মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সারা বাংলার খবর

কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতি অবনতি, জেলার ৩২৫ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ

পানিবন্দী মানুষের দুর্ভোগ চরমে : ত্রাণ অপ্রতুল

কুড়িগ্রাম থেকে শফিকুল ইসলাম বেবু | প্রকাশের সময় : ২৩ জুন, ২০২২, ১০:২০ এএম

কুড়িগ্রামের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অপরিবর্তিত রয়েছে। বন্যাদুর্গত আড়াইলাখ মানুষের দুর্ভোগ এখন চরমে উঠেছে। খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির জন্য হাহাকার চলছে। সরকারি ত্রাণ সহায়তা অপ্রতুল হওয়ায় সবার ভাগ্যে জুটছে না ত্রাণ। জেলার৩২৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পানিতে নিজজ্জিত হওয়ায় শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। ফলে প্রায় ৮৫ হাজার শিক্ষার্থীর পড়ালেখা বন্ধ। এ পর্যন্ত ১৫ হাজার ৮৫২ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। যার অধিকাংশ পাট, আউস ধান,বীজতলা এবং সবজি ক্ষেত।
গত ২৪ ঘন্টায় ব্রহ্মপুত্র ও ধরলার পানি কিছুটা কমেছে। সেতু পয়েন্টে ধরলা নদীর পানি ২১ সেন্টিমিটার কমে বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার ও চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি ১৬ সেন্টিমিটার কমে বিপৎসীমার ৩৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্ল্যাহ আল মামুন এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, কয়েক দিনের মধ্যে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার শহিদুল ইসলাম জানান, বন্যার কারণে জেলায় ২৯৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৬৫হাজার শিক্ষার্থী পাঠ কার্যক্রমের বাইরে আছে। তবে শিক্ষকরা নিয়মিত স্কুলের খোঁজখবর রাখছেন, পানি নেমে গেলেই শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা হবে।
জেলা শিক্ষা অফিসার শামুল আলম জানান, ২৩টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৭টি মাদ্রাসা এবং একটি কলেজ বন্যার কারণে বন্ধ রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার।
এক সপ্তাহেরও বেশি সময় পানিবন্দী থাকার কারণে চরাঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। খাদ্য,বিশুদ্ধ পানি ও শৌচাগারের অভাবে মানবেতর জীবন যাপন করছে অনেক এলাকার বন্যার্তরা। কুড়িগ্রাম জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী হারুন অর রশিদ জানান, উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে বন্যা কবলিত এলাকায় বিশুদ্ধ পানি সরবারহের জন্য নলকূপ স্থাপন, পুরাতন নলকূপ মেরামত ও অস্থায়ী টয়লেট স্থাপন করা ছাড়াও পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট সরবারহ করা হচ্ছে।
এদিকে সদর উপজেলার পোড়ারচর, উলিপুরের মশালের চরসহ কয়েকটি চরে ঘরবাড়ি ডুবে থাকায় অনেকেই বাস করছেন নৌকায়। ¯্রােতের টানে অনেকের ঘরবাড়ি ভেসে যাচ্ছে। এ পর্যন্ত প্রায় দুশ ঘরবাড়ি বন্যার ¯্রােতে বিধবস্ত হয়েছে বলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বরাতে জানাযায়।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ পরিচালক আব্দুর রশিদ জানান, সদর উপজেলার বুধবার পর্যন্ত ১৫ হাজার ৮৫২ হেক্টর জমির ফসল বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। এরমধ্যে ৯ হাজার ৫২১ ক্টের জমির পাট, ৩ হাজার ৫৮০ হেক্টর জমির আউস ধান, ১ হাজার ৬৬১ হেক্টর জমির সবজি রয়েছে।
কদমতলা গ্রামের কৃষক মোক্তার আলী জানান, তার ৯ বিঘা জমির পটল নষ্ট হয়েছে। কয়েক লাখ টাকার পটল ক্ষেতের ক্ষতি হওয়ায় তিনি হতাশ হয়ে পড়েছেন। সদর উপজেলার পাঁচগাছি ইউনিয়নের কদমতলা, সিতাইঝাড়, গারুহারা, উত্তর নওয়াবশ গ্রামের সব পটল ক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে। এই এলাকায় পটল চাষের উপর নির্ভর করেন অনেক কৃষক পরিবার।
সদর উপজেলার চর পার্বতীপুর গ্রামের আবুল হোসেন জানান,‘ নিজেরা না হয় কোন রকমে চলবের নাগছি ্িকন্তু গরু-ছাগল নিয়া খুব বিপদে আছি। খড়ের গাদা পানিতে ভিজি গেইছে। এখন কি দেই আর কি খাওয়াই। খুব দুশ্চিন্তায় আছি।’
সদর উপজেলার ভগবতীপুর চরের জোহরা খাতুন জানান, চুলা জ্বালাতে পারছি না। ঘরেও সবকিছু তলিয়ে গেছে। ছেলে-মেয়ে নিয়ে খুব কষ্টে দিন পার করছি।
উলিপুর উপজেলার বেগমগন্জ ইউনিয়নের বাসিন্দা আমির হোসেন জানান, বন্যার পানিতে ঘর-বাড়ি তলিয়ে থাকায় নিজেরা তো কষ্টে আছি। এ অবস্থায় গরু ছাগলের খাবারও জোগাড় করতে পারছি না।
এদিকে সরকারি-বেসরকারিভাবে ত্রাণ তৎপরতা শুরু হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বলে জানা গেছে। অনেক পানিবন্দী এলাকায় সরকারি বা বেসরকারীভাবে কেউ খোঁজ নিতেও আসেনি বলে বানভাসীরা অভিযোগ তুলেছে। বন্যার পানির কারণে মানূষজন চিকিৎসা কেন্দ্রে যেতে পারছে না। নৌকা সংকট আর গ্রামীণ রাস্তা ঘাট সবই পানির নীচে।
কুড়িগ্রাম সদরের ঝুনকার চর কমিউনিটি ক্লিনিক এর কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার মিজানুর রহমান জানান, চার দিকে থৈ থৈ পানি। লোকজন নৌকায় ও কলাগাছের ভেলায় করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্বাস্থ্য সেবা নিতে আসে। এখানে আসার নিয়মিত কোন নৌকা নেই। অফিসেরও নৌকা নেই। এনজিওদের সহায়তায় তাদের নৌকায় অফিসে আসতে হয়। সময়মত আসা এবং যাওয়া সম্ভব হয় না। তাই অফিসেই একটা রুমে কষ্ট করে থাকছি। নারী ও শিশুসহ গড়ে প্রতিদিন ১৫/২০ জন চিকিৎসা সেবা ও ঔষধ নিতে আসে।
সিভিল সার্জন ডা.মঞ্জুর-এ-মোর্শেদ জানান, বন্যার কারণে ২টি ক্লিনিক বন্ধ হয়ে গেছে। কমিউনিটি ক্লিনিক দুটি হলো হলোখানা ও লক্ষিকান্ত। এছাড়া ১৮টি কমিউনিটি ক্লিনিক পানিতে নিমজ্জিত হলেও সেবা প্রদান কার্যক্রম চালু আছে।
সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর জানান, আমার ইউনিয়নে ১৪শ’ পরিবার প্লাবিত হয়েছে পানিবন্দী হয়েছে আরো ৩ হাজার ৫শ’ পরিবার। ঘোগাদহ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল মালেক সরকার জানান, আমার ইউনিয়নে ৭৫০টি পরিবার প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী হয়েছে ৪ হাজার পরিবার। ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান জানান, আমার ইউনিয়নে পানিবন্দী হয়েছে ৫ হাজার ৮৪১টি পরিবার। ত্রান পেয়েছে মাত্র ৭শ’ পরিবার। পাঁছগাছী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল বাতেন জানান, আমার ইউনিয়ন পুরো প্লাবিত হয়ে পরেছে। একটি বাড়ী পাবেন না যেখানে মানুষ শান্তিতে আছে। সব চেয়ারম্যাগন একই অভিযোগ করেন তা হলো-‘ত্রাণ সহায়তা অপ্রতুল’।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম জানিয়েছেন, দুর্গম চরগুলোতে উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে জরুরি ভিত্তিতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ত্রাণ সহায়তা দেয়া হচ্ছে। ত্রাণের কোন সমস্যা নেই। চাহিদা দেয়ার পর পরই প্রয়োজনীয় ত্রাণের বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত ৯ উপজেলার বন্যা কবলিত মানুষের জন্য ৩৩৮ মেট্রিক টন চাল, নগদ ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা, ১ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, ১৮ লাখ ৯৫ হাজার টাকার শিশু খাদ্য ও ১৭ লাখ ৭৫ হাজার টাকা গো-খাদ্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম চলমান আছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন