বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

লোডশেডিংয়ের তীব্রতা বাড়ছে

শতভাগ বিদ্যুৎ : রাত হলেই গ্রাম অন্ধকার রাতের বেশির ভাগ সময় বিদ্যুৎ না থাকায় গ্রামের হাটবাজারে কেরোসিনের চাহিদা এবং মোমবাতির কদর বেড়ে গেছে

ইনকিলাব রিপোর্ট | প্রকাশের সময় : ৩ জুলাই, ২০২২, ১২:০১ এএম

শতভাগ বিদ্যুতের যুগে প্রবেশ করেছে দেশ। প্রতিদিন সাড়ে ২৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতার কথা প্রচার করা হচ্ছে। এখন গড়ে উৎপাদন হয় সাড়ে ১২ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু গ্রামের অন্ধকার কাটছেই না। হাজার হাজার সংযোগ দেয়া হলেও বিদ্যুতের অভাবে এখনো দেশের বেশির ভাগ গ্রামে রাতে হ্যারিকেন জ্বালানো হয়। বাজারে কেরোসিন তেল ও মোমবাতির বিক্রিও বেশি। কারণ রাজধানী ঢাকায় দিনে তিন থেকে ৫ বার বিদ্যুৎ চলে গেলেও গ্রামে মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ আসে। গ্রামের মানুষ রসিকতা করে বলে থাকেন ‘বিদ্যুৎ যায় না আসে’। ঝড়বৃষ্টি হলে বিদ্যুৎ চলে গেছে দুই থেকে তিনদিন বিদ্যুতের দেখা পায় না গ্রামাঞ্চলের মানুষ। ইনকিলাবের উপজেলা পর্যায়ের সাংবাদিকরা এমন তথ্যই জানিয়েছেন।

চলতি বছরের মার্চ মাসেই দেশের শতভাগ মানুষকে বিদ্যুৎ সুবিধায় আনার ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। বিপুলসংখ্যক জনগণকে সংযুক্ত করার পর টেকসই, নিরবচ্ছিন্ন এবং সাশ্রয়ী বিদ্যুৎসেবা নিশ্চিত করাই ছিল সরকারের চ্যালেঞ্জ। তবে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে ভিন্ন চিত্র সামনে এসেছে। ঢাকার অবস্থা অনেকটা সহনীয় হলেও ঢাকার বাইরের চিত্র ভয়াবহ। চট্টগ্রাম, খুলনা, যশোর, নওগাঁ, পঞ্চগড়, খাগড়াছড়ি, বরগুনা, ঝিনাইগাতী, ঝিনাইদহ, চাপাইনবাবগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, মুন্সীগঞ্জ, পটুয়াখালীর পাঠানো প্রতিবেদনে এমন তথ্য জানা গেছে।

সামান্য ঝড় হলেই বিদ্যুৎ নেই। বৃষ্টি বাড়লে বিদ্যুৎ নেই। প্রচন্ড গরম পড়লে বিদ্যুৎ নেই। মোট কথা কোন কারণ ছাড়াই বিদ্যুৎ নেই। এই হচ্ছে সারা দেশের বিদ্যুতের সামগ্রিক অবস্থা। বিদ্যুতের আসা যাওয়ার খেলায় অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ। চরম ক্ষতির মধ্যে রয়েছে শিক্ষার্থীরা। ব্যাহত হচ্ছে ক্ষুদ্র ও মাঝারী শিল্পের উৎপাদন। বিশেষ করে পোল্ট্রি, হ্যাচারী শিল্প দুরবস্থায় পড়েছে। গরমের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে লোডশেডিংয়ের তীব্রতা। বিদ্যুৎ এই আসে, এই যায়। পুরো দিনে ১০/১২ ঘণ্টাও বিদ্যুৎ থাকে না। দিনে বা রাতে যে কোন সময়েই হোক, বিদ্যুতের অনুপস্থিতি আধুনিক জীবনে হাজার সংকট ও সমস্যার সৃষ্টি করে। রাষ্ট্রীয়, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক সকল ক্ষেত্রে প্রতিটি মুহূর্তে বিদ্যুতের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। বিদ্যুৎ ছাড়া কলকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত অচল। শিল্প কারখানাগুলোতে প্রতিনিয়ত লোডশেডিং এর ফলে উৎপাদন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে পূর্বের তুলনায় আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পেয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের পড়ালেখার নিরন্তর ব্যাঘাত ঘটছে। বিদ্যুৎ না থাকলে সুষ্ঠু পানি সরবরাহ বাধাগ্রস্ত এবং কৃষি আজ হুমকির মুখে পতিত হয়েছে। লো-ভোল্টেজের কারণে ফ্রিজ, ফ্যান, এসি ইত্যাদি অচল হয়ে যাচ্ছে। কল/মটর, কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, হাসপাতালের চিকিৎসার ব্যাঘাত ঘটছে এমনকি বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে সরকারি ও বেসরকারি কার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ব্যাহত হচ্ছে ব্যাংকিং সেবাও।

অথচ বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ৪ কোটি ২১ লাখের বেশি বিদ্যুৎসংযোগ রয়েছে, যার আওতায় জনগণের শতভাগ বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছে। এক যুগ আগে বিদ্যুৎ গ্রাহকসংখ্যা ছিল ১ কোটি ৮ লাখ। এই মধ্যবর্তী সময়ে ২ কোটি ১৩ লাখ বিদ্যুৎসংযোগ বেড়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ২৭টি থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪৮টিতে। দেশের যেসব স্হানে গ্রিডের বিদ্যুৎ সরাসরি পৌঁছানো যায়নি সেখানে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে সংযোগ এবং সোলার মিনিগ্রিডের মাধ্যমে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
এদিকে চলতি মৌসুমে বিদ্যুতের যে চাহিদা তার থেকে উৎপাদনও বেশি হচ্ছে বলে জানাচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ। তারপরেও কেন লোডশেডিং? বিতরণ সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, সরবরাহ ঘাটতির কারণে বেশ কিছু এলাকায় লোডশেডিং দিতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ হাজার ৫৬৬ মেগাওয়াট। মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন ৫৬০ কিলোওয়াট। বিদ্যুৎ সুবিধা পাওয়া জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১০০ ভাগ। প্রি-পেইড মিটার স্থাপন করা হয়েছে ৪৭ লাখ ৩২ হাজার ৪৯টি। সোলার হোম সিস্টেম ৬০ লাখ। মোট সিস্টেম লস ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ।

বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য মতে, সাড়ে ২৫ হাজারেরও বেশি মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে বাংলাদেশের। তবে গড়ে উৎপাদন হয় সাড়ে ১২ হাজার মেগাওয়াট। গত শুক্রবার দিনের সর্বোচ্চ চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে উৎপাদন ১০ হাজার ২৬৩ মেগাওয়াট এবং সন্ধ্যায় ছিল সর্বোচ্চ ১৩ হাজার ২৪৩ মেগাওয়াট। জানা গেছে, চলতি মৌসুমে বিদ্যুতের চাহিদা ১৫ হাজার মেগাওয়াট। সে হিসাবেও চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতা রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জ্বালানি সংকটের কারণে এই সক্ষমতা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে সবধরনের জ্বালানির দাম বাড়তি। গ্যাস না পেয়ে চালানো হচ্ছে চড়া দামের তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র। এতে করে শহরের অংশে পুরোপুরি বিদ্যুৎ পেলেও গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিং দিতে হচ্ছে।

সূত্র অনুযায়ী, দেশে মোট ছয়টি বিদ্যুৎ কোম্পানি বিদ্যুৎ সরবরাহ করে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে-বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি), ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ওজোপাডিকো), নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (নেসকো), পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি), ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) এবং ঢাকা ইলেক্ট্রিসিটি পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো)। এর মধ্যে সবচেয়ে গ্রাহক সংখ্যা বেশি আরইবি’র। মোট ৪ কোটি ২২ লাখ গ্রাহকের মধ্যে ৩ কোটি ৩০ লাখ গ্রাহকই পল্লী বিদ্যুতের। দিনে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় তার অর্ধেকের বেশি ব্যবহার করেন এই গ্রাহকেরা।

তথ্যমতে, সবচেয়ে বড় বিতরণ সংস্থা আরইবির গ্রাহকরাই বেশি লোডশেডিং পাচ্ছেন। সংস্থাটির বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রতিবেদন অনুযায়ী, যেসব এলাকায় স্থানীয়ভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হচ্ছে, এমন এলাকাগুলোতে লোডশেডিং বেশি হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে-নেত্রকোনা, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর ও টাঙ্গাইল। এছাড়াও লোডশেডিং হচ্ছে-রাজশাহী, রংপুর ও সিলেটের প্রায় সব এলাকায়। এসব এলাকায় স্থানীয়ভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন কম। আবার জাতীয় গ্রিড থেকেও প্রয়োজনীয় সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। তবে চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগে তুলনামূলক লোডশেডিং কম হচ্ছে।

বিতরণ সংস্থা আরইবি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রতিদিন যে পরিমাণ বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় তার মধ্য থেকে ৫০০ থেকে ৮৫০ মেগাওয়াট পর্যন্ত ঘাটতি থাকছে। যে কারণে দিনে তিন থেকে পাঁচ ঘণ্টা লোডশেডিং দিতে হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে আরইবির চেয়ারম্যান মো. সেলিম উদ্দিন গণমাধ্যমকে জানান, মূলত যেসব স্থানে বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হচ্ছে, সেসব জায়গায় কিছু সময় লোডশেডিং দিতে হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি বিষয়টি সহনীয় পর্যায়ে রাখতে।

এদিকে, ঢাকাতে দু’টি কোম্পানি বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। ডিপিডিসি ও ডেসকো। এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানান, ডিপিডিসির দিনে সর্বোচ্চ চাহিদা ১ হাজার ৬৭২ মেগাওয়াট, আর ডেসকোর ৯৫২ মেগাওয়াট। এই চাহিদার পুরোটাই সরবরাহ করা যাচ্ছে। তাই ঢাকাতে লোডশিংয়ের খবর পাওয়া যায়নি।
এ প্রসঙ্গে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ইতোমধ্যে সবধরনের জ্বালানির দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো তেল, গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। আর মূল সমস্যা ওখানেই। সরকার চাচ্ছে গ্রাহকরা যাতে কোনো ধরনের ভোগান্তিতে না পড়ে। সে অনুযায়ীই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
সুমিত সরকার ৫ জুলাই, ২০২২, ৫:৫২ পিএম says : 0
আমাদের বাঘা থানায় এখানে তো 24 ঘন্টার মধ্যে খুব বেশি হলে 6 ঘন্টা বিদ্যুৎ থাকছে। তাহলে এটা সহনীয় মাত্রা কিভাবে হতে পারে !?
Total Reply(0)
Yousman Ali ৩ জুলাই, ২০২২, ৯:৪২ এএম says : 0
জোর আবেদন বিদ্যুৎনা টানার জন্য অনেকের অনেক কষ্ট হয় যা বলে বুঝানোর মতো নই
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন