রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু বলেছেন, বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা কমাতে ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযানে রাশিয়ান সেনাবাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের অগ্রগতি কমিয়ে দিয়েছে। ন্যাটো মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ বলেছেন, ইউক্রেনকে সহায়তা প্রদানের জন্য ইউরোপকে মূল্য দিতে হবে।
গতকাল সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) সদস্য দেশগুলোর প্রতিরক্ষা প্রধানদের এক বৈঠকে শোইগু বলেন, ‘বিশেষ অভিযানের সময় আমরা কঠোরভাবে মানবিক আইন মেনে চলি। কমান্ড পয়েন্ট, বিমানঘাঁটি, ডিপো, সুরক্ষিত এলাকা এবং প্রতিরক্ষা শিল্প সাইট সহ ইউক্রেনীয় সশস্ত্র বাহিনীর সামরিক অবকাঠামো সুবিধাগুলিতে উচ্চ-নির্ভুল অস্ত্র দিয়ে আক্রমণ করা হয়। একই সময়ে, বেসামরিক হতাহতের ঘটনা রোধ করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করা হচ্ছে। এটি অবশ্যই অগ্রগতির গতি কমিয়ে দেয় তবে আমরা সচেতনভাবে এটি করি।’ তার মতে, রাশিয়ান সৈন্যরা ‘মুক্ত করা এলাকায় শান্তিপূর্ণ জীবন পুনরুদ্ধারের জন্য পদ্ধতিগত কাজে নিযুক্ত রয়েছে’। ‘আমরা স্থানীয়দের মানবিক সহায়তা প্রদান করছি, অবকাঠামোগত সুবিধা এবং জীবন সহায়তা ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করছি,’ রাশিয়ান প্রতিরক্ষা মন্ত্রী উল্লেখ করেছেন।
শোইগু আরও বলেছিলেন যে, ‘ইউক্রেনীয় সশস্ত্র বাহিনী হারানো এলাকায় সব ধ্বংস করে দেয়ার কৌশল প্রয়োগ করে, স্পষ্টভাবে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে এবং সন্ত্রাসীদের মতো আচরণ করে।’ ‘তারা আবাসিক ভবন, স্কুল, হাসপাতাল এবং কিন্ডারগার্টেনগুলিতে গুলি চালানোর অবস্থান তৈরি করে, সেখানে ট্যাঙ্ক এবং আর্টিলারি মোতায়েন করে এবং বেসামরিকদেরকে মানব ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে বসতিতে হামলা করে এবং লেপেস্টক ল্যান্ডমাইন ফেলে দেয় যাতে মুক্ত এলাকার মানুষ ও স্থাপণার যতটা সম্ভব ক্ষতি করা যায়,’ রাশিয়ান প্রতিরক্ষা প্রধান জোর দিয়ে বলেন।
ইউক্রেনকে সমর্থনের জন্য মূল্য দিতে হবে ইউরোপকে : ন্যাটো মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ মঙ্গলবার জেডডিএফ-এর সাথে একটি সাক্ষাতকারে বলেছেন, ইউক্রেনকে সহায়তা প্রদান চালিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। তবে তিনি স্বীকার করেছেন যে, এটি কঠিন হবে এবং কিয়েভকে সমর্থনের জন্য ইউরোপকে মূল্য দিতে হবে। ‘আমরা যা দেখছি তা হল ন্যাটোর ইউরোপীয় মিত্র, জার্মানি, কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশের কাছ থেকে অভূতপূর্ব সমর্থন। আমি আজ (ইউক্রেনীয়) প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির ক্রিমিয়া প্ল্যাটফর্ম (ফোরাম)-এ অংশ নিয়েছি। বার্তা সেখানে উপস্থিত সমস্ত নেতাদের দেয়া বার্তা স্পষ্ট ছিল: আমরা ইউক্রেনের পাশে দাঁড়িয়েছি এবং যতক্ষণ প্রয়োজন ততক্ষণ আমরা তাদেরকে সমর্থন করব। এটি ন্যাটো মিত্রদের কাছ থেকে বার্তা,’ স্টলটেনবার্গ জার্মান টিভি চ্যানেলকে বলেছেন।
তবে তিনি বলেন, কিয়েভকে সামরিক সহায়তা প্রদান করা সহজ ছিল না। ‘আমি বলছি না এটি সহজ। এর জন্য কঠোর পরিশ্রমের প্রয়োজন। আমরা সমর্থন নিশ্চিত করতে যে, আমরা ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকায় জোটের অন্যান্য নেতাদের সাথে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ,’ জেডডিএফ ন্যাটো মহাসচিবকে উদ্ধৃত করে বলেছে। তিনি সেখানে জার্মানির উল্লেখযোগ্য অবদানের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, আশা করি জার্মান সরকার আরও কিছু করবে। স্টলটেনবার্গও সতর্ক করেছেন যে, আগামী শীত কঠিন হবে। ‘নিষেধাজ্ঞার ফলস্বরূপ ইউক্রেনের প্রতি আমাদের সমর্থনের মূল্য দিতে হবে এবং অবশ্যই রাশিয়া অস্ত্র হিসাবে জ্বালানি শক্তি ব্যবহার করে,’ তিনি সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, ‘তবে আমাদের অবশ্যই বুঝতে হবে যে আমাদের সমর্থনের বিকল্প নেই।’
যুদ্ধের মধ্যেই ইউক্রেনে স্বাধীনতা দিবস পালন : রুশ নেতৃত্বাধীন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা অর্জনের ৩১ বছর উদযাপন করেছে ইউক্রেন এমন সময়ে, যখন তাদের সেই রাশিয়ার বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করে যেতে হচ্ছে। এই বছর ইউক্রেনের স্বাধীনতা দিনটি এমন এক তারিখে উদযাপন করা হয়েছে, যেদিন দেশটিতে রাশিয়ার হামলারও ছয়মাস হচ্ছে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা শুরু করেছিল রাশিয়া।
ফলে এবার ইউক্রেনে স্বাধীনতা দিবস উদযাপিত হয়েছে অনেকটা ভীতি ও শঙ্কার মধ্যে। জলে, স্থলে বা আকাশপথে রাশিয়ার হামলার আশঙ্কায় রাজধানী কিয়েভে জনসমাগম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পূর্বাঞ্চলীয় খারকিভে কারফিউ জারি করা হয়েছে। রাশিয়ার যেকোনো হামলার ব্যাপারে নাগরিকদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদামির জেলেনস্কি। মঙ্গলবার ৬০টি দেশের প্রতিনিধি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যদের নিয়ে ক্রাইমিয়া বিষয়ক একটি অনলাইন সম্মেলনে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদামির জেলেনস্কি ঘোষণা দিয়েছেন, যেকোনো মূল্যে তারা পুরো উপদ্বীপ থেকে রাশিয়ান বাহিনীকে বিতাড়িত করবেন। সেজন্য আগে অন্য কোন দেশের সঙ্গে তারা পরামর্শও করবেন না। ইউক্রেনের সেনাবাহিনী জানিয়েছে, এই যুদ্ধে তাদের প্রায় আট হাজার সামরিক সদস্য নিহত হয়েছে।
ইউক্রেনের জন্য সবচেয়ে বড় সামরিক সহায়তার ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্রের : ইউক্রেনকে আরও ৩০০ কোটি ডলারের সামরিক সহায়তা দেয়ার ঘোষণা দিতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। একজন মার্কিন কর্মকর্তা মঙ্গলবার এ তথ্য জানিয়েছেন। ছয় মাসের ইউক্রেন যুদ্ধে এটি হবে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ একক নিরাপত্তা প্যাকেজের ঘোষণা। ওই মার্কিন কর্মকর্তা জানান, পেন্টাগনের ইউক্রেন নিরাপত্তা সহযোগিতা উদ্যোগের আওতায় এ অর্থ আসবে। ইউক্রেন এ তহবিল অস্ত্র ক্রয়, সামরিক প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য অভিযানের কাজে ব্যবহার করতে পারবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কর্মকর্তা বলেন, অস্ত্রের এই নতুন চালানে আগের সরবরাহ করা অস্ত্রের চেয়ে আলাদা অস্ত্র যুক্ত করা হচ্ছে না বলেই মনে করা হচ্ছে। তবে এ চালানে গোলাবারুদ এবং আরও মধ্যমেয়াদি প্রতিরক্ষাব্যবস্থার ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। ইউএসএআইয়ের অধীন অস্ত্রগুলো ইউরোপে আসতে কয়েক মাস সময় লাগতে পারে। কারণ, কোম্পানিগুলোকে এসব অস্ত্র কিনতে হবে। আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগে কোন কোন অস্ত্র এ চালানে থাকবে, তাতে পরিবর্তন আসতে পারে বলেও ওই কর্মকর্তা জানান। এর আগে গত শুক্রবার পেন্টাগন পিডিএ’র আওতায় ৭৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার মূল্যের বিভিন্ন ক্ষেপণাস্ত্র, কামান, সাঁজোয়া বিধ্বংসী অস্ত্র ও গোলাবারুদের পাশাপাশি সশস্ত্র মাইন অপসারণ যানবাহন বহরের সর্বশেষ প্যাকেজের ঘোষণা দিয়েছে। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইউক্রেনকে প্রায় এক হাজার কোটি ডলারের সহায়তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
সেভাস্তোপলের কাছে ইউক্রেনীয় ড্রোন ভূপাতিত : সমুদ্রে নিয়োজিত রাশিয়ান বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সেভাস্তোপলের কাছে একটি মনুষ্যবিহীন বিমান বিধ্বস্ত করেছে। গত মঙ্গলবার শহরটির গভর্নর মিখাইল রাজভোজায়েভ এ তথ্য জানিয়েছেন।
‘সমুদ্রে বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় রয়েছে। শত্রু পক্ষের একটি ড্রোন ভূপাতিত করা হয়েছে। বর্তমানে পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে,’ রাজভোজায়েভ তার টেলিগ্রাম চ্যানেলে লিখেছেন। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ক্রিমিয়া এবং সেভাস্তোপলে বেশ কয়েকবার হামলা হয়েছে। ৩১ আগস্ট পর্যন্ত শহরটিতে সন্ত্রাসীদের হুমকির জন্য ‘হলুদ সতর্কতা’ জারি করা হয়েছে।
এর আগে গত ২০ আগস্ট রাশিয়ান ব্ল্যাক সি ফ্লিট সদর দফতরে একটি ড্রোন হামলা চালানো হয়। তবে কেনো ধরনের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ড্রোনটি ভূপাতিত করতে সক্ষম হয়। সূত্র : রয়টার্স, বিবিসি নিউজ, তাস, এপি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন