাংলাদেশ সরকারের নীরব দর্শকের ভূমিকা অত্যন্ত দুঃখজনক ও বিস্ময়কর। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেশের কোটি কোটি মানুষ মিয়ানমারের মুসলমান নারী ও শিশুদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারা, হেলিকপ্টার গানশিপ থেকে গুলি করে হত্যা করা এবং সংঘবদ্ধ বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের দ্বারা মুসলমান যুবকদের সাপের মতো পিটিয়ে মেরে ফেলার দৃশ্য দেখে মর্মাহত, ব্যথিত ও বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকে জোরালো প্রতিবাদ ও কার্যকর কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণের দাবি তোলা হয়েছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধদের রোহিঙ্গা গণহত্যার দায় মিয়ানমারের বর্তমান সরকারের ওপর বর্তায়। এ জন্য বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে অং সান সুচির নোবেল শান্তি পদক কেড়ে নেয়ার দাবি তোলা হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ার পাশাপাশি পশ্চিমা এবং আমাদের গণমাধ্যমগুলোতেও প্রতিদিনই মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যার কিছু সংবাদ ছাপা হচ্ছে। তবে এ দেশের সাধারণ মানুষ বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী রাষ্ট্রে মুসলমানদের ওপর সংঘটিত বর্বরতম গণহত্যার শীতল ভূমিকায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং আমাদের সরকার ও গণমাধ্যমের এমন ভূমিকায় অসন্তোষ ও বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে। হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্য ধরে রাখার পরও যখন ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের কল্পিত অভিযোগ তুলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়, ভারতে হিন্দুদের জন্য ভিসা ও অভিবাসন উন্মুক্ত করে দেয়া হয়, তখন বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যার বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিবাদ করতেই শুধু ব্যর্থ হচ্ছে না, জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থা (ইউএনএইচসিআর)সহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দেয়ার আহ্বান সত্ত্বেও রোহিঙ্গাদের জন্য সব দরজা বন্ধ করে দেয়ার কঠোর অবস্থান গ্রহণ করছে। রাখাইনের বিশ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমানের একটি বড় অংশই এখন বাংলাদেশ, সৌদি আরব, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছে। নিকটতম প্রতিবেশী এবং ঐতিহাসিক ও ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক সম্পর্কের কারণেই বাংলাদেশের কাছে রোহিঙ্গারা বৈরী সামরিক শক্তির গণহত্যার বিরুদ্ধে মানবিক সহায়তা প্রত্যাশা করে। অর্ধশতাব্দীর বেশি কাল ধরে বাংলাদেশে অবস্থানরত লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর নিজ দেশে পুনর্বাসন এবং নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার দাবিতে বাংলাদেশকেই সবচেয়ে জোরালো ভূমিকা নিতে হবে। বাংলাদেশের নিকটতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নে অনেক সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র থাকলেও মূলত রোহিঙ্গা ইস্যুটি প্রধান অন্তরায় হিসেবে দেখা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে মিয়ানমার ও ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির মতো রোহিঙ্গা ইস্যুর রাজনৈতিক ও আইনগত সমাধানের উদ্যোগ নিয়ে বাংলাদেশকেই এগিয়ে যেতে হবে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এবং গবেষকদের পক্ষ থেকে এখন প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারকে কেন যথেষ্ট চাপ দেয়া হচ্ছে না? রাখাইনে রোহিঙ্গাদের শত শত বছরের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস ও ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও তাদেরকে অস্বীকার করার পেছনে পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শক্তির ঐতিহাসিক ভুল এবং বর্তমানে রোহিঙ্গা গণহত্যায় জাতিসংঘসহ পশ্চিমাদের শীতল ভূমিকা যেন একই মনস্তাত্ত্বিক সূত্রে গাথা। কিন্তু লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর বোঝা নিয়ে বাংলাদেশ কেন চুপ থাকবে? এ দেশের সব মানুষ সহৃদয় মানবিক বোধসম্পন্ন। অন্তরে মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ রয়েছে। তারা বর্বর গণহত্যার বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াতে চায়। জাতিসংঘসহ বিশ্বসম্প্রদায়ের মানবিক দাবির কথা বাদ দিলেও কোনো দেশের গণতান্ত্রিক সরকার জনগণের এমন ইচ্ছাকে অগ্রাহ্য করতে পারে না। হাজার হাজার রোহিঙ্গা শরনাথী বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করায় রোহিঙ্গা সমস্যা এখন একটি আর্ন্তজাতিক ইস্যু। রাখাইনে চলমান মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এখনিক ক্লিনজিং বন্দে বিশ্বসম্প্রদায় ও জাতিসংঘকে জোরালো উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশ, ভারত, চীন, সৌদি আরবসহ আঞ্চলিক শক্তিগুলো নিরব দর্শকের ভূমিকা পালনের কোন সুযোগ নেই। একটি সম্মিলিত ও মানবিক উদ্যোগে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা মিয়ানমারের নেই।
bari_zamal@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন