রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

সঙ্কুচিত আইনি সহায়তা লাভের অধিকার

দেশেই অরক্ষিত প্রবাসীরা ২ পাসপোর্ট-এনআইডি জটিলতা

সাঈদ আহমেদ | প্রকাশের সময় : ১৭ জুলাই, ২০২২, ১১:৫৯ পিএম

জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) না থাকায় ই-পাসপোর্ট প্রাপ্তি, পাসপোর্টের ভুল সংশোধন, এনআইডি সংশোধন করতে গিয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন প্রবাসীরা। দীর্ঘদিন দেশে অনুপস্থিতির কারণে অধিকাংশ প্রবাসী এনআইডি করতে পারেন না। মাঝে দেশে এসে কেউ এনআইডি করে নিলেও তাতে থেকে যাচ্ছে তথ্যগত ভুলভ্রান্তি। পরবর্তীতে এসব সংশোধন করতে গিয়ে শিকার হতে হচ্ছে হয়রানির। এছাড়া হাইকোর্টের সাম্প্রতিক একটি আদেশ প্রবাসীদের আইনগত সহায়তা লাভের অধিকার সঙ্কুচিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

পাসপোর্টে দুর্নীতি-হয়রানি : গত ৫ বছরে পাসপোর্টের চাহিদা বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। এখন প্রতিদিন গড়ে ৩৫ হাজারের বেশি পাসপোর্ট ইস্যু হচ্ছে। সাধারণত : জরুরি আবেদনের পাসপোর্ট ২ থেকে ৭ দিনের মধ্যে সরবরাহ করা হচ্ছেÑ মর্মে দাবি করছে পাসপোর্ট অধিদফতর। সাধারণ আবেদনের পাসপোর্ট ১৫ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তির কথা বলা হয়। বাস্তবতা ঠিক তার উল্টো। আবেদন জমা দিয়ে মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হয়। এখন মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি)র পরিবর্তে ইস্যু করা হচ্ছে ই-পাসপোর্ট। ই-পাসপোর্ট আবেদনকারীদের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু অনেক প্রবাসীরই এনআইডি নেই। দেশে ফিরে এনআইডি পেতে যেন দুর্ভোগের অন্ত নেই। পাসপোর্ট অফিসের দুর্নীতি অনেকটা কিংবদন্তিতুল্য। দুর্নীতির সঙ্গে আপস করেই পাসপোর্ট হাতে পাচ্ছেন প্রবাসীরা। প্রতিটি পাসপোর্টেই সরকার নির্ধারিত ফি’র অতিরিক্ত অথ খরচ করতে হচ্ছে। সেইসঙ্গে রয়েছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, সার্ভার ও কারিগরি ত্রুটির অজুহাত, ভুলে ভরা এনআইডি’র তথ্য জটিলতা তো রয়েছেই।

অধিকাংশ প্রবাসীর যে অভিযোগ তা হচ্ছে,দুর্নীতি ও হয়রানির শিকার হলে দ্রুত প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থা নেই। পাসপোর্ট ও ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের প্রচারিত ‘হটলাইন’টি অকার্যকর। অনলাইনে পাসপোর্টের আবেদন জমা দেয়ার কয়েক মাস পর উত্তর আসছে, ‘পাসপোর্ট নট ফাউন্ড’। পরে জমা দেয়া পাসপোর্ট হাতে এলেও ইতিপূর্বে জমা দেয়া পাসপোর্ট হাইকমিশনে আসেনিÑ বলে অনলাইনে উত্তর আসে। পাসপোর্ট প্রাপ্তির ২ সপ্তাহের সময় নির্ধারণ করে দেয়া হলেও সেটি দুই-তিন মাস পর্যন্ত গড়ায়। ডেলিভারি সিøপে ভুল থাকার দায়ও অনেক সময় পাসপোর্ট প্রার্থীর ওপর চাপানো হয়।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) নেতা মোজাম্মেল হক বলেন, পাসপোর্ট ইস্যু নির্ধারিত ফি হচ্ছে ৫ হাজার টাকা। বাস্তবে খরচ যাচ্ছে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা।
তবে পাসপোর্ট প্রাপ্তিতে হয়রানি লাঘবের দোহাই দিয়ে ২০১৯ সালে হাইটেক ই-পাসপোর্ট প্রবর্তন করে সরকার। কিন্তু তাতে এখন অবধি কোনো সুফল আসেনি। বরং সৃষ্টি করেছে নিত্যনতুন জটিলতা। কারণ, ই-পাসপোর্ট ইস্যু হচ্ছে এনআইডির তথ্যের ভিত্তিতে। পুরোনো এমআরপি ও এনআইডির তথ্যে যদি কোনো অমিল থাকে, তাহলে ই-পাসপোর্টের আবেদন বাতিল হয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি পাসপোর্ট অফিসের একটি নোটিশে স্বীকারও করা হয়েছে। পাসপোর্ট অধিদফতরের ঢাকা বিভাগীয় অফিসের নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে, পূর্বের পাসপোর্টের সঙ্গে এনআইডি-বিআরসির [জন্ম নিবন্ধন সনদ] অমিল থাকলে ই-পাসপোর্টের আবেদন স্বয়ংক্রিয়ভাবে সিস্টেম সফটওয়ারে আটকে যায়। উক্ত আবেদনগুলো সেন্ট্রাল ক্লিয়ারেন্স মডিউল কর্তৃক নিষ্পত্তি করা হয় বিধায় ই-পাসপোর্ট পেতে বিলম্ব হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে পাসপোর্ট প্রিন্ট হয়ে না আসা পর্যন্ত আবেদনকারীকে ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করার অনুরোধ জানানো হয় নোটিশে। যদিও এই ‘অপেক্ষা’র ব্যপ্তি সম্পর্কে কিছু বলা নেই। এমআরপি পাসপোর্ট এবং এনআইডিতে তথ্যগত অমিলের কারণে পাসপোর্ট অধিদফতরে বিপুলসংখ্যক ই-পাসপোর্ট আটকে আছে। এতে নিদারুণ সমস্যায় আছেন অনেক অভিবাসী শ্রমিক।

পাসপোর্টের একজন পরিচালক নাম প্রকাশ না করে বলেন, এনআইডিতে থাকা তথ্যের ভুলের দায় আবেদনকারীর নয়। তাছাড়া কখনও কখনও এমআরপি পাসপোর্ট ও এনআইডি পাওয়ার সময়ই আবেদনকারীর ঠিকানা পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। অথচ ই-পাসপোর্ট প্রাপ্তির ক্ষেত্রে এই সমস্যার আপাত : কোনো সমাধান নেই।

নরসিংদীর সউদী প্রবাসী মো: আতাউর রহমান ছুটিতে এখন বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। তিনি মেয়াদোত্তীর্ণ এমআরপি পাসপোর্টের বিপরীতে ই-পাসপোর্টের আবেদন জমা দেন। পাসপোর্টে তার নাম ‘মো: আতাউর রহমান’। কিন্তু এনআইডিতে তার নাম উঠেছে শুধু ‘মতিউর’। তার আবেদনটি নাকচ করে পাসপোর্ট অধিদফতর। এফিডেভিটের মাধ্যমে পরে এনআইডি সংশোধন করতে হয়েছে। তাতেও পোহাতে হয়েছে অনেক ঝক্কি। ওই এনআইডি’র ভিত্তিতে মো: আতাউর রহমান ই-পাসপোর্টের নতুন আবেদন দেন।

শুধু কি এনআইডি’র ত্রুটির কারণে এই দুর্ভোগ? পাসপোর্টে দুর্ভোগ পোহাতে হয় ঘাটে ঘাটে। অনেক সময় এনআইডি’র সব তথ্য নির্ভুল থাকলেও মেলেনা পাসপোর্ট। বায়রার সাবেক মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান জানান, পাসপোর্ট পেতে মারাত্মক ঝামেলা পোহাতে হয় প্রবাসী কিংবা বিদেশগমনেচ্ছুদের। তিনি প্রশ্ন রাখেন, অভিবাসনপ্রত্যাশীর যদি এনআইডি থাকে, তাহলে কেন তাকে পাসপোর্ট ইস্যুর আগে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স লাগবে?

লেবার মাইগ্রেশন গ্রুপের মেম্বার রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, পাসপোর্ট আবেদনকারীর বিরুদ্ধে কোনো মামলা রয়েছে কি নাÑ সেটি জানার জন্যই হয়তো পুলিশ ক্লিয়ারিং সার্টিফিকেটের এই বিধান। তিনি বর্তমান অবস্থায় অন্তত: ৩২ লাখ মানুষের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। তাই বলে কি তারা পাসপোর্ট পাবেন না? পাসপোর্ট নাগরিকের অধিকার। মামলা থাকলেই সেই অধিকার খর্ব হয়ে যায় না। মানুষকে যেকোনো মুহূর্তে বিদেশ যাওয়ার প্রয়োজন পড়তে পারে। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রক্ষিণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক মো: শহীদুল আলম বলেন, আমার যদি এনআইডি থাকে, তাহলে পাসপোর্ট পাওয়ার জন্য কেন হয়রান হতে হবে? এটি অর্থহীন।

এনআইডি জটিলতা : প্রবাসীদের আরেক হয়রানির নাম এনআইডি জটিলতা। ইউরোপে বসবাসরত অন্তত: ৬০ হাজার বাংলাদেশি এই জটিলতায় বিপাকে পড়েছেন। তাদের এনআইডি না থাকায় পাসপোর্ট রি-ইস্যু হচ্ছে না। ই-পাসপোর্ট ও মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) রি-ইস্যুর ক্ষেত্রে দেশের ভেতর এক নিয়ম হলেও প্রবাসীদের ক্ষেত্রে চালু করা হয়েছে ভিন্ন নিয়ম। ফলে ইউরোপের ইতালি, স্পেন, ইংল্যান্ড, গ্রিস, সুইডেন, জার্মানিসহ বেশ কয়েকটি দেশে ‘অবৈধ বাংলাদেশী’র প্রবাস জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ভুক্তভোগী প্রবাসীরা বলছেন, যেভাবেই হোক আমরা কাজের জন্য ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এসেছি। এখন নতুন পাসপোর্ট ছাড়া আমাদের খণ্ডকালিন কাজের কোনো অনুমতি মিলছে না। এমনকি ওইসব দেশে থাকতে গেলে বাংলাদেশের পাসপোর্ট লাগবে। তবেই খণ্ডকালিন কাজের অনুমোদন মিলবে। দেশে পাঠাতে পারবেন রেমিট্যান্স।

ইমিগ্রেশন অ্যান্ড পাসপোর্ট অধিদপ্তর (ডিআইপি) সূত্র জানায়, আগে ইস্যুকৃত এমআরপি’র তথ্যের সঙ্গে বর্তমান এনআইডি ও বিআরসির (জন্ম নিবন্ধন সনদ) তথ্যে গরমিল থাকায় নতুন পাসপোর্ট পেতে বিপাকে পড়ছেন ইউরোপের প্রবাসীরা। অথচ দেশের ভেতর এনআইডি, বিআরসি ও যৌক্তিক প্রমাণাদি দিয়ে সহজেই তথ্য পরিবর্তন-সংশোধন করে ভুক্তভোগিরা অপেক্ষাকৃত কম হয়রানিতে এমআরপি করাতে পারছেন। এমআরপির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে যাচ্ছেন ই-পাসপোর্টও।

২০২১ সালের ২৮ এপ্রিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, তথ্য সংশোধনপূর্বক দেশে ও বিদেশে পাসপোর্ট রি-ইস্যুর আবেদনে নাম (নিজ, বাবা, মা) পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এনআইডি, বিআরসি কিংবা শিক্ষা সনদপত্র বিবেচনা করতে হবে এবং বয়স পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৫ বছরের ব্যবধান পর্যন্ত বিবেচনা করা যাবে। পরে একই বছর ৯ ডিসেম্বর একই বিভাগ থেকে জারি করা আরেকটি প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাসপোর্টের জন্য আবেদনকারীরা এনআইডি ও পাসপোর্টের মধ্যে তথ্যের গরমিল হলে যথাযথ প্রমাণের ভিত্তিতে প্রদত্ত তথ্য (নাম, বাবা-মায়ের নাম, বয়স ইত্যাদি) অনুযায়ী পাসপোর্ট দেয়া যাবে।
পরের পরিপত্রে প্রবাসীদের কথা উল্লেখ নেই। এতে মহাবিপাকে পড়েছেন প্রবাসীরা। এই প্রজ্ঞান সংশোধন না হলে ৬০ হাজার ইউরোপ প্রবাসীর প্রবাস জীবনে আসবে অনিশ্চয়তা। তারা বলছেন, যারা বিদেশে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দেশে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন, তাদের জন্য আইনটি অবশ্যই সহজ হওয়া প্রয়োজন।

এ বিষয়ে পাসপোর্ট মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আইয়ূব চৌধুরীর বক্তব্যÑ যারা যে তথ্যে পাসপোর্ট নিয়ে প্রবাসে অবস্থান করছেন, তারা শুধু তাদের তথ্য সংশোধন করতে পারবেন; কিন্তু পরিবর্তন নয়। আমরা দেখেছি অনেকে বিদেশে গিয়ে রাতারাতি তথ্য পরিবর্তন করে আবেদন করছেন। তাদের পাসপোর্ট পাওয়ার ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দেয়াটা খুবই স্বাভাবিক। কারণ আমাদের ডাটাবেইজে থাকা আগের তথ্যের সঙ্গে বর্তমান দেয়া তথ্যের সাদৃশ্য নেই।

এদিকে গতবছর ১৮ জুন হাইকোর্টের একটি আদেশের ফলেও এনআইডি জটিলতায় পড়েছেন প্রবাসীরা। এক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ৪৯টি ভুয়া মামলা সংক্রান্ত রায়ে হাইকোর্ট এই মর্মে আদেশ দেন যে, এনআইডি ছাড়া কেউ মামলা করতে পারবেন না। এখন থেকে থানায় বা আদালতে মামলা বা অভিযোগ করতে গেলে বাদী বা অভিযোগকারীর এনআইডি নম্বর উল্লেখ করতে হবে। এ রায়ের ফলে নিজ দেশে প্রবাসীদের সম্পত্তি রক্ষাসহ নানা আইনি সহায়তা লাভ আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ, যুক্তরাজ্যে বসবাসরত ব্রিটিশ বাংলাদেশি নাগরিকদের বেশিরভাগই দ্বৈত নাগরিক। অনেক প্রবাসী বাংলাদেশীর বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই। সাধারণত : ব্রিটিশ পাসপোর্টে বাংলাদেশে ভ্রমণের ক্ষেত্রে ‘নো ভিসা সিল’ বা ‘নো ভিসা স্টিকার’ই দ্বৈত নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসাবে গণ্য। ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের অনেকেই বাংলাদেশে পৈত্রিকসূত্রে জমি বা বাসা বাড়ি মালিক। অনেকে নিজেও বাংলাদেশে জমিজমা, বাসাবাড়ি করেন। অনেকে বাংলাদেশে শিল্পে বিনিয়োগ করেন। কখনও কখনও তাদের আইনি সহায়তা নেয়া জরুরি হয়ে পড়ে। এনআইডি না থাকায় সেই সহায়তা তারা পাচ্ছেন না। ‘এনআর বি লন্ডন’র আহ্বায়ক মানবাধিকারকর্মী আনসার আহমেদ উল্লাহ হাইকোর্টের ওই রায়ের পর বাংলাদেশ হাইকমিশনে এ বিষয়ে একটি স্মারকলিপি দেন। এতে বলা হয়, হাইকোর্টের এ রায় প্রবাসীদের আইনি সহায়তা লাভের অধিকারকে সঙ্কুচিত করবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন