দেশে-বিদেশে একটি কথা ‘আরাকানে গণহত্যা বন্ধ কর, বাঁচাও রোহিঙ্গা মুসলমানদের’। গত ১০ অক্টোবর থেকে মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশে চলছে রোহিঙ্গা মুসলিম শূন্য করতে জঘন্যতম নির্যাতন। স্থলবাহিনীর সাথে যুক্ত হয়েছে হেলিকপ্টার গানশিপ। আরাকান থেকে প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে প্রতিদিন পাওয়া যাচ্ছে নির্মম ও লোমহর্ষক বর্ণনা। মিয়ানমারের সেনা-পুলিশ ও বুদ্দিষ্ট সন্ত্রাসীরা যুবতীদের গণধর্ষণ, নির্বিচারে হত্যা ও গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়ার কথা জানা যায় প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায়।
আরাকানে রোহিঙ্গা মুসলিম নির্যাতনের বিষয় নিয়ে বিশ^ব্যাপী নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। এই গণহত্যা বন্ধের দাবি উঠেছে বিশ^ সমাজের পক্ষ থেকে। বাংলাদেশ কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে মিয়ানমার সরকারের কাছে। কিন্তু কথায় আছে ‘মগের মুল্লুক মিয়ানমার’। সেই মগের মুল্লুকের গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী নেত্রী অং সান সুচি এ পরিস্থিতির মধ্যেও গতকাল আরাকান পরিস্থিকে অন্যায্য নয় বলে মত প্রকাশ করেছেন বলে জানা গেছে। এখন বিশ^ মুসলিমের দাবি, গণহত্যা বন্ধে এগিয়ে আসুন বিশ^ সংস্থা, মিয়ানমারের উপর চাপ প্রয়োগ করা হোক। মানবিক সহযোগিতা দিয়ে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাঁচান।
নজিরবিহীন নির্যাতনে শিকার অসংখ্য ক্ষুধার্ত, পিপাসার্ত, ভীতসন্ত্রস্ত ও সম্ভ্রমহারা নারী-পুরুষ শিশু প্রাণ বাঁচাতে নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরে ভাসছে। মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের মংডু থানার ছোট গজিরবিল গ্রামের ৬৫ বছর বয়সী সমুদা খাতুন। টেকনাফের একটি গ্রামে আশ্রয় নেয়া এই বৃদ্ধার সাথে গত শনিবার কথা হয়। তিনি জানান, ‘আমার ভাতিজিকে সেনাবাহিনী ধর্ষণ করেছে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মাঝপথে সে মারা যায়। সেনাবাহিনী এসে পড়ায় গোলপাতার বাগানে তাকে একটা কাপড় মুড়ে ফেলে রেখে আমরা কোনোরকমে প্রাণ নিয়ে এসেছি। দুঃখ, ভাতিজির লাশটা দাফন করতে পারলাম না। আমার নিজের ছেলে ও ভাইপোকেও আমরা একই অবস্থায় ফেলে এসেছি। সেনাবাহিনীর লোকজন তাদের ঘরে আবদ্ধ করে আগুন ধরিয়ে দেয়। কেউ পালাতে চাইলে গুলি করে অথবা জবাই করে হত্যা করে। আমার আরো দুই আত্মীয়কে এক বাসায় রেখে এসেছিলাম। সকালে গিয়ে তাদের গলাকাটা লাশ পেয়েছি। হেলিকপ্টার দিয়ে আমাদের গ্রামে হামলা হয়েছিল। প্রায় দুই সপ্তাহ পর বাংলাদেশে পৌঁছতে সমর্থ হয়েছি।’
তিনি আরো জানান, ১০ দিন আগে গৃহহারা আরো বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গার সাথে পাহাড়-পর্বত ডিঙিয়ে এখন নিরাপদ আশ্রয়ে এসেছেন। এ ধরনের আরো কয়েকজন পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার বর্ণনায় উঠে আসে রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের ওপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর লোমহর্ষক নির্যাতনের চিত্র।
তারা আরো জানান, মিয়ানমারের সৈন্যদের নির্মম নির্যাতনে দিশেহারা রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশে ব্যর্থ হয়ে পুনরায় ফিরতে হবে মৃত্যুপুরী মিয়ানমারের দিকে, এই ভয়ে অনেকেই নাফ নদীতে ভেসে ভেসে অপেক্ষা করছেন নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে।
মিয়ানমারের কোরিয়ারপাড়া গ্রামের বাসিন্দা নূর বাহার জানান, তার স্বামী দিলদার হোসেন একজন জেলে। মাছ শিকার করে তাদের সংসার চলে। তার চার ছেলে-মেয়ে। মিয়ানমারের সৈন্যরা বাড়িতে ঢুকে তাকে বের করে দিয়ে তার স্বামীকে ঘরে আটকে রাখে। পরে সৈন্যরা বাইরে থেকে ঘরের চারপাশে আগুন লাগিয়ে দেয়। এরপর কী আর বলব! কান্নায় ভেঙে পড়েন ওই মহিলা। আগুন দিলে কেউ কি বেঁচে থাকে? তারা এইভাবে আমার স্বামীর মতো অনেককে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছে। এ অবস্থায় প্রাণের ভয়ে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে নাফ নদী পার হয়ে একটি নৌকায় আমরা ২৫ জনের একটি দল বাংলাদেশে আসি।
শুধু তা-ই নয়, রোহিঙ্গাদের প্রতিটি বাড়িতে তল্লাশির নামে যে কোনো বাড়ি পুড়িয়ে দিতে দ্বিধা করছে না মগসৈন্যরা। বাড়ি থেকে কাউকে বের হতে দেখলেই গুলি চালায়। বাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার পর তাদের খোলা আকাশে বসিয়ে রাখছে তারা। এমন বর্ণনা দিলেন অপর আশ্রয় নেয়া কামাল হোসেন ও অন্যান্য কয়েকজন।
এ দিকে টেকনাফ বিজিবি সূত্র জানায়, গভীর রাতে টেকনাফের নাফ নদী দিয়ে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকালে চারটি বোটকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। বোটগুলোতে অর্ধশত রোহিঙ্গা ছিল বলে জানান বিজিবি।
গতকাল সরেজমিন টেকনাফ, ঘুমধুম, তুমব্রু, উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে এবং স্থানীয় জনগণের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত ১২ নভেম্বর থেকে এ পর্যন্ত অন্ততপক্ষে ২০-২৫ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এরমধ্যে উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পেই আশ্রয় নিয়েছে বেশি।
প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, টেকনাফের হোয়াইক্ষ্যং, কাটাখালী, উলুবুনিয়া, উনচিপ্রাং, বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার সীমান্ত এলাকা ঘুমধুম, তুমব্রু, বাইশফাঁড়ি দিয়ে রাতের অন্ধকারে রোহিঙ্গারা প্রবেশ করছে।
গতকাল দুুপুরে তুমব্রু সীমান্ত এলাকার এক স্থানীয় বাসিন্দা এই প্রতিবেদককে বলেন, গত তিনদিন ধরে দিনের বেলা লোক ঢুকতে পারছে না। কিন্তু রাতের অন্ধকারে এসব টহল কোনো কাজে আসে না। কারণ রাত গভীর হলে বড় রাস্তাগুলোতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নজরদারি বাড়িয়ে থাকে। আর ওদিকে সীমান্তবর্তী কাঁটাতারের পাশ দিয়ে গহীন অরণ্যে অনুপ্রবেশ চলছেই।
উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাইন উদ্দিন বলেন, ক্যাম্পগুলোতে যাওয়ার এখতিয়ার তাদেরও নেই। প্রশাসন এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করেও বিজিবির কাছে তুলে দিচ্ছে। তারপর তারা ব্যবস্থা করছে। ক্যাম্পের হিসাব তার কাছে নেই।
রোববার ভোরে উখিয়া ও টেকনাফ সীমান্তের নাফ নদীর বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশের সময় রোহিঙ্গা বোঝাই আরো ছয়টি নৌকায় শতাধিক রোহিঙ্গা নারী শিশুকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। বিজিবির টেকনাফ ২ ব্যাটালিয়নের উপ-অধিনায়ক মেজর আবু রাসেল সিদ্দিকী এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
উখিয়ায় ৫ অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাকে পুশব্যাক (ফেরত) করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এর সদস্যরা। রোববার ২৭ নভেম্বর সকাল সাড়ে ৭টার দিকে উখিয়ার পার্শ্ববর্তী ঘুমধুম সীমান্ত দিয়ে তাদের স্বদেশে ফেরত পাঠানো হয়। এদের মধ্যে তিনজন পুরুষ ও দুইটি শিশু রয়েছে। এ নিয়ে গত ২৭ দিনে কক্সবাজার ৩৪ বিজিবি অনুপ্রবেশের সময় ৪১৬ জনকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠালো। কক্সবাজার ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক ইমরান উল্লাহ সরকার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে কড়াকড়ি অবস্থানে রয়েছে বিজিবি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন