নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলা আগাম আলু, ধান, পাট, গম ও ভুট্টা চাষের জন্য বিখ্যাত। গত এক যুগ থেকে আলু চাষে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করছে এ উপজেলার কৃষকরা। তবে অঞ্চলটির মাটি ও আবহাওয়া চা চাষের জন্য অধিক উপযোগী। এ কারণে দিন দিন চা চাষে আগ্রহ বাড়ছে চাষিদের। কিশোরগঞ্জ উপজেলার সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সিদ্দিকুর রহমান ২০১৪ সালে ভিক্ষুক পুনর্বাসন প্রকল্পের আওতায় উপজেলা পরিষদের পরিত্যক্ত জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে চা চাষ শুরু করেন। প্রাথমিকভাবে তিনি এক বিঘা জমিতে দুই হাজার চারা রোপণ করেন। অল্প দিনেই চায়ের সবুজপাতা গজাতে শুরু করে। এ কাজে তাকে সহায়তা করেন পঞ্চগড় চা বোর্ড কর্তৃপক্ষ। চা চাষে আলোর মুখ দেখে উপজেলা পরিষদের পতিত প্রায় সাড়ে তিন একর জমিতেও চারা রোপণ করা হয়। সেখানেও আসে সফলতা। উপজেলা চত্বরের পতিত জায়গাগুলো এখন রূপ নিয়েছে দুটি পাতা একটি কুঁড়ির ফসল চায়ের বাগানে।
পরীক্ষামূলকভাবে চা চাষে অভাবনীয় সাফল্যের পর বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হয় ২০১৫ সালে। ওই বছরের জুনে উপজেলা প্রশাসনের পরামর্শে এবং বাংলাদেশ চা বোর্ডের কারিগরি সহায়তায় সিনহা এগ্রো ইন্ডাস্ট্রি প্রথমে দেড় একর জমিতে চা চাষ শুরু করে। পরে দুই ধাপে তিন মৌজায় মোট ৩৫ একর জমিতে চা চাষ শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি।
সিনহা এগ্রো ইন্ডাস্ট্রির বাহাগিলি চা বাগানের ব্যবস্থাপক রিফাত হাসান বলেন, ‘উপজেলা প্রশাসনের পরামর্শে আমরা স্বল্প পরিসরে চা চাষ শুরু করেছিলাম। পরে দেখা যায় আলু কিংবা ভুট্টার চেয়ে চা চাষ অধিক লাভজনক। বর্তমানে আমরা ৩৫ একর জমিতে চা চাষ করছি। প্রথম পর্যায়ের ৭ একর জমির বাগান থেকে আমরা এক লাখ ৭৫ হাজার কেজি চা বিক্রি করেছি, যার বাজার মূল্য প্রায় ২৩ লাখ টাকা।’
এছাড়া উপজেলা ভূমি অফিসের পতিত জমি, মাগুড়া ভূমি অফিসের পতিত জমি ও নীলসাগর গ্রুপের অনুভব চা বাগানে বাণিজ্যিকভাবে চা উৎপাদন শুরু হয়েছে। ক্ষুদ্র চা উৎপাদনকারী হিসেবে কিশোরগঞ্জ উপজেলার ১৩ জন কৃষক প্রায় ১৫ একর জমিতে ব্যক্তি উদ্যোগে চা চাষ শুরু করেছেন। প্রতিনিয়ত বাড়ছে চা চাষির সংখ্যা। সরকারি, বাণিজ্যিক ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে বর্তমানে কিশোরগঞ্জ উপজেলায় প্রায় ৫৫ একর জমিতে চা চাষ হচ্ছে। এসব চা বাগানে প্রতিদিন ১০০-১৫০ জন নারী ও পুরুষ শ্রমিক কাজ করছেন। ফলে ওই পরিবারগুলোতে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। উপজেলার ময়নাকুড়ি চা বাগানে কর্মরত শ্রমিক মমিনা খাতুন বলেন, অন্য কজের চেয়ে চা বাগানে কাজ করলে মজুরি বেশি পাওয়া যায়। এ টাকায় ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালাচ্ছি, পরিবার নিয়ে সুখে দিন কাটাচ্ছি।
মাগুড়া ইউনিয়নের চা চাষি রোকন ইবনে আজিজ বলেন, আমার বাগানের বয়স তিন বছর। এর মধ্যে বারোবার পাতা সংগ্রহ করেছি। আমি হিসাব করে দেখেছি আমার চেয়ে বেশি লাভ করছে চায়ের প্রক্রিয়াকরণে নিযুক্ত ফ্যাক্টরি। আমরা পাতার ন্যায্য দাম পাচ্ছি না। আমরা চাই এখানে একটি চা প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা স্থাপন করা হোক। সেই সঙ্গে প্রথম দুই বছর বিনা সুদে ব্যাংক ঋণ দেয়া গেলে চাষি পর্যায়ে অনেকটা লাভবান হওয়া সম্ভব হতো। বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট এর ঊর্ধ্বতন খামার সহকারী মো. জায়েদ ঈমাম সিদ্দিকী বলেন, ‘নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জে সরকারি ও চাষি পর্যায়ে মোট ৫৫ একর জমিতে চায়ের চাষ হচ্ছে। চাষিদের মুনাফা হচ্ছে। প্রতি কেজি চা উৎপাদনে খরচ হয় ১০-১২ টাকা, বিক্রি হচ্ছে প্রায় ২২-২৪ টাকায়। চা চাষের জন্য এ অঞ্চলের মাটি খুব উপযোগী। সিলেট অঞ্চলে চারা রোপণের পাঁচ বছর পর পাতা উত্তোলন শুরু হয়। কিন্তু এখানে এক থেকে দেড় বছরেই পাতা উত্তোলন করা যাচ্ছে।’ তিনি আরও জানান ,নীলফামারী জেলার ২৫ হেক্টর জমি চা চাষের আওতায় আনার লক্ষ্যে চা বোর্ড কাজ করে যাচ্ছে।
কিশোরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নূরই আলম সিদ্দিকী জানান, উপজেলায় দিন দিন চা চাষ রেড়েই চলছে। এই উপজেলা ও পাশ্ববর্তী কোন এলাকায় কোন চা প্রক্রিয়াকরণ কারখানা না থাকার কারনে এখানকার কৃষকরা চায়রে ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
আমরা চা বোর্ড এবং বেসরকারি শিল্প উদ্যোক্তাদের সাথে আলাপ আলোচনা চলছে। ভবিষ্যতে আমরা যদি একটি বা একাধিক চা প্রক্রিয়াকরণ কারখানা স্থাপন করতে পারি তাহলে চা চাষ ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন