পূর্ণিমার জোয়ারের প্রভাবে পায়রা, বিষখালী বলেশ্বরসহ শাখা নদীগুলোতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নদী তীরবর্তী অর্ধশতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিতে তলিয়ে গেছে আউশ ধান ও আমনের বীজতলা। ভেসে গেছে অর্ধ সহস্রাধিক পুকুর ও ঘেরের মাছ। এতে প্রায় ১০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে ক্ষতিগ্রস্তরা দাবি করছেন। দুর্ভোগে পরেছে জেলার কয়েক লক্ষ মানুষ।
জানা যায়, পূর্ণিমার জোয়ারের প্রভাবে পায়রা, বিষখালী ও বলেশ্বর নদীতে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৪৩ সেণ্টিমিটার বেশি পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় তালতলী উপজেলার নিশানবাড়িয়া ইউনিয়নের তেতুলবাড়িয়া গ্রামের বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে তেতুলবাড়িয়া, গোরাপাড়া, খারাকান্দা, ছোনবুনিয়া, ফুলুপাড় ও নলবুনিয়া সাইক্লোন সেল্টারসহ ৮ গ্রাম ৪দিন ধরে প্রতিদিন দু’বার করে জোয়ারের পানিতে ভাসছে।
এছাড়া উপকূলীয় আমতলী ও তালতলীর নদী তীরবর্তী অর্ধশতাধিক গ্রামও ৪ দিন ধরে প্লাবিত হচ্ছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বাইরের বসবাসরত মানুষের ঘরবাড়ি তলিয়ে গেছে। এতে সীমাহীন দুর্ভোগে পরেছে আমতলী ও তালতলী উপজেলার প্রায় লক্ষাধিক মানুষ। জোয়ারে পানিতে একাকার হয়ে আমতলী ও তালতলীর মানুষের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পরেছে। পানিতে নদী তীরবর্তী মাঠ-ঘাট তলিয়ে গেছে। তলিয়ে গেছে আউশের ধান ক্ষেত ও আমনের বীজতলা। দ্রুত পানি না কমলে আউশ ধান ও আমনের বীজতলা পচে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন কৃষকরা।
জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে আমতলীর উপজেলার ঘোপখালী, বালিয়াতলী, পশুরবুনিয়া, আড়পাঙ্গাশিয়া, পশ্চিম আমতলী, ফেরিঘাট, পুরাতন লঞ্চঘাট, আমুয়ারচর, পানি উন্নয়ন বোর্ড এলাকা, আঙ্গুলকাটা, গুলিশাখালী ও হরিদ্রবাড়িয়া তালতলী উপজেলার নিশানবাড়িয়া, ফকিরহাট, সোনাকাটা, নিদ্রাসকিনা, তেতুঁলবাড়িয়া, আশারচর, নলবুনিয়া, তালুকদারপাড়া, চরপাড়া, গাবতলী, মৌপাড়া, ছোটবগী, জয়ালভাঙ্গা, পচাঁকোড়ালিয়াসহ আরো অনেক নিম্নাঞ্চল পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া ঝুঁকিতে রয়েছে বালিয়াতলী, পশুরবুনিয়া, আড়পাঙ্গাশিয়া, পশ্চিম ঘটখালী, গুলিশাখালী ও হরিদ্রবাড়িয়া এলাকার পায়রা সংলগ্ন বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ।
গত ৪দিন ধরে পায়রা নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় আমতলীর ফেরির গ্যাংওয়ে তলিয়ে যাওয়ায় যাত্রীদের সীমাহীন দুর্ভোগ পোহতে হচ্ছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ না থাকায় গাজীপুর বন্দর জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে বলে জানান, স্থানীয় ইউপি সদস্য আব্দুল বাতেন দেয়ান।
আমতলী উপজেলার পানি মাপক মো. আবুল কালাম আজাদ জানান, গত শুক্রবার পয়রা নদীর বিপদ সীমার ৪৩ সেণ্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে। বরগুনায় বেড়িবাঁধ ভেঙে জোয়ারের পানিতে সদর, তালতলী, পাথরঘাটাসহ ছয়টি উপজেলার অন্তত ১৮টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন কয়েক হাজার মানুষ।
সদরের নলটোনা, ঢলুয়া, এম বালিয়াতলী ও বদরখালী ইউনিয়নের কয়েকটি পয়েণ্টে বিষখালী ও পায়রা নদীর জোয়ারের তোড়ে বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে বেশ কিছু গ্রাম। অন্যদিকে পূর্ণিমার প্রভাবে পাথরঘাটা উপজেলার বিষখালী ও বলেশ্বর নদীর জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে উপজেলার ২০টি গ্রাম। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। বসত ও রান্নাঘরে পানি প্রবেশ করায় বন্ধ রয়েছে রান্নাবান্না। পাথরঘাটা উপজেলার টেংরা, হাঁড়িটানা, কোরালিয়া, গহরপুর, নিজলাঠিমারা, রুহিতা, হাজির খাল, বাদুড়তলা, চরলাঠিমারা এলাকাসহ শতাধিক পুকুর ও অন্তত ১৫টি ঘেরের মাছ ভেসে গেছে। কোড়ালিয়া এলাকায় বেড়িবাঁধ না থাকায় লোকালয়ে জোয়ারের পানি ঢুকছে। অনেক বাড়িঘরে দুই থেকে তিন ফুট পানি প্রবেশ করেছে। এতে বসতঘরের মালামাল ভেসে গেছে। তালতলীর তেঁতুলবাড়িয়া গ্রামের হযরত আলী হাওলাদার বলেন, ‘বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ায় আমার বাড়িঘর সব তলিয়ে গেছে। এখন বাঁধের ওপর আশ্রয় নিয়েছি। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এই পায়রা নদীর পাড়েই থাকি সেই জন্মের শুরু থেকে। বারবার বলার পরও টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ।’ একই এলাকার রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বাঁধ ভেঙে আমার মাছের ঘের তলিয়ে গেছে। এতে কয়েক লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। প্রতি বছরই বাঁধ ভেঙে এমন ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে আমাকে।’ পাথরঘাটার রুহিতা গ্রামের সালেহা বেগম বলেন, ‘জোয়ারের পানি উঠেছে। এখন ছোট মেয়েকে নিয়ে খাটে বসে আছি। রান্নাঘর ও চুলা পানিতে ডুবে গেছে। তাই দু’দিন ধরে রান্না হয়নি।’
তেতুলবাড়িয়া গ্রামের গৃহিনী চম্পা, শিরিন বেগম বলেন, এই চার দিন ধইর্যা পানি উইঠ্যা চুলা ডুইব্যা যাওয়ায় দুপুরে পোলা মাইয়া লইয়া খাইতে পরি নাই।
পাথরঘাটার বাদুরতলা গ্রামের মো. ইউসুফ আলী বলেন, ‘উঠান কোমর-সমান পানি। রান্নাঘরে হাঁটু পর্যন্ত পানি, চুলা পানির নিচে। ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে কোনোমতে দোকান থেকে খাবার কিনে খেয়ে আছি।’
বেতাগী উপজেলা বেড়িবাঁধ ভাঙা থাকায় প্লাবিত হয়েছে উত্তর বেতাগী, ঝিলবুনিয়া, ছোপখালী, ঝোপখালী, ভোলানাথপুর, জগাইখালী, কালিকাবাড়ি, গাবতলী, আলিয়াবাদ, জোয়ার করুনা, গোমর্দন। এ ছাড়া ঝুঁকিতে রয়েছে বেতাগী শহর রক্ষাবাঁধ। জোয়ার ও বৃষ্টির পানিতে প্লাবিত হয়েছে বামনা উপজেলার লক্ষ্মীপুড়া, চেচাং, ডুসখালী, আমতলী, গোলাঘাটা গ্রাম।
আমতলীতে চাওড়া ইউনিয়নের বেড়িবাঁধ ভেঙে তলিয়েছে বৈঠাকাটা, ঘটখালী, বেতমোর, চন্দ্রা, উত্তর কান্দা ও বালিয়াতলী। সেই সঙ্গে পৌরসভার আমুয়ার চরসহ ঝুঁকিতে রয়েছে আমতলী শহর রক্ষাবাঁধ।
পাউবো সূত্রে জানা গেছে, পূর্ণিমায় সাগরে জোয়ারের পানি বেড়েছে। এতে পায়রা, বিষখালী ও বলেশ্বর নদের জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে অন্তত তিন ফুট উচ্চতায় প্রবাহিত হয়ে ভাঙনকবলিত এলাকার বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে।
বরগুনা কার্যালয়ের পানি পরিমাপক মাহতাব উদ্দিন বলেন, শুক্রবার রাতে বিষখালীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে তিন ফুট উচ্চতায় প্রবাহিত হয়েছে। গত বুধ ও বৃহস্পতিবার একই উচ্চতায় পানি প্রবাহিত হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নূরুল ইসলাম বলেন, আমরা ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ সংস্কারে প্রকল্প হাতে নিয়েছি। সম্প্রতি জোয়ারের পানির তোড়ে যেসব এলাকার বাঁধ ভেঙেছে, ওইসব এলাকা পরিদর্শন করে জরুরি মেরামতের কাজ হাতে নেয়া হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন