যে কোনো কিছুর নকল জিনিস বলতে এক সময় বলা হতো ‘মেড ইন জিঞ্জিরা’। এই বাক্য এখন আর ঢাকা জেলার কেরাণীগঞ্জের মধ্যে আটকে নেই। রাজধানীসহ দেশের অনেক জায়গায় চলছে নকলের রমরমা কারবার। অবস্থা অনেকটা এমন হয়েছে যে নকলের চাপে রীতিমত আসল কোনঠাসা হয়ে পড়েছে। ক্রেতারা আসল জিনিস হাতে নিয়ে সন্দেহেরে চোখে দেখেন। বিক্রেতার কাছে জানতে চান, ‘এটি তো আসল’?
নকল জিনিস তৈরির পাশাপাশি কারখানাও নকল হয়ে গেছে। আর নকল কারখানার খোঁজ পেয়ে প্রায়ই থানা, গোয়েন্দা ও সিআইডি পুলিশ অভিযান পরিচালনা করে। তবে বিস্ময়কর ঘটনা হচ্ছে নকল কারখানায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তিনটি পরিচয়ে যারা অভিযান পরিচালনা করে তারা আদৌ পুলিশ নয়। রাজধানীর নয়াপল্টন এলাকায় পলওয়েল মার্কেট থেকে পুলিশের পোশাকসহ অন্যান্য জিনিসপত্র কিনে ‘আসল’ সেজে অভিযানে নামে।
সব কিছুরই নকল কারখানা গড়ে উঠেছে। জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, শিশু খাদ্য, ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী থেকে প্রসাধনী সবই নকল হচ্ছে। আর এসব কারখানা গড়ে উঠেছে খোদ রাজধানীতেই প্রশাসনের নাকের ডগায়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার চোখে এগুলো ধরা না পড়লেও এসব অবৈধ কারখানায় নিয়মিত হানা দেয় ভূয়া পুলিশ। কখনো কখনো ভুয়া ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে ওইসব কারখানায় ভ্রাম্যমাণ আদালত চালায় তারা।
ইনকিলাবের অনুসন্ধানে জানা গেছে, নকল কারখানা থেকে নকল পুলিশ ও নকল ভ্রাম্যমাণ আদালত মোটা অঙ্ক পেলেই আবার ফিরে যায়। এসব ভুয়া পুলিশ নিজেদের পকেট ভারি করছে। আর নকল কারখানার মালিকদের কারনে ভোক্তা সাধারণও হচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্ত। নকল শিশু খাদ্য কারখানার কারনে সর্বনাশ হচ্ছে আগামী ভবিষ্যত। মাঝে মধ্যে এসব ভুয়া পুলিশ ধরা পড়লেও অদৃশ্য ‘খুঁটির’ জোরে অল্প সময়েই জামিনে বেরিয়ে আসে। শুরু করে একই ধরনের প্রতারণা।
গত বছরের ৮ ডিসেম্বর র্যাব জুরাইন রেল লাইন সংলগ্ন একটি নকল কারখানায় অভিযানের প্রস্তুতিকালে র্যাব-১০ এর একটি টিম গ্রেফতার করে প্রতারক জসিম উদ্দিনকে। তার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় র্যাবের জ্যাকেট, ওয়াকিটকি, হ্যান্ডকাপ ও খেলনা পিস্তল। এ ঘটনায় তৎকালীন র্যাব ১০ এর এসআই ইসমাইল হোসেন বাদী হয়ে শ্যামপুর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। শ্যামপুর থানার ওসি মফিজুল আলম ইনকিলাবকে জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে মামলার চার্জশিট আদালতে দাখিল করা হয়েছে।
ওই ঘটনার কিছুদিন পর চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি জুরাইন বিক্রমপুর মার্কেটের পেছনে রুবেলের শিশু খাদ্যের নকল কারখানায় র্যাবের পোশাক পরে একইভাবে চাঁদবাজি করে জসিম উদ্দিন। ভুক্তভোগী এ ব্যাপারে আদালতে মামলা করেন। মামলার তদন্ত পায় পিবিআই। পিবিআইয়ের তদন্ত কর্মকর্তা গতকাল ইনকিলাববে জানান, মামলাটির তদন্ত শেষে প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে।
২০১৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি কদমতলি থানার ১৪৩৯, পাটেরবাগ ভবনের ছয় তলায় অভিযান চালায় সিআইডির একটি টিম। ওই সময় সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ নকল শিশুখাদ্য জব্দ করে সিআইডি। উদ্ধার করা শিশু খাদ্যের মধ্যে ছিলো ডেইরি মিল্ক, চকো চকো, গুড়া দুধ, বিভিন্ন ধরনের চকলেটসহ শিশুদের প্রিয় খাবার। সিআইডির তেজগাঁও ইউনিটের তখনকার ইন্সপেক্টর শরীফুল ইসলাম বাদী হয়ে কদমতলী থানায় মামলা দায়ের করেন। নকল কারখানা থেকে শ্রমিক সোহাগ রানা, রবী হোসেন, সোহাগ মিয়া ও বেল্লাল হোসেনকে গ্রেফতার করে সিআইডি। রহস্যজনকভাবে পলাতক থাকে প্রতিষ্ঠানটির মালিক। জানা গেছে, ওই প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়মিত টাকা নিত ভুয়া পুলিশ সিন্ডিকেট। মালিকের সাথে টাকা পয়সা নিয়ে ঝামেলা হলে ভুয়া পুলিশ চক্রই নকল কারখানা মালিককে শিক্ষা দিতে সিআইডিকে দিয়ে অভিযান করায়।
একই বছরের নভেম্বরে কদমতলীর জিয়া স্মরণী রোডের আহাম্মদাদিয়া ডেন্টাল ক্লিনিকে সিআইডি পরিচয়ে মোবাইল কোর্ট চালায় প্রতারকচক্র। শেষে ক্লিনিকটির মালিক শামসুল আরেফিনের কাছে ২ লাখ টাকা দাবি করে চক্রের সদস্যরা। এক পর্যায়ে শামসুল আরেফিনসহ আশপাশের লোকদের সন্দেহ হলে প্রতারকচক্রকে চ্যালেঞ্জ করে। অবশেষে আসল পুলিশের হাতে ধরা পড়ে রফিকুল ইসলাম নামে ভুয়া পুলিশের এক সদস্য। শাহীন ও জামালসহ অজ্ঞাতরা কৌশলে মাইক্রোবাস নিয়ে পালিয়ে যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পুরান ঢাকা এবং ঢাকার আশপাশ ঘিরে গড়ে উঠেছে হাজারো নকল কারখানা। এর সঠিক সংখ্যা জানা নেই কোনো সংস্থার কাছেই। ছোটখাটো একটি রুমে তৈরি হয় বিভিন্ন ধরনের শিশু খাদ্য। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, কদমতলীর বরইতলা, শ্যামপুরের জুরাইন, পুরান ঢাকার লালবাগ, সিক্কাটুলী এলাকায় শত শত নকল কারখানা রয়েছে। মাতুয়াইলে রয়েছে নকল রাধুনী ‘ঘি’-এর কারখানা। এলাকাবাসী জানিয়েছে, ওইসব এলাকার শত বাড়ির ২০টির মধ্যেই রয়েছে কোনো না নকল কারখানা। ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক্স নকল কারখানা থেকে পুলিশ নিয়মিত মাসোহারা নেয়। ভুয়া পুলিশ নেয় চাঁদা। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ভুয়া পুলিশ সিন্ডিকেটের সাথে প্রশাসনের এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তার সম্পর্ক রয়েছে। ভুয়ারাই আসলদের সাথে ‘লেনদেনের’ বিষয়টির সমন্বয় করিয়ে দেয়।
ভুয়ারা আসলকে টেক্কা দিয়ে তাদের টার্গেট অনুযায়ী কাজ করে চলেছে। তারা নকল গ্রেফতারি পরোয়ানা তৈরি করে পুলিশ পরিচয়ে আসামি ধরতে গিয়ে মোটা অঙ্কের টাকাও হাতিয়ে নিচ্ছে। সম্প্রতি এমন অভিযোগে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানা পুলিশের হাতে এক প্রতারখ গ্রেফতার হয়েছে। আবার ভুয়া পুলিশ ক্লিয়ারেন্স দিয়ে টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনাও ঘটছে। অভিজ্ঞ মহলের মতে, এসব নকল কারখানা উচ্ছেদের পাশাপাশি ভুয়া পুলিশ চক্রকে দ্রুত গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা না হলে এর দীর্ঘমেয়াদি ভোগান্তি পোহাতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন