জামালউদ্দিন বারী : বিশ্বসভ্যতার ক্রমোন্নতি ও নগরায়ণের সাথে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ও অবিচ্ছেদ্যভাবে যে বিষয়টি জড়িয়ে আছে তা হচ্ছে সুপেয় পানির সহজলভ্যতা ও নদ-নদীর প্রবাহ। নীলনদের তীরে গড়ে ওঠা মিসরীয় সভ্যতা, টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস বা দজলা-ফোরাতের তীরে গড়ে ওঠা পারস্য সভ্যতা, সিন্ধু নদের তীরে গড়ে ওঠা সিন্ধু সভ্যতা এবং গঙ্গার তীরে গড়ে ওঠা প্রাচীন ভারতীয় ও বাংলার সভ্যতার বাইরে এশিয়া-আফ্রিকার ঐতিহাসিক বিবর্তনকে কল্পনা করা যায় না। ঠিক একইভাবে টেম্স, ভলগা, দানিউব ও রাইন নদীকে ঘিরেই তৈরি হয়েছিল ইউরোপের গড়ে ওঠার ইতিহাস। হাজার হাজার বছর ধরে প্রবহমান এসব নদ-নদী এখনো যথারীতি প্রবাহিত হয়ে চলেছে। নদী উপত্যকা ও অববাহিকার কোটি কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা, ভূ-প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য এসব নদীর পানি ও নাব্যতার ওপর একচ্ছত্রভাবে নির্ভরশীল। নদ-নদীর পানি প্রবাহ অবারিত রাখা রাষ্ট্রের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এ কারণেই ট্রান্সবাউন্ডারি রিভার ওয়াটার শেয়ারিং সম্পর্কিত ডিসপিউটগুলো শত শত বছর ধরে রাষ্ট্রসমূহের আন্তঃসম্পর্কের অন্যতম নিয়ামক বিষয় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে। নদীর পানি প্রবাহ নিয়ে প্রাচীন ইতিহাসেও অনেক যুদ্ধবিগ্রহের নজির আছে। নগর সভ্যতা ও শিল্প-বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংঘাত বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক ফোরাম গঠনে ট্রান্সবাউন্ডারি বা যৌথনদীর পানিকেন্দ্রিক আঞ্চলিক বিরোধ মীমাংসা একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। তবে জাতিসংঘ বা লীগ অব নেশন্স গঠনের বহু আগে থেকে জাতিসমূহ আঞ্চলিক পানি বিরোধ নিষ্পত্তিতে সমঝোতামূলক নানা চুক্তি ও উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। প্রাচীনতম পানি চুক্তির উদাহরণ হিসেবে সুমেরীয় সভ্যতার সময়ে দুই নগর-রাষ্ট্র লাগাশ ও উম্মার মধ্যে পানি চুক্তির তথ্য পাওয়া যায়, যা খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ সালে সম্পাদিত হয়েছিল। ১৮২০ সাল নাগাদ সারা বিশ্বে চার শতাধিক পানি চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। আর চলতি দশক পর্যন্ত সারা বিশ্বে ৩৬০০ এর বেশি পানি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। বিশেষত ২৬৩টি আন্তর্জাতিক রিভার বেসিন দিয়ে বিশ্বের সুপেয় পানির ৬০ ভাগই প্রবাহিত হয় এবং এসব নদী অববাহিকায় বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪০ ভাগের বেশি মানুষ বাস করে এবং বিশ্বে উৎপাদিত খাদ্যশস্যের সিংহভাগ এসব নদী অববাহিকায় উৎপাদিত হয়। বিশ্বের রাজনৈতিক মানচিত্রে পরিবর্তনের সাথে সাথে যৌথনদীর ওপর মানুষের দাবি যতই বিভক্ত হয়েছে নদীর ওপর কোনো একক জাতির নিয়ন্ত্রণের সুযোগ ততই সঙ্কুচিত হয়েছে। উজানের দেশগুলো সুবিধাজনক অবস্থানে থেকে যৌথ নদীর পানির ওপর আধিপত্য কায়েমের চেষ্টা করলে অধিকাংশ শস্যশ্যামল নদী উপত্যকা শেষ পর্যন্ত শুকনো বিরান মরুভূমিতে পরিণত হতো। নদ-নদীর পানি নিয়ে ঐতিহাসিকভাবে জাতিগুলোর মধ্যে যে ভারসাম্য ও সমঝোতামূলক অবস্থান তৈরি হয়েছে তা-ই বিশ্বকে এখনো বড় ধরনের পানি সংকট ও বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখছে। তবে অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে কিছু কিছু আধিপত্যবাদী শক্তি যৌথনদীর পানিকে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার কৌশল গ্রহণ করায় আগামী দশকগুলোতে অনেক দেশই পানি সংকটে বড় ধরনের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। শুধু এশিয়ায় নয়, সম্ভবত সারা বিশ্বের মধ্যে যৌথনদীর উজানে পানি প্রত্যাহার ও বাঁধ নির্মাণের সবচেয়ে বড় বঞ্চনার শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ। গঙ্গা ও তিস্তার মতো আন্তর্জাতিক নদীতে বাঁধ নির্মাণ করে ভারত বাংলাদেশের নদ-নদী ও পানি ব্যবস্থাপনার ওপর বড় ধরনের আগ্রাসন সৃষ্টি করেছে। আর ভারতের পরিকল্পিত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে গঙ্গা-বহ্মপুত্র অববাহিকায় এসব নদীবাহিত পলি দিয়ে গড়ে ওঠা বাংলাদেশ মূলত মানবসৃষ্ট ভূ-প্রাকৃতিক ভাগাড়ে পরিণত হবে। বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপ, উজানের হিমালয় থেকে নেমে আসা নদীগুলো বঙ্গোপসাগরে মিলে যাওয়ার আগে গঙ্গা বেসিনে লাখ লাখ টন পলিমাটি জমা করে তিলে তিলে হাজার হাজার বছরে এ দেশটিকে গড়ে তুলেছিল। উর্বর মাটি এবং অসংখ্য নদীর সুপেয় পানিই এ দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ। উজান থেকে নদীর পানি প্রবাহ রুদ্ধ করা মানে ঠা-া মাথায় বাংলাদেশকে হত্যা করা। চার দশক ধরে ভারত এ কাজটি করে চলেছে।
এমনিতে আন্তর্জাতিক নদীর ওপর কোনো দেশের এককভাবে বাঁধ নির্মাণ বা পানি প্রত্যাহারের সুযোগ নেই। আন্তর্জাতিক নদী আইনে এ সুযোগ নেই। নদীর স্বাভাবিক প্রবাহকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার প্রকল্প সব সময়ই অববাহিকা অঞ্চলের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনে। কলকাতা বন্দরের নাব্যতা রক্ষার জন্য গঙ্গার ওপর বাঁধ নির্মাণের প্রস্তাব ব্রিটিশ আমলেই প্রথম উত্থাপিত হয়েছিল। ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য ১৮৫১ সাল থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে অন্তত ৫টি সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। এসব সমীক্ষার রিপোর্ট ছিল নেতিবাচক। তৎকালীন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চিফ ইঞ্জিনিয়ার শ্রী কপিল ভট্টাচার্য ফারাক্কা প্রকল্পের বিরোধিতা করে এই প্রকল্পের মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে যেসব বিষয়কে প্রাধান্য দিয়েছিলেন তা হচ্ছে : গঙ্গা থেকে অপসারিত ৪০,০০০ কিউসেক পানি ফিডার খাল কিংবা হুগলি-ভাগিরথী নদী ধারণ করতে পারবে না। গঙ্গা ও ভাগিরথীর প্রবাহ রেখার উচ্চতার পাথর্ক্যরে কারণে পানি সঞ্চালন কষ্টকর হবে। এর ফলে গঙ্গা নদী তার স্বাভাবিক প্রবাহের জন্য অন্য পথ খুঁজবে। প্রথমোক্ত কারণে মুর্শিদাবাদ এবং মালদা জেলাজুড়ে দেখা দেবে জলাবদ্ধতা। সেই সাথে নদীর মিয়ান্ডার ফ্রিকোয়েন্সি ও দূরত্বের প্রাকৃতিক প্রবাহে বাড়তি চাপের কারণে নদীভাঙন ও জলাবদ্ধতার পাশাপাশি নদীতে চর পড়ে সংকট বাড়াবে। ভাটি অঞ্চলের সকল নদীর নাব্যতা মারাত্মকভাবে বিঘিœত হবে এবং শুকনো মওসুমে পানি প্রবাহ কম হওয়ার কারণে জলবায়ুর পরিবর্তন দেখা দেবে। সম্ভবত ভাটিতে পূর্ববাংলায় এর বিরূপ প্রভাবের বিষয়গুলো বিবেচনা করেই ঔপনিবেশিক শাসকরাও ফারাক্কা ব্যারাজ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়নি। উপমহাদেশের স্বাধীনতার পর ভারতের ফারাক্কা ব্যারাজ নির্মাণই হচ্ছে সবচেয়ে বড় আত্মঘাতী, অপরিণামদর্শী ও আধিপত্যবাদী তৎপরতা। ভাটির অববাহিকার দেশ বাংলাদেশের সাথে কোনো চুক্তি বা সমঝোতা ছাড়াই একতরফভাবে ফারাক্কা ব্যারাজ নির্মাণকালে সত্তরের দশকের প্রথম দিকে রিভার ডাইজেস্ট ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ভারত ফারাক্কা ব্যারাজ নির্মাণ করলেও এটি চালু করতে পাকিস্তানের সাথে চুক্তিতে আসতে হবে, অন্যথায় এটি কখনো চালু হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় আছে। তবে ১৯৭১ সালে ভারতের সহযোগিতায় মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ফারাক্কা প্রকল্পের সমাপ্তি ও চালু করতে ভারতকে কোনো বেগ পেতে হয়নি। ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞ সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের নেতাদেরকে মাত্র কয়েক সপ্তাহের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা ব্যারাজ চালুর কথা বলা হলেও কার্যত বাংলাদেশের সাথে আনুষ্ঠানিক কোনো চুক্তি ছাড়াই বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নদীটির পানি আটকে দিয়ে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের কৃষি, প্রাণিব্যবস্থাপনা, প্রাণিবৈচিত্র্য, নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থা ও পরিবেশগত বিপর্যয়ের ছাড়পত্র নিশ্চিত করে দেয়। গঙ্গার ওপর ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে ফিডার ক্যানেল ও হুগলি ভাগিরথী নদীর পানি প্রবাহ বৃদ্ধির পর বাংলাদেশের তিস্তার উজানে হুগলি নদীতে বাঁধ নির্মাণ করে দেশের উত্তর-মধ্যাঞ্চলকেও ইতিমধ্যে ভয়াবহ পানি বিপর্যয়ের সম্মুখীন করা হয়েছে। একতরফাভাবে ফারাক্কা ব্যারাজ চালুর ৭ বছরের মাথায় গজলডোবা ব্যারাজ দিয়ে ফিডার ক্যানেলের মাধ্যমে তিস্তার পানি প্রত্যাহার শুরু করে। ডাইভারশন ক্যানেলের মাধ্যমে মহানন্দা নদীতে পানি সরিয়ে নেয়ার কারণে তিস্তা এখন একটি মৃতপ্রায় নদীতে পরিণত হয়েছে। গজলডোবা বাঁধের আগে তিস্তা অববাহিকায় যেখানে ২৫০০ কিউসেক পানি পাওয়া যেত, সেখানে ভারতের পানি প্রত্যাহারের কারণে এখন পানি প্রবাহের পরিমাণ ৪০০ কিউসেকেরও কম। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষিব্যবস্থার উন্নয়নে তিস্তা ব্যারাজ নির্মাণের পরিকল্পনা ব্রিটিশ আমল থেকে বিবেচনাধীন থাকলেও অবশেষে ১৯৭৯ সালে তিস্তা ব্যারাজ ও সেচ প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হয়ে ১৯৯০ সালে তা শেষ করে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হলেও গজলডোবা ব্যারাজ এবং ভারতের পানি প্রত্যাহারের কারণে দেশের অন্যতম বৃহৎ এই সেচ প্রকল্প এখন আংশিকভাবে অকেজো হয়ে পড়েছে। শুকনো মওসুমে পানির অভাবে হাজার হাজার হেক্টর ফসলি জমি অনাবাদি রাখতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষকরা।
ভারতের কথিত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত-সমালোচিত একটি প্রকল্প। বিশ্বের পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা এ প্রকল্পের কারণে বাংলাদেশের জলবায়ু ও পরিবেশগত বিপর্যয়ের আশঙ্কাগুলো তুলে ধরছেন। বাংলাদেশের সাথে অভিন্ন ৫৪টি নদীতে বাঁধ নির্মাণ করে ভারত একটি জাতীয় পানিগ্রিড নির্মাণের যে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে তা বাংলাদেশের জন্য নিশ্চিতভাবেই মরণ ফাঁদ। সত্তরের দশকে বাংলাদেশের প্রবাদপ্রতিম জননেতা মওলানা ভাসানী ফারাক্কা ব্যারাজের বিরুদ্ধে জনগণের পক্ষে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ভাসানীর সেই ফারাক্কা লংমার্চের চেতনা গত চার দশকে বাংলাদেশে আরো গভীর ও মূর্ত হয়েছে। এদেশের প্রত্যেক নাগরিক যেমন ভারতের পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে চরমভাবে বিক্ষুব্ধ একইভাবে এ বিষয়ে আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের বিষ্ময়কর নীরবতায় নতুন প্রজন্ম ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত। সম্ভবত রাজনৈতিক কারণে দেশের মূল ধরার গণমাধ্যম ভারতের পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দায়সারা আচরণ করলেও এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেশের কোটি মানুষ ভারতের পানি আগ্রাসনসহ সব আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে শুরু করেছে। অর্ধশত বছরেরও বেশি আগে বাংলার চিফ ইঞ্জিনিয়ার কপিল ভট্টাচার্য ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে যেসব ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন আজকের বাস্তবতা তার সেই আশঙ্কার চেয়েও বেশি ভয়াবহ। এখন বাংলাদেশের জনগণের পাশাপাশি ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের জনপ্রতিনিধি এবং নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকেও ফারাক্কা ব্যারাজ তুলে দেয়ার দাবি উঠছে। গজলডোবা ব্যারাজ চালু হওয়ার পর থেকেই তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির জন্য বাংলাদেশ ভারতের কাছে ধরনা দিলেও ভারত সরকারের পাষাণ হৃদয় বাংলাদেশের বনি আদমের জন্য কখনো বিগলিত হয় না। পদ্মা, যমুনা, তিস্তা, বহ্মপুত্রের বিশাল অংশ ইতিমধ্যে নাব্যতা হারিয়েছে। এসব নদীর অসংখ্য শাখা নদী চরের ধু ধু বালুতে বিলীন হয়ে গেছে। যে জনপদে এক সময় মাঝিমাল্লারা পালতোলা নৌকায় পণ্যবোঝাই করে ভাটিয়ালি গান ধরত, এখন সেসব জনপদে পানির জন্য চরম হাহাকার চলছে, সেখানে মরুপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। অর্থাৎ হাজার নদীর সিঞ্চনে শস্যশ্যামল বাংলাদেশের মতো জনপদটির রাজনৈতিক স্বাধীনতার পর থেকেই একে পানিতে মারার ভারতীয় আয়োজন আশঙ্কার চেয়েও দ্রুত পরিণতি লাভ করছে। বাংলাদেশের মাটিকে চিরস্থায়ী ঊষর ও পড়োভূমিতে পরিণত করার পাশাপাশি দেশের কোটি কোটি মানুষকে জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত করার অশুভ পরিকল্পনাই যেন বাস্তবায়িত হচ্ছে। যে দেশের মানুষ রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ দিতে পারে, সে দেশের ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে আজ ভারতের পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ব্যাপক ঐক্য গড়ে উঠলেও দেশের রাজনৈতিক নেতাদের নীরবতা বিস্ময়কর লজ্জাজনক।
শুধুমাত্র তিস্তার পানি চুক্তির সম্ভাব্যতার কারণে আগামী মাসে নির্ধারিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকে বিশেষ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছেন দেশের সাধারণ মানুষ। যদিও ভারতের পক্ষ থেকে কয়েক দশক ধরেই তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির মূলা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। ভারতে সরকার পরিবর্তন হয় কংগ্রেসের সাথে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক সখ্য ও রাজনৈতিক সমঝোতার সুসময়ে বিগত কংগ্রেস সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতিরা বার বার আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতি দেয়ার পরও তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি হয়নি। আবার ১৯৯৬ সালে সম্পাদিত গঙ্গার পানি চুক্তিটিও শুধুমাত্র কাগুজে চুক্তিতে পরিণত হয়েছে। বছরের পর বছর পেরিয়ে যায় ভারতের অনাগ্রহের কারণে চুক্তি অনুসারে যৌথনদী কমিশনের কোনো সভা হয় না। বাংলাদেশ তার প্রাপ্য পানি না পাওয়ার বঞ্চনার সমাধানও হয় না। প্রধানমন্ত্রীর এবারের ভারত সফরে তিস্তার পানি চুক্তির যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে, সেখানে অতীতের গঙ্গা চুক্তির অভিজ্ঞতার আলোকে আগামীর পথ ও পন্থা নির্ণীত হবে বলে আমরা আশা করছি। তবে এই মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ব পানি সম্মেলনে যোগ দিতে হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে অবস্থান করছেন। গত ২৮ নভেম্বর সোমবার থেকে শুরু হওয়া তিন দিনের এই ওয়াটার সামিট আজ বুধবার শেষ হচ্ছে। এবারের পানি সম্মেলনে বাংলাদেশের পানি সমস্যার জ্বলন্ত ইস্যুগুলোকে তুলে ধরা হবে বলে সরকারের সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে আগেই ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। বিশেষত যৌথ নদীর উজানে ড্যাম নির্মাণ ও পানি প্রত্যাহার সম্পর্কিত ইস্যুগুলোতে বাংলাদেশ একই সাথে ভারত ও চীনের কাছে ন্যায্যতা দাবি করবে বলে জানা গেছে। এত বছর উজানে ভারত একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে বাংলাদেশকে মরুভূমিতে পরিণত করার সব আয়োজন চালিয়ে গেলেও এখন ব্রহ্মপুত্রের উজানে চীনের পানি প্রত্যাহারের কারণে ভারতও পানি সংকটের হুমকিতে পড়তে শুরু করেছে। এহেন বাস্তবতায় বাংলাদেশের পানি সংকট এখন ত্রিপাক্ষিক ইস্যুতে পরিণত হতে যাচ্ছে। মূলত ট্রান্সবাউন্ডারি বা যৌথনদীর পানি সমস্যা একটি আন্তর্জাতিক ইস্যু। আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য অববাহিকাভিত্তিক নদী ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার মাধ্যমেই এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব। মেকং নদীর পানি নিয়ে বহুপাক্ষিক সমস্যা সমাধানকল্পে পঞ্চাশের দশকে গঠিত মেকং রিভার কমিশন, ষাটের দশকে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সম্পাদিত সিন্ধুনদীসহ সিন্ধু অববাহিকার পানিচুক্তি, মধ্য এশিয়া সির দরিয়া রিভার বেসিন পানি চুক্তি এমনকি নব্বইয়ের দশকে জর্ডান-ইসরাইলের মধ্যে সম্পাদিত পানি চুক্তিও শুরু থেকে অব্যাহত আছে। গত অর্ধশত বছরে দুই পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে অন্তত ৩টি যুদ্ধ সংঘটিত হলেও বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় ১৯৬২ সালে সম্পাদিত ভারত-পাকিস্তানের ইন্ডাসভ্যালি ওয়াটার ট্রিটির কোন হেরফের হয়নি। কাশ্মীরে জঙ্গি হামলার ঘটনায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক উত্তেজনার সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী সিন্ধু নদীর পানি আটকে দেয়ার হুমকি এবং ভারতের দুটি পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের বিরুদ্ধে পাকিস্তান পানিচুক্তির মধ্যস্থতাকারী সংস্থা বিশ্বব্যাংকে অভিযোগ তুললে বিশ্বব্যাংক একটি সালিশি আদালত স্থাপন এবং নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ নিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। সিন্ধু নদের পানিকে পাকিস্তানকে চাপে রাখার ট্রাম্পকার্ড হিসেবে ব্যবহার করতে চাচ্ছে মোদি সরকার। বিশ্বব্যাংকের ত্বরিত হস্তক্ষেপে হয়তো তা আর সম্ভব হচ্ছে না। ভারত-বাংলাদেশের যৌথ নদীর পানি সমস্যাকে ভারত তার নিজস্ব বা অভ্যন্তরীণ সমস্যা হিসেবেই দেখিয়ে আসছে। তবে এসব নদী যে আন্তর্জাতিক নদী তা আন্তর্জাতিক ফোরাম থেকেও ইতিমধ্যে স্বীকার করা হয়েছে। বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন এবং যৌথ নদীর পানি ব্যবস্থাপনা ও বঞ্চনার ইতিহাসে বাংলাদেশ একটি অত্যন্ত খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে। পশ্চিমা বিশ্বের পানি বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ভারত কর্তৃক বাংলাদেশের পানি বঞ্চনার দৃষ্টান্তকে গুরুত্বপূর্ণ কেস স্টাডি হিসেবে গ্রহণ করছেন। বাংলাদেশে ফারাক্কা ব্যারাজের পরিবেশগত বিপর্যয় নিয়ে পশ্চিমা লেখকদের কেউ কেউ ফিকশন, স্পাই থ্রিলার বইও লিখেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সিআইএ কর্মকর্তা ডুয়ান ইভান্সের লেখা ‘নর্থ ফ্রম ক্যালকাটা’ উপন্যাসে ফারাক্কা বাঁধ গুঁড়িয়ে দিতে ভারতের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর চরমপন্থিদের একাট্টা হয়ে অভিযান পরিচালনার কল্পকাহিনী তুলে ধরা হয়েছে। পশ্চিমা ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বিদ্যমান বাণিজ্য বৈষম্য, সীমান্ত হত্যাকা-, চোরাচালান বা ট্রানজিটের মতো সমস্যাগুলোর মধ্যে পানি সমস্যাকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করছেন কিন্তু আমাদের সরকার ও রাজনৈতিক নেতারা দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যতের আলোকে প্রকৃত সমস্যা চিহ্নিত করে তার সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ নিতে বরাবরই ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছেন। বাংলাদেশকে গলাটিপে হত্যা করার মতো ধ্বংসাত্মক আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প ভারত ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন করছে, আর বাংলাদেশের সরকার, সব রাজনৈতিক দল, জনসমাজ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নীরব দশর্কের ভূমিকা পালন করছে।
bari_zamal@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন