খোলাবাজারে ডলার বিক্রি হচ্ছে ১১৪ টাকায় : উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু দেখছেন না অর্থনীতিবিদরা
আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধির নানা উদ্যোগের পরেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমছে না। ডলার সঙ্কটের কারণে প্রতিদিনই রিজার্ভ থেকে ব্যাংকগুলোকে বৈদেশিক মুদ্রার (ডলার) জোগান দেওয়া হচ্ছে। গত এক বছরে সাড়ে ১১ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ কমেছে। গত বুধবার এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) জুলাই-আগস্টের আমদানির জন্য এক দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার বিল পরিশোধ করা হয়েছে। সেদিনই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ৫০ মিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সবমিলিয়ে আকুর বিল পরিশোধের পর রিজার্ভের পরিমাণ কমে দাঁড়াবে ৩৭ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক এখনও রিজার্ভ সমন্বয় করেনি। আগামী রোববার রিজার্ভ সমন্বয় করা হবে বলে জানা গেছে। প্রতি মাসে ৮ বিলিয়ন ডলার আমদানি ব্যয় হিসেবে মজুত এ বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে সাড়ে ৪ মাসের বেশি আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
তবে রিজার্ভ কমলেও এটাকে স্বাভাবিকই বলছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা। তাদের মতে, কোনো দেশে ৩ মাসের আমদানি ব্যয়ের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকা স্বস্তিদায়ক। সে হিসাবে আমাদের প্রায় ৫ মাসের রিজার্ভ আছে। আকুর বিল পরিশোদের পর রিজার্ভ কমে আসে এমনটা জানিয়ে এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, আকুর বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ প্রতিবারই কিছুটা কমে আসে। এবারও তাই হয়েছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, আমদানি কমছে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় বাড়ছে। এখন আর আমাদের রিজার্ভ কমবে না। বাড়তেই থাকবে। বাজারের চাহিদা মেটাতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির কারণে এই সূচক কমেছে বলেও জানান তিনি।
৪০ বিলিয়নের নিচে রিজার্ভ নেমে আসার পর থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দেয়। এখন ৩৭ বিলিয়নে পৌঁছায় এই উদ্বেগ আরও বেড়ে গেছে অনেকের মধ্যে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অর্থনীতির গবেষক ড. আতিউর রহমান এখনই উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু দেখছেন না। তিনি বলেন, বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে রিজার্ভ ৩৭ বিলিয়ন ডলারে নামলেও কোনো সমস্যা নেই। কেননা, আমদানি কমছে। বর্তমানের এই রিজার্ভ দিয়ে ছয় মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। অন্যদিকে রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় বাড়ছে। এ অবস্থায় আগামী দিনগুলোতে রিজার্ভ বাড়বে বলেই মনে হচ্ছে।
এদিকে, সরকারি প্রকল্প ও নিত্যপণ্যের আমদানি বিল পরিশোধের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো কাছে কেন্দ্রীয় রিজার্ভ থেকে ৯৫ টাকা দরে ৫০ মিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে রিজার্ভের পরিমাণ নেমে আসে ৩৮ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলারে। সেখান থেকে এক দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলারের আকু পেমেন্টের জন্য বিল পরিশোধ করা হয়। সে হিসাবে বুধবার থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ৩৭ দশমিক ২০ বিলিয়ন হতে যাচ্ছে।
অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ২০২১ সালে রিজার্ভ বেড়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল। গত অর্থবছরের শেষের দিকে রিজার্ভ নেমে আসে ৪২ বিলিয়ন ডলারে। এরপর গত ২০ জুলাই পর্যন্ত রিজার্ভ ৩৯ দশমিক ৮০ বিলিয়ন থেকে ৪০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ওঠানামা করে। জুলাই শেষে তা কমে ৩৯ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তঃব্যাংকে শুধু সরকারি জ্বালানি ও জরুরি খাদ্য আমদানির দায় মেটানোর ক্ষেত্রেই প্রতি ডলার ৯৫ টাকা দামে বিক্রি করছে। যেটা আগে ছিল ৮৬ টাকা। এখান থেকে এক টাকা বেশি দরে গ্রাহকের কাছে ডলার বিক্রি করতে পারবে ব্যাংকগুলো। কিন্তু ব্যাংকগুলোতে আন্তঃব্যাংক দামে কোনো ডলার লেনদেন হচ্ছে না।
ব্যাংকগুলো বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স আহরণ করতে প্রতি ডলারের জন্য ১০৪ থেকে ১০৭ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করছে। কিন্তু রফতানিকারকদের কাছ থেকে অপেক্ষাকৃত কম দামে অর্থাৎ প্রতি ডলার ১০০ টাকার নিচে সংগ্রহ করছে। যেগুলো রফতানি বিল নগদায়নে ১০১ থেকে ১০৩ টাকা দিতে হচ্ছে। এভাবে বিভিন্ন দরে ডলার কিনে ব্যাংকগুলো দাম সমন্বয় করছে। অন্যদিকে মতিঝিল, ফকিরাপুল ও পল্টন এলাকায় খোলা বাজারে (খুচরায়) ডলার বিক্রি হচ্ছে ১১৩ থেকে ১১৪ টাকার মধ্যে। মাঝে নিয়ন্ত্রণে থাকলেও টানা দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে লাগামহীনভাবে দর বাড়ছে ডলারের।
অন্যদিকে রেমিট্যান্সে নানা ছাড় ও সুবিধা দেওয়ায় ইতিবাচক সাড়া মিলছে। চলতি বছরের সদ্য বিদায়ী মাস আগস্টে ২০৩ কোটি ৮০ লাখ ডলারের (২ হাজার ৩৮ মিলিয়ন ডলার) রেমিট্যান্স এসেছে। গত বছরের আগস্টে এসেছিল ১৮১ কোটি ডলার (১ হাজার ৮১০ মিলিয়ন ডলার)। সে হিসাবে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় রেমিট্যান্স বেড়েছে ১২ দশমিক ৬০ শতাংশ। চলতি বছরের জুলাই মাসে এসেছিল ২০৯ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স। সে হিসাবে জুলাই অপেক্ষা আগস্টে প্রায় ৬ কোটি ডলার রেমিট্যান্স কম কমেছে।
২০২২-২০২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে জুলাই ও আগস্টে মোট রেমিট্যান্স এসেছে ৪১৩ কোটি ৪০ লাখ ডলারের। যা তার আগের অর্থবছরের (২০২১-২২) চেয়ে ১২ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি। ২০২১-২০২২ অর্থবছরের জুলাই ও আগস্ট মাসে রেমিট্যান্স এসেছিল ৩৬৮ কোটি ২০ লাখ ডলার।
২০২১-২০২২ অর্থবছরে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে মোট দুই হাজার ১০৩ কোটি ১৭ লাখ (২১ দশমিক ৩ বিলিয়ন) মার্কিন ডলারের রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছিলেন। যা আগের অর্থবছরের (২০২০-২০২১) চেয়ে ১৫ দশমিক ১১ শতাংশ কম। ২০২০-২১ অর্থবছরে দুই হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ (২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন) ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন বিভিন্ন দেশে কর্মরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন