সাগর বেষ্টিত উপকূলে প্রাকৃতিক বৈরিতা, ঝড়-জলোচ্ছাস, বন্যা আর বিক্ষুব্ধ সাগরের উত্তাল তরঙ্গের সঙ্গে প্রতিনিয়ত জীবন বাজী রেখে যুদ্ধ করে বাঁচতে হচ্ছে ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার মেঘনা ও তেতুলিয়া নদীর বেড়িবাঁধ এলাকার ৫০ হাজার পরিবারের। সৃষ্ট দুর্যোগ ও বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাকগুলো যেন নিত্যদিনের সঙ্গী। বাপ-দাদার ভিটে মাটি জমি-জমার স্মৃতি বিজড়িত জন্মস্থানের মায়া মমতা আখরে ধরে এসব পরিবার বেড়িবাঁধের ঢালে দীর্ঘদিন বসবাস করে আসছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড পর্যায়ক্রমে উপজেলা প্রায় ১শ’ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ করলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিভিন্ন এলাকায় ১৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সংস্কার না হওয়ায় উপকূলের প্রায় ৫০ হাজার পরিবারের দেড় লাখ মানুষ ঝুঁকিতে রয়েছেন।
ভোলা পানি উন্নয়ন বোর্ড (ডিভিশন-২) এর নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয় থেকে জানা গেছে, ভোলার চরফ্যাশন উপজেলায় মূল ভুখন্ডে ৮৫ কিলোমিটার ও চরকুকরি-মুকরি এবং মুজিবনগর ইউনিয়নে আরও ২০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের কাজ চলমান রয়েছে।
কুদ্দুছ মাঝি (৬৫) তেতুলিয়া নদীরপাড়ের বসতি পাল্টানো বাসিন্দা। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তিনি সাক্ষী হয়েছেন অনেক ভাঙাগড়ার দৃশ্যপটের। তেতুলিয়া নদী ভাঙনের ঘটনার বিবরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘খড়-কুটোর ঘর, গবাদি পশু, চাষের জমি, এমনকি পরিবার ও জীবনসহ সবকিছুই বিপদের মুখে রেখে বসবাস করতে হয় নদীর তীরের মানুষদের। কত ঝড়-বন্যা আর ভাঙন আমাদের নিত্যসঙ্গী। ভাঙনে ধরা গ্রামের মানুষগুলোর বারবার বসত পাল্টাতে হয়। এমনিতেই গরিব, তার ওপর আবার বসতভিটা, চাষের জমি, থাকার ঘরও খোয়া যায় নদী ভাঙনে। এখন কোন রকমে ঝুপড়ি ঘরে বসবাস করছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়ি বাঁধের পাশে।
মেঘনা পাড়ের সালাম মাঝি (৫৫) জানান, তিনি বসত পাল্টানো বাসিন্দা। নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। তিন একর জমির ওপর বাপ দাদার বাড়ি ছিল। মেঘনা নদীর ভাঙনে এখন সব হারিয়ে সর্বশান্ত। বাড়ির সকলেই নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত। বারবার নদী ভাঙনে সর্বশান্ত হয়ে এখন জমি কেনার সামর্থ্য নেই। তিনি এখন বসবাস করছেন অন্যের আশ্রিত জমিতে।
মেঘনা ও তেতুলিয়ার ভাঙনে সালাম মাঝি ও কুদ্দুছ মাঝির মত ৫০ হাজারের অধিক পরিবার সর্বশান্ত হয়েছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব ক্ষতিগ্রস্থ পরিবার বর্গের তালিকা করে সরকারিভাবে আর্থিক সহায়তা করেছেন। এই টাকা দিয়ে ক্ষতিগ্রস্থরা কোন রকম ঘর করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছেন। তারা অনেকেই স্থায়ীভাবে পুনর্বাসনের দাবি করেছেন।
চরফ্যাশন উপজেলা চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদিন আখন বলেন, ডেউয়ের তোরে ভাঙন কবলিত বেড়িবাঁধ মেরামতে ইতোমধ্যে স্থানীয় সংসদ সদস্য আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব চরফ্যাশনের দুই তৃতীয়াংশ এলাকার বেড়িবাঁধ দিয়ে নদী ভাঙন রোধ করেছেন। ভাঙন কবলিত বেড়িবাঁধ মেরামতের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে নির্দেশ দিয়েছেন। এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
এ প্রসঙ্গে ভোলা পানি উন্নয়ন বোর্ড, ডিভিশন-২ (চরফ্যাশন) এর নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান মাহমুদ বলেন, ‘চরফ্যাশন উপজেলায় নদী ভাঙন রোধে মেঘনা ও তেতুলিয়া নদীর তীর রক্ষায় প্রায় ৮৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে এবং চর কুকুরি-মুকুরি ও মুজিবনগরে ২০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। কয়েকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগে নদীর তীব্রতায় বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ১৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সংস্কারের অভাবে অরক্ষিত রয়েছে। এর মধ্যে বেতুয়া ২ কিলোমিটার, বাবুরহাট ২ কিলোমিটার, গাছির খাল ১ কিলোমিটার, ঘোষেরহাট থেকে কাশেম মিয়া বাজার ২ কিলোমিটার, মুজিবনগর এলাকায় ৬ কিলোমিটার বেড়িবাঁধাহীন রয়েছে। বেড়িবাঁধ মেরামতের বরাদ্দের জন্য প্রক্রিয়া চলছে, বরাদ্দ পাওয়া গেলে বর্ষা শেষে ওইসব এলাকায় বালুভর্তি জিওব্যাগের মাধ্যমে বেড়িবাঁধ সংস্কার করার ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন