বুধবার, ২২ মে ২০২৪, ০৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৩ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

আন্তর্জাতিক সংবাদ

সেনা ও সরকারের সাথে টক্কর, ইমরান খানের শক্তির উৎস কোথায়?

অনলাইন ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২৫ আগস্ট, ২০২২, ১:৪৭ পিএম

সন্ত্রাসের এক মামলার আসামী হিসাবে পাকিস্তানের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের আজ (বৃহস্পতিবার) ইসলামাবাদের একটি বিশেষ আদালতে হাজিরা দেয়ার কথা এবং তখন তাকে গ্রেপ্তার করা হয় কি-না, তা নিয়ে সেদেশে এখন টানটান উত্তেজনা।

গত শনিবার এক জনসভায় তার এক ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহযোগীকে আটক করে নির্যাতনের অভিযোগ তুলে পুলিশ প্রধান এবং একজন নারী বিচারকের বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দেন ইমরান খান। এর পরপরই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে হুমকি দেয়ার অভিযোগে পুলিশ তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে অভিযোগ দায়ের করে। সেই সাথে, বিচারককে হুমকি দেয়ার জন্য তার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হয়েছে - যার জবাব দিতে ইমরান খানকে আগামী ৩১শে অগাস্ট হাইকোর্টে হাজিরা দিতে হবে।

দু'টো অভিযোগই এমন গুরুতর যে ইমরান খান গ্রেপ্তার হতে পারেন। তার নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এবং তার দল পাকিস্তান তেহরীক-ই-ইনসাফের অস্তিত্ব হুমকিতে পড়ে যেতে পারে। ‘যেসব মামলা হয়েছে তাতে যেকোন সময় তাকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন লাহোরের সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক উমেইর জামাল। ‘তাকে আজীবনের জন্য সরকারি কোনও পদে নিষিদ্ধ করা হতে পারে। এমনকি তার দলকে নিষিদ্ধ করা হতে পারে।’

তবে প্রশ্ন হচ্ছে, এই মুহূর্তে গ্রেপ্তার বা চরম সেসব পথে পাকিস্তানের বর্তমান কোয়ালিশন সরকার এবং সেনাবাহিনী যাবে কিনা? কারণ, রাস্তায় ইমরানের পক্ষে যে জনসমর্থন দেখা যাচ্ছে, তাতে গ্রেপ্তার করা হলে দাঙ্গা-হাঙ্গামা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ইসলামাবাদে বিবিসির পামজা ফিলহানি বলছেন, ইমরান খানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের মামলা দেয়া নিয়ে কোয়ালিশন সরকারের মধ্যে মতভেদ তৈরি হয়েছে। সরকারের মধ্যে অনেকে ভয় পাচ্ছেন যে এই মামলায় তিনি গ্রেপ্তার হলে গণবিক্ষোভ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ছড়িয়ে পড়তে পারে, যা সামাল দেওয়া কঠিন হবে, এবং রাজনৈতিকভাবে ইমরান আরও শক্তি অর্জন করবেন, জানাচ্ছেন তিনি।

পাকিস্তানের রাজনীতিতে রাস্তায় সমর্থনের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। কট্টর ধর্মীয় নেতারা নির্বাচনে সাফল্য না পেলেও রাস্তায় লোক জড় করে সরকারকে সব সময় চাপে রাখেন। ইমরান খান এখন জনমনে তেমন আবেগ তৈরির ক্ষমতা অর্জন করেছেন বলে অনেক বিশ্লেষক বলছেন।

সেনাবাহিনীকে চ্যালেঞ্জ ইমরানের, পাকিস্তানের রাজনীতি কি তাহলে আবারও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে? লন্ডনে সোয়াস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং পাকিস্তান রাজনীতির বিশ্লেষক ড. আয়েশা সিদ্দিকা মনে করেন, এখন পরিস্থিতি যতটা না বিপজ্জনক তার চেয়ে অনেক বেশি ‘বিশৃঙ্খল এবং অনিশ্চিত।’ বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, এই পরিস্থিতির মূলে রয়েছে ইমরান খান এবং সেনা নেতৃত্বের মধ্যে দ্বন্দ্ব - ‘সুনির্দিষ্টভাবে আমি বলবো ইমরান ও সেনা প্রধানের (জেনারেল কামার রশিদ বাজওয়া) মধ্যে দ্বন্দ্ব।’

ইমরান খান দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন সেনাবাহিনীই তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়েছে এবং সে কথা গত তিন-চার মাস ধরে জনসমক্ষে খোলাখুলি তিনি বলে বেড়াচ্ছেন। সেই সাথে আমেরিকার প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে তিনি বলছেন যে তাদের কথা মতই সেনা নেতৃত্বের একাংশ একাজ করেছে। তার যে সহযোগীকে নির্যাতনের অভিযোগ ইমরান তুলেছেন সেই শাহবাজ গিল এ মাসেই এক লাইভ টিভিতে সেনা কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন যে তারা যেন তাদের সিনিয়রদের ‘অবৈধ’ নির্দেশ অমান্য করেন।

ইমরান খানের এসব বক্তব্য-বিবৃতি সেনা নেতৃত্ব আর সহ্য করতে রাজী নন বলেই স্পষ্ট হয়ে পড়ছে। ‘পাকিস্তানে সেনাবাহিনী সব সময় নিজেরা সরাসরি ক্ষমতায় না থাকলেও তারা সব সময় বলতে গেলে বেশ সহজেই রাজনীতিকদের বাগে রাখতে পেরেছে। অলিখিত সেই প্রথাকে চ্যালেঞ্জ করছেন ইমরান খান, এবং সেনাবাহিনী কোনওভাবেই তা মানতে পারছে না,’ বলেন আয়েশা সিদ্দিকা।

এপ্রিলে ক্ষমতা হারানোর পরও পাকিস্তানের অনেক রাজনীতিকের মত ইমরান খানকে সাথে সাথেই বড় কোন বিপদে পড়তে হয়নি। রাজনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে গেছেন তিনি। জনসভার পর জনসভা করেছেন যেখানে প্রচুর মানুষ হয়েছে। টিভি এবং অন্যান্য মিডিয়াতে নিয়মিত কথা বলতে পেরেছেন। সোশ্যাল মিডিয়াতে নিয়মিত বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে বলে চলেছেন যে তার সঙ্গে অন্যায় করা হয়েছে।

‘সেনাবাহিনী রাজনীতিতে তাকে জায়গা দিচ্ছিল। কিন্তু যখন তিনি সরাসরি তাদের চ্যালেঞ্জ শুরু করলেন, সেনা নেতৃত্ব মনে করছে ইমরান রেড-লাইন ভাঙছেন,’ বলেন সাংবাদিক উমেইর জামাল। ‘গত বেশ কিছুদিন ধরে বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে তাকে রাশ টানতে বলা হচ্ছিল, কিন্তু ইমরান তা গায়ে মাখেননি। সেনাবাহিনী আর ধৈর্য ধরতে রাজী নয় বলে মনে হচ্ছে।’ পাকিস্তানে সব সময়ই সেনাবাহিনী তাদের অবাধ্য রাজনীতিকদের শিক্ষা দিতে পুলিশ ও আদালতকে ব্যবহার করেছে। ইমরান খানের বিরুদ্ধেও সেই পুরনো অস্ত্র ব্যবহার শুরু হয়েছে তার ইঙ্গিত স্পষ্ট।

গত কয়েক সপ্তাহে তার বেশ ক’জন সহযোগীকে আটক অথবা হেনস্থা করা হয়েছে। ইমরানের সমর্থক বলে পরিচিতি কয়েকজন সাংবাদিকও হেনস্থার শিকার হয়েছেন। টিভিতে তার ভাষণের লাইভ প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহযোগী দেশদ্রোহ এবং অবৈধ অস্ত্রের মামলায় পড়েছেন। আর এখন ইমরান খান নিজেও সন্ত্রাস এবং আদালত অবমাননার অভিযোগের চক্করে পড়েছেন। ‘আমার মনে হয় সেনাবাহিনী এখনও চরম কোনও পথ না নিয়ে ভয় দেখিয়ে তাকে নিরস্ত করতে চাইছে,’ বলেন ড. আয়েশা সিদ্দিকা।

তবে ইমরান যে ভয় পেয়েছেন সে লক্ষণ এখনও নেই। তার দল পিটিআই সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে তাদের নেতাকে আটক করা হলে তা হবে ‘রেড-লাইন’ ভাঙার সামিল, এবং তারা গণবিক্ষোভ শুরু করবেন। পাকিস্তানে কোন রাজনীতিক বা রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে সেনাবাহিনীকে এভাবে খোলাখুলি চ্যালেঞ্জ করার নজীর নেই।

উমেইর জামাল বলেন, রাজনীতিক ইমরান খানকে তৈরিই করেছে সেনাবাহিনী, এবং তিনি নিজে মনে করেন সেনাবাহিনীর বিরাট অংশ এখনও তাকেই সমর্থন করে। ‘ইমরান খান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিজস্ব একটি প্রজেক্টের ফসল। তারা পাকিস্তান মুসলিম লীগ এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টির বাইরে তৃতীয় একটি রাজনৈতিক দল তৈরি করতে চেয়েছিল, যারা হবে তাদের একান্ত বিশ্বস্ত, অনুগত,’ বলেন মি. জামাল।

বাস্তবে তা না হলেও, এই সাংবাদিক এবং বিশ্লেষক মনে করেন যে ইমরান খানের ক্ষমতাচ্যুতি নিয়ে পাকিস্তানের ‘সামরিক এস্টাবলিস্টমেন্টের’ মধ্যে বিভেদ রয়েছে। অনেক সিনিয়র অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসার খোলাখুলি এর সমালোচনা করেছেন। এ বিষয়টি হয়তো ইমরান খানকে আত্মবিশ্বাসী করেছে। তিনি মনে করছেন যে শীর্ষ নেতৃত্বের বদল হলে তিনিই সেনাবাহিনীর সমর্থন পাবেন। চাকরির মেয়াদ না বাড়লে বর্তমান সেনাপ্রধান জে. বাজওয়ার নভেম্বরে অবসরে যাওয়ার কথা।

সেই সাথে, জনসমর্থনও ইমরান খানকে আত্মবিশ্বাসী করেছে বলে মনে করা হচ্ছে। জুলাইতে পাঞ্জাব প্রদেশের একটি আসনের উপ-নির্বাচনে - যে আসনটিকে মুসলিম লীগের অভেদ্য দুর্গ হিসাবে দেখা হতো - সেখানে পিটিআইয়ের নিরঙ্কুশ বিজয় পর্যবেক্ষকদের বিস্মিত করেছে। টুইটারে তার ফলোয়ারের সংখ্যা এক কোটি ৭০ লাখ। টিভিতে তাকে ব্লক করা হলেও বহু মানুষের কাছে তিনি বার্তা পৌঁছে দিতে সক্ষম।

উমেইর জামাল বলেন, বিশেষ করে পাঞ্জাব এবং খাইবার-পাখতুনখোয়ার মত গুরুত্বপূর্ণ দুই প্রদেশে ইমরানের সমর্থন যেভাবে বাড়ছে সেটিও সেনাবাহিনীতে হয়তো বিবেচনা করতে হচ্ছে।

‘এই দুটি প্রদেশ থেকে সেনাবাহিনীতে সবচেয়ে বেশি লোক নিয়োগ হয়। আবার জমি অধিগ্রহণ বা সম্পদের মালিকানা নিয়ে সেনাবাহিনীর ব্যাপারে এই দুই জায়গার বহু মানুষ ক্ষুব্ধ। ফলে সেনাবাহিনী এমন কিছু করতে চায় না, যাতে এই দুই প্রদেশের মানুষ নাখোশ হয়।’ সূত্র: বিবিসি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন