মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপ সম্পাদকীয়

নদীতে পানির আকাল

উপ-সম্পাদকীয়

মুনশী আবদুল মাননান | প্রকাশের সময় : ২৭ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এবার দেশের বিভিন্ন এলাকায় বন্যা হয়েছে। কোনো কোনো এলাকায় একাধিক দফায় হয়েছে। বন্যার অনিবার্য বান্ধব ছিল নদীভাঙন। বন্যা ও নদীভাঙনে অসংখ্য বাড়ি-ঘর, স্থাপনা ধ্বংস হয়েছে। রাস্তাঘাট, বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফসলাদি বিনষ্ট হয়েছে। বন্যা ও নদীভাঙনের কবলে পড়ে লাখ লাখ মানুষ দুঃখ-দুর্ভোগ, বিপদ-বিপন্নতার শিকার হয়েছে। বহু মানুষ ঘরবাড়ি, জমিজিরাত হারিয়ে পথের ভিখারিতে পরিণত হয়েছে।
এটি এ বছরেরই নয়, প্রায় প্রতি বছরেরই সাধারণ চিত্র। বন্যা-নদীভাঙন এবং তার নানাবিধ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এদেশের মানুষের জীবনচিত্রেরই অপরিহার্য অংশ। এর অংশত এবং কিছুটা ব্যতিক্রমও দেখা গেছে। যখন বিভিন্ন এলাকায় বন্যা হয়েছে, তখন কোনো কোনো এলাকায় অনাবৃষ্টি ও খরার প্রকোপ লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বৈপরীত্যের কারণ, জলবায়ুর পরিবর্তন। জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত প্রতিক্রিয়া বিশ্বের অন্য অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে বেশি। একই দেশে একই সময়ে বৃষ্টি ও অনাবৃষ্টি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবজাত ফল। এও লক্ষ্য করা গেছে, যেখানে বৃষ্টি হয়েছে সেখানে খুব বেশি হয়েছে। যেখানে হয়নি সেখানে একেবারেই হয়নি। অতীতে এরকমটি কখনো দেখা যায়নি। বরাবরই এ দেশে বন্যার প্রধান কারণ দুটি। প্রথমত, টানা প্রবল বর্ষণ এবং দ্বিতীয়ত, সীমান্তের ওপারে থেকে নেমে আসা ঢল। এবারের বন্যার জন্য ওপার থেকে আসা ঢলই বিশেষভাবে দায়ী। বাংলাদেশসংলগ্ন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসামসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যসমূহ এবং বিহারে প্রবল বর্ষণ হয়েছে। বন্যাও হয়েছে। ওপারের ওই বিপুল পানিরাশি সেখানকার নদীনালা-জনপদ ছাপিয়ে হুড়, হুড় করে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে। এতে যেখানে বন্যা হওয়ার কথা সেখানে তো হয়েছেই, যেখানে হওয়ার কথা নয়, তেমন এলাকাতেও হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত অভিন্ন নদীর সংখ্যা ৫৪টি। এসব নদীর পানির শেষ গন্তব্য বাংলাদেশের ওপর দিয়ে সাগরে। সাগরমুখী এসব নদীর পানি শুধু জনপদে বন্যার তা-বই সৃষ্টি করে না, ভাঙনের বিপর্যয়ও সৃষ্টি করে। প্রতি বছরের মতো এবারও দেখা গেছে, ওপারের পানির চাপ মোকাবিলা করতে না পেরে ভারত বিভিন্ন নদীতে দেয়া বাঁধ একযোগে খুলে দিয়েছে। বিনা নোটিশে এভাবে পানি ছেড়ে দেয়ায় বাংলাদেশে বন্যা ও নদী-ভাঙনের প্রচ-তা ও ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে। এরকম অনাহুত-অনাকাক্সিক্ষত বান-ভাঙনের ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাংলাদেশের রেহাই পাওয়ার কোনো উপায় আছে বলে মনে হয় না। ভারতের ‘পানি রাজনীতি’ যতদিন সক্রিয় ও বহাল আছে ততদিন বাংলাদেশকে এই ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করতেই হবে।
বন্যা নেই। নদী ভাঙনের প্রচ-তাও কিছুটা কমেছে। বলে রাখা দরকার, বন্যা যখন হয় তখন নদীগুলো একেবার ভাঙনপ্রবণ হয়ে ওঠে। ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত পানি যখন নদীগুলোতে প্রবাহিত হয় তখন সেই পানি দু’কূল ছাপিয়ে ঘরবাড়ি, স্থাপনা, রাস্তাঘাট, শস্যক্ষেত্র ভাসিয়ে দেয়। নদীসব হয়ে ওঠে ভাঙনমুখী এবং সর্বগ্রাসী। আবার নদীর পানি যখন সরে যায় তখন পানিতে এ ধরনের টান সৃষ্টি হয়। তখনও নদীভাঙন দেখা দেয়। এখনো সেটা দেখা যাচ্ছে। কদিন আগে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে, রাজশাহীতে পদ্মার ভাঙনে ঘরবাড়ি, ফসলের ক্ষেত বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এই এলাকার পদ্মাতীরের মানুষেরা আশঙ্কা, আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। বান-ভাঙনের এই জের হয়তো আরো কিছুদিন থাকবে। তারপর দেখা দেবে অন্য এক দৃশ্যপট। ইতোমধ্যেই তার আলামত দৃশ্যগোচর হয়ে উঠেছে। খবর বেরিয়েছে, দ্রুতই নদীগুলো পানিশূন্য হয়ে পড়ছে। কয়েকটি নৌপথ এখনই এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে, শুকনো মওসুমে সেগুলো নাব্য রাখা যাবে কিনা সন্দেহ। পদ্মা, তিস্তা ও যমুনার মতো বড় নদীগুলোর কোনো কোনো অংশে পানি সরে যাওয়ায় চর জেগে উঠেছে। অন্যান্য নদীর অবস্থা আরো শোচনীয়। নদীর পানিনির্ভর সেচব্যবস্থা এখনই ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত সময়ে এ অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা সহজেই আন্দাজ-অনুমান করা যায়।
এও প্রতি বছরের সাধারণ বাস্তবতা যে, শুকনো মওসুমে নদনদী, খালবিল প্রায় পানিশূন্য হয়ে পড়ে। সেচ প্রকল্পগুলো অকার্যকর হয়ে যায়। ফসলের আবাদ মারাত্মক অনিশ্চয়তায় পতিত হয়। অতীতে আমরা দেখছি, পদ্মার পানির ওপর নির্ভরশীল গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প, তিস্তার পানির ওপর নির্ভরশীল তিস্তা সেচ প্রকল্পসহ অন্যান্য সেচ প্রকল্প তাদের কামান্ড এরিয়ার সামান্য অংশেই কেবল সেচসুবিধা দিতে পারে। বেশিরভাগ জমি সেচসুবিধার বাইরে থেকে যায়। জমির মালিকরা তাদের মতো করে আবাদ করতে পারলে করে, না পারলে জমি পতিত থাকে। এভাবে সেচ প্রকল্পাধীন এলাকায় চাষাবাদ প্রতি বছরই মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয় এবং উৎপাদন সম্ভবনা কাজে লাগানো সম্ভব হয় না। নদীতীরবর্তী এলাকায় নদীর পানি সেচের জন্য ব্যবহার করার কোনো সুযোগ থাকে না, নদী পানিশূন্য হয়ে পড়ায়। এর বাইরে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভর করে সে সেচব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তাও অনেক ক্ষেত্রে ব্যাহত হয়। মাত্রাতিরিক্তি পানি তোলার কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আর আগের অবস্থানে নেই, বহু নিচে নেমে গেছে। অনেক সময় পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যায় না। যা পাওয়া যায় তাও আর্সেনিক বা অন্যান্য ক্ষতিকর উপাদানমিশ্রিত, ফসলের জন্য যা অত্যন্ত ক্ষতিকর। বলা যায়, শুকনো মওসুমে ফসলের আবাদ-উৎপাদন ক্রমেই সংকটাপন্ন ও অসম্ভবপর হয়ে উঠছে। নদী যখন শুকিয়ে যায়, ভূগর্ভস্থ পানিতে যখন টান পড়ে তখন খালবিল, জলাশয়, পুকুর ডোবায়ও কোনো পানি থাকে না। পানির জন্য দেশজুড়েই হাহাকার পড়ে যায়। এতে আবাদ-উৎপাদনই ব্যাহত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, এমনকি পান ও ব্যবহারযোগ্য পানিরও প্রকট অভাব দেখা দেয়।
পানির দেশে পানির এই আকাল একইসঙ্গে অকল্পনীয় এবং উদ্বেগজনক। কেন এই বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে দেশ ও দেশের মানুষ পতিত হয়েছে, তা কারো অজানা নেই। প্রথমত, নদীনালা, খালবিল, জলাশয়, পুকুর ডোবা ভরাট হয়ে পানি ধারণক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। এ  প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। দ্বিতীয়ত, অভিন্ন ৫৪টি নদীর উজানে ভারত অসংখ্য বাঁধ, প্রতিবন্ধক নির্মাণ করে পানি সরিয়ে নেয়ায় দেশের শত শত নদী শুকনো মওসুমে পানি শূন্যতার শিকারে পরিণত হয়েছে। পানি না দিয়ে বাংলাদেশকে শুকিয়ে মারার ভারতীয় অভিসন্ধির কারণে নদী স্বাভাবিক প্রবাহ হারিয়ে ক্রমাগত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে শতাধিক ছোট নদী মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে। বড় নদীগুলোর অস্তিত্বের সংকটও তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।
গঙ্গা বা পদ্মা বাংলাদেশের পানির অন্যতম বড় উৎস। ভারতে গঙ্গা এবং বাংলাদেশে পদ্মা নামের বিখ্যাত এই নদীটি এক সময় ‘প্রমত্তা’ ‘কীর্তিনাশা’, ‘সর্বনাশা’ নামে অভিহিত হতো। এখন শুকনো মওসুমে পদ্মা কার্যত মরা খালের রূপ পরিগ্রহ করে। এর বুক জুড়ে অগণিত চর জেগে ওঠে। মানুষ কোনো নৌযানে নয়, কোথাও কোথাও দিব্যি পায়ে হেঁটেই পদ্মা পার হয়ে যায়। পদ্মার বুকে চাষাবাদের দৃশ্যও দিনকে দিন স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। পদ্মার বহু শাখা-প্রশাখা রয়েছে। তারা পদ্মার পানির ওপরই নির্ভরশীল। এসব শাখা-প্রশাখা নদীর অবস্থা আরো করুণ, আরো ভয়াবহ।
পদ্মার মরণ দশার জন্য ভারতই যে দায়ী যে দায়ী তা কারো অজানা নেই। উজানে ফারাক্কায় গঙ্গার ওপর বাঁধ দিয়ে ভারত নির্বিচারে পানি ছিনতাই করে নিয়ে যাচ্ছে। গত চার দশকেরও বেশি সময় ধরে এই পানি ছিনতাই অব্যাহত থাকার ফলে পদ্মার অস্তিত্বই এখন বিপন্ন হয়ে পড়েছে। ভাটির দেশের ক্ষতি হয়, এমন কিছু উজানের দেশের না করার নীতি-বিধানের তোয়াক্কা না করেই ভারত ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করে পানি সরিয়ে নিচ্ছে। গঙ্গার পানিবণ্টন নিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের এ যাবৎ দুটি চুক্তি হলেও বাংলাদেশ চুক্তি অনুযায়ী পানি পায়নি। চলমান  ৩০ সালা চুক্তি বাংলাদেশের ন্যায্য পানিপ্রাপ্তির কোনো নিশ্চয়তা দেয়নি। আগের চুক্তিতে যতটুকু নিশ্চয়তা ছিল, এ চুক্তিতে তাও নেই। ফলে পানিবঞ্চনা আরো বেড়েছে। গত বছর শুকনো মওসুমে বাংলাদেশ স্মরণকালের সর্বনি¤œ পানি পেয়েছে। আসন্ন শুকনো মওসুমে পানি প্রাপ্তির পরিস্থিতি কি কি দাঁড়াবে, বলা না গেলেও আন্দাজ  করা যায়। মওসুম শুরু আগেই পদ্মার যে হাল তাতে বুঝাই যায়, চুক্তি মোতাবেক পানি পাওয়ার আশা দূরাশা মাত্র। গত বছর পানি না পাওয়ার বিষয়টি ভারতকে জানানোর পর ভারতের জবাব ছিল : উজানে পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় তার পক্ষে এর বেশি পানি দেয়া সম্ভব নয়। যে পরিমাণ পানি ফারাক্কা পয়েন্টে জমা হচ্ছে তাই ভাগাভাগি করে নিচ্ছে দু’দেশ। ভারতের এহেন জবাবে সন্তুষ্ট হওয়ার কোনো হেতু নেই। শুকনো মওসুমে গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকায় সঙ্গত ও স্বাভাবিক কারণে পানিপ্রবাহ কিছুটা কমে যায়। কিন্তু এতটা কখনোই কমেনা যাতে চুক্তি অনুযায়ী পানি বন্টন ব্যাহত হতে পারে। ফারাক্কা পয়েন্ট পানি কমে যাওয়ার কারণ পানিপ্রবাহ কমে যাওয়া মোটেই নয়। আসল কারণ, ফারাক্কার উজানে গঙ্গায় আরো প্রায় একশ’ বাঁধ নির্মাণ করে যথেচ্ছ পানি প্রত্যাহার। এ কথাটি ভারত বলতে চায় না। ফারাক্কা পয়েন্ট পানি আসার আগেই যদি পানি সরিয়ে নেয়া হয় তাহলে সেখানে পানি আসবে কোথা থেকে? প্রকাশিত এক খবরে জানা গেছে, গঙ্গার উজানে বিভিন্ন স্থানে সাতটি নদীসাদৃশ খাল খনন করেছে ভারত। এসব খালের শাখা-প্রশাখা মিলিয়ে দৈর্ঘ দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার কিলোমিটার। ওই সাত খাল ও তাদের শাখা-প্রশাখায় পানি যাচ্ছে গঙ্গা থেকে। এই পানি দিয়ে লাখ লাখ হেক্টর জমিতে সেচ দেয়া হচ্ছে। এই বাস্তবতায় গঙ্গার পানি এখনো যৎসামান্য যা পাওয়া যাচ্ছে, আগামীতে তাও পাওয়া যাবে না। এই প্রেক্ষিতে একথা বলা যায়, গঙ্গার পানি থেকে বাংলাদেশকে চিরতরে বঞ্চিত করার সকল ব্যবস্থাই ভারত সম্পন্ন করে ফেলেছে।
ভারত পানিপ্রবাহের সংকটের কথা বলে বাংলাদেশকে পানি থেকে বঞ্চিত করার যে কৌশল অবলম্বন করেছে বাংলাদেশ তার প্রেক্ষিতে পানিপ্রবাহ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। বাংলাদেশের বহুল আলোচিত প্রস্তাবটি হলোÑ নেপালে ত্রিদেশীয় উদ্যোগে রিজার্ভার নির্মাণ করে বর্ষা মওসুমে পানি সংরক্ষণ করে শুকনো মওসুমে সেই পানি ছেড়ে প্রবাহ ঠিক রাখা। ভারত এ প্রস্তাবে রাজি নয়। তার বিকল্প প্রস্তাব হলো, ব্রহ্মপুত্রের পানি খালের মাধ্যমে গঙ্গায় এনে প্রবাহ বৃদ্ধি করা। বাংলাদেশ এতে রাজি হয়নি বা হতে পারে না একারণে, ব্রহ্মপুত্রের পানি গঙ্গায় প্রবাহিত করলে ব্রহ্মপুত্রে পানিপ্রবাহের সংকট দেখা দেবে, যার ভয়াবহ শিকার হবে বাংলাদেশ। গঙ্গার মতো ব্রহ্মপুত্র অববাহিকাও পানি শূন্যতার কবলে পতিত হবে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে, বাংলাদেশের পানির সবচেয়ে বড় উৎস ব্রহ্মপুত্র। বর্ষা কিংবা শুকনো মওসুমে বেশি পানি আসে ব্রহ্মপুত্র থেকে। বাংলাদেশের পক্ষে কখনো এ প্রস্তাবে রাজি হওয়া তাই সম্ভব নয়। অবশ্য বাংলাদেশের রাজি হওয়া-না হওয়ার তোয়াক্কা ভারত করে না। করে না বলেই তার একতরফা স্বার্থ হাসিলের জন্য ভারত বিতর্কিত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নে জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এই প্রকল্পের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য, ব্রক্ষ্মপুত্রের পানি গঙ্গায় টেনে এনে গঙ্গানির্ভর সেচ প্রকল্পগুলোতে পানির জোগান নিশ্চিত করা। বাংলাদেশ আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও তাতে পাত্তা দিচ্ছে না ভারত।
তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা থেকেও বাংলাদেশ বঞ্চিত। গত কয়েক বছর ধরে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির পাঁয়তারা চলছে। চুক্তির কোনো খবর নেই। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় চুক্তি হবে, এমন আশ্বাস পাওয়া গেলেও হয়নি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের সময়ও চুক্তি হতে পারে বলে বলা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সফরের প্রাক্কালে জানা যায়, চুক্তি হচ্ছে না। পশ্চিমবঙ্গের বিরোধিতাই চুক্তি না হওয়ার কারণ বলে ভারতের পক্ষ থেকে জানানো হলেও বিষয়টি সম্পূর্ণ ভারতের নিজস্ব ব্যাপার। কে রাজি, কে রাজি নয়, এটা বাংলাদেশের দেখার কথা নয়। আসলে এই অজুহাত তুলে তিস্তা চুক্তি আটকে দেয়া হয়েছে। চুক্তির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। এদিকে পানির অভাবে তিস্তা সেচ প্রকল্প প্রায় অচলাবস্থায় এসে পৌঁছেছে। শুকনো মওসুম এখনো আসেনি। এরই মধ্যে তিস্তার বহু এলাকা পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। পানি প্রবাহ গত বছরের চেয়ে অনেক কম। তিস্তার বুকে জেগে উঠেছে অসংখ্য চর। তিস্তার পাশাপাশি ব্রহ্মপুত্রেও পানি নেই। সেখানেও অগণিত চর জেগে উঠেছে। তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্রের মিলিত ¯্রােতে গড়ে ওঠা যমুনার অবস্থা কতটা শোচনীয় হয়ে উঠতে পারে, তার বিস্তারিত বিবরণ-বর্ণনা অবান্তর। খবরে প্রকাশিত হয়েছে, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনায় পানির অভাবে এবং চর পড়ার কারণে নৌচলাচলে এখনই মারাত্মক বিঘœ সৃষ্টি হচ্ছে, আগামীতে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, সহজেই অনুমেয়।
নদীর প্রবাহ স্বল্পতা ও মরণ দশার সুরাহা কিভাবে হবে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। বলার অপেক্ষা রাখে না, গঙ্গা-তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানি প্রত্যাহার থেকে ভারত বিরত থাকলে এ অবস্থা কখনোই দেখা দিতো না। ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নেই, উজানে গজলডোবা বাঁধ ছাড়াও ভারত তিস্তার ওপর আরও বাঁধ তুলেছে। কোনো বাঁধ সেচের জন্য, কোনো বাঁধ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য। ফলে তিস্তার স্বাভাবিক প্রবাহ বাংলাদেশ পর্যন্ত এসে পৌঁছাতে পারছে না। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বক্তব্য ঃ শুকনো মওসুমে তিস্তার পানি প্রবাহ এত কমে আসে, যে, তা দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের প্রয়োজনই মেটে না, বাংলাদেশকে আমরা পানি দেবো কিভাবে? ভারত স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাংলাদেশকে ন্যায়সঙ্গতভাবে পানির হিস্যা দেবে, একথা আর এদেশের মানুষ বিশ্বাস করে না। এমন বাস্তবতায় বাংলাদেশকে পানির ন্যায্য হিস্যা প্রাপ্তির সর্বোচ্চ ও সর্বমুখী প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি নদীগুলো নাব্য রাখা এবং পানির যে আকাল চলছে তা দূর করার বিকল্প উপায় বা পন্থাও গ্রহণ করতে হবে। ‘নদী বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে,’ এটা নিরেট সত্য। বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্যাপক ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদীর নাব্য ফিরিয়ে আনা এবং সব নদীকে পানি সংরক্ষণাগারে পরিণত করা অত্যাবশ্যক। একই সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণ করা দরকার। গঙ্গ ব্যারাজ নির্মাণের কথা এদেশের মানুষ দশকের পর দশক ধরে শুনে আসছে। ব্যারাজটি এখনও নির্মাণ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। বর্তমান সরকারের তরফে গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণের কথা বার বার বলা হলেও এখন শোনা যাচ্ছে, ভারতের বিরোধিতার কারণে সরকার দ্বিধায় পড়ে গেছে। সরকার ভারতের সহযোগিতা নিয়ে গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণ চায় বলে জানানো হয়েছে। তাতেও কোনো ফলোদয় হয়নি। ভারতের একতরফা পানি ছিনতাইয়ের প্রতিক্রিয়া মোকাবেলায় যে প্রকল্প, তার বাস্তবায়নে ভারত কিভাবে সহযোগিতা করতে পারে, সাধারণ মানুষের বিচারবুদ্ধিতে তা আসে না। অথচ সরকার ভারতের সহযোগিতার আশায় বসে আছে। এভাবে সময়ক্ষেপণের কোনো মানে হয় না। এ ব্যাপারে সরকারকে অবশ্যই ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং তা এখনই।
জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় পানি নিয়ে, তিস্তা চুক্তি নিয়ে, গঙ্গা ব্যারাজ নিয়ে আলোচনা হবে। এ সময় দেড়ডজনের বেশি চুক্তি হতে পারে দু’দেশের মধ্যে। এসব চুক্তির মধ্যে পানি সংক্রান্ত কোনো চুক্তি হবে কিনা, এখনো জানা যায়নি। পানির সঙ্গে যেহেতু বাংলাদেশের অস্তিÍত্ব-অনস্তিত্বের প্রশ্ন জড়িত, সুতরাং পানির বিষয়টি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দাবি করে। সরকারকেও সেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। সরকার উন্নয়নের জন্য অনেক মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ঘোষণায়ও আছে অনেক মেগাপ্রকল্প। কিন্তু এসব মেগাপ্রকল্প কোনোই কাজে আসবে না যদি না আমরা পানি সমস্যার নিশ্চিত ও স্থায়ী সমাধান করতে পারি। পানির সংস্থান বা পানি নিরাপত্তা সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। এ নিয়ে সময় ক্ষেপণেরও কোনো সুযোগ নেই।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন