মুফতি আনিসুর রহমান জাফরী : হেমন্তের বিদায়ক্ষণে শীত বরণের প্রস্তুতি চলছে প্রকৃতিতে। শীতও যেন প্রস্তুত সবাইকে ‘হিম’ চাদরে জড়িয়ে নিতে। ভোরের ‘শীত শীত’ আবহাওয়া আর বিকেলের ঝিরঝির ঠান্ডা বাতাস অন্তত এ ইঙ্গিতই দিচ্ছে আমাদের। হেমন্তের ঝিরঝির বাতাস শীতের আগমনী বার্তার সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি বিষয়ও জানান দিচ্ছে, যা শুধু জাগ্রত কানের অধিকারী মানুষই শুনতে পায়। যুগ যুগ ধরে জাগ্রত কানওয়ালারাই হেমন্তের আহ্বানে সাড়া দিয়ে শীত যাপনের মোহনীয় প্রস্তুতি নিয়েছেন।
হেমন্তরে শিশির ¯œাত সকাল কিংবা ঝিরঝির বাতাসের বিকেল আমাদের কাছে শুধুই শীতের আগমনী বার্তা বা ঋতু বৈচিত্র্যের নিদর্শন। কিন্তু ‘রুহ জাগ্রত’ মানুষদের কাছে তা অফুরন্ত ইবাদতের আহ্বান। তাইতো আল্লাহ প্রেমিকেদর কাছে কাছে রমজানের পর ইবাদতের উত্তম মৌসুম হলো শীতের দিনগুলো। রাসুল (সা.) এর ভাষায়- ‘শীত হলো মুমিনের বসন্তকাল’ (মুসনাদে আহমাদ)। হজরত ওমর (রা.) এর ভাষায়- ‘শীত মুমিনের গনীমত’। ওমর (রা.) এর কথার সমর্থন পাওয়া যায় স্বয়ং রাসুল (সা.) এর বাণীতেও। তিনি (সা.) বলেছেন, ‘শীতের গনীমত হলো দিনে রোজা রাখা’ (তিরমিজি)। অন্য বর্ণনায় রাসুল (সা.) আরো বলেছেন, ‘শীতের রাতগুলো বড় হওয়ায় দীর্ঘ সময় নামাজে কাটানো যায়। আর দিন ছোট হওয়া বেশি বেশি নফল রোজা রাখা যায় (বায়হাকী)। ইমাম গাজালী (রহ.) লেখেন, ‘আল্লাহর মাহবুব বান্দাদের জন্য শীতকালের চেয়ে প্রিয় কোনো সময় আছে কিনা আমার জানা নেই। কারণ শীতের দিনগুলো ছোট থাকে আর রাতগুলো বড় হয়। তাই দিনে রোজা রাখা আর রাতে নামাজে দাঁড়িয়ে থাকা সহজ হয় (কিমিয়ায়ে সা’আদাত)।
প্রিয় নবী (সা.) এর মতো সাহাবিরাও শীতকে ইবাদতের মৌসুম হিসেবে গ্রহণ করতেন। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) তো রীতিমত শীতের গীত গাইতেন আর বলতেন- ‘হে প্রিয় ঋতু শীত! তোমাকে স্বাগতম!’ তিনি আরো বলতেন, ‘শীতে আল্লাহর রহমত নাজিল হয়। কারণ এ সময় বেশি বেশি নফল নামাজ এবং নফল রোজা পালন করা যায়।’ হজরত উবাইদ ইবনে উমাইর (রা.) বলতেন, ‘হে কোরআনের অনুসারীরা শোন! শীত এসে গেছে। তোমাদের জন্য রাত বড় এবং দিন ছোট করা হয়েছে। অতএব রাতে কোরআন তেলাওয়াত করো এবং দিনে রোজা রাখ।’ হজরত মুআজ ইবনে জাবাল (রা.)কে মৃত্যুর সময় কাঁদতে দেখে কোনো একজন জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি মৃত্যুর ভয়ে কাঁদছেন হে মুয়াজ!’ তিনি (রা.) বললেন, না। আমি মৃত্যুভয়ে কাঁদছি না। শীতের রাতে নফল নামাজে দাঁড়াতে পারব না এই দুঃখে কাঁদছি।’
প্রিয় পাঠক! ‘মুমিনের বসন্ত’ শীত আসছে। আমাদেরকে প্রস্তুত হতে হবে, প্রস্তুতি নিতে হবে। ইবাদতের জন্য। মানবসেবার জন্য। শীতের আগেই যেন দরিদ্র ও অসহায় মানুষের হাতে শীত বস্ত্র পৌঁছে দিতে পারি এ বিষয়ে বিত্তশালীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। প্রতি বছরই শীতের প্রকোপ মারত্মক আকার ধারণ করলে পরে ‘মানুষ মানুষের জন্য’ স্লোগান ওঠে। এবার যেন শীতের কারণে কোন আদম সন্তানকেই দুর্ভোগ পোহাতে না হয়- এ ব্যাপারে সবাইকে সচেতন ও সজাগ হতে হবে।
আসন্ন শীতে বেশি বেশি নফল ইবাদত করে মহান মাবুদের প্রিয় বান্দা হওয়ার সুযোগ যেন হেলায় ফেলায় নষ্ট না হয়। মাবুদের ভালোবাসার পাত্র হওয়ার সুযোগ কাজে লাগাতে পারলেই আমরা ‘আল্লাহ প্রেমিক বান্দা’ হতে পারব। হতে পারব জাগ্রত কানের অধিকারী। যে কান বুঝতে পারবে হেমন্তের ঝিরঝির বাতাসের সুর, গ্রীষ্মের পাতার মরমর গান আর শীতের পত্র-পল্লবহীন গাছে ফিরে আসা রহস্যময় প্রাণের মাহাত্ম্য।
ষ লেখক : পরিচালক, মুুহিউস সুন্নাহ ক্যাডেট মাদরাসা ও খতিব, ইছা-বকর জামে মসজিদ কমপ্লেক্স, ডগাইর, ডেমরা, ঢাকা
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন