বিশ্ব মানবতার মুক্তিরদূত পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। আল্লাহপাক তাঁকে ‘রাহমাতুল লিল আলামীন’ তথা জগতের জন্য রহমত হিসেবে সৃষ্টি করেন। পৃথিবীতে তাঁর আগমন ছিল পৃথিবীবাসির জন্য আশির্বাদ স্বরূপ। পৃথিবী হতে সকল প্রকার জাহেলিয়াত বর্বরতা অমানবিকতা অনৈক্য শ্রেণি বিভেদ দূর করে সম্প্রীতি ও ভালোবাসার সমাজ বিনির্মানে তাঁর তুলনায় দ্বিতীয়জন আর নেই। তাঁর বিকল্প হওয়াও জগতের কারো পক্ষে কখনো সম্ভব নয়। সাইয়েদুল মুরসালিন খ্যাত এ মহামানবের চরিত্রসুষমায় স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মুগ্ধ। পবিত্র কোরআনে মাজীদে তার চারিত্রিক মাধুর্য বর্ণিত হয়েছে এমর্মে ‘নিশ্চয় আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী। (সুরা আল ক্বালাম: আয়াত: ৪)। তিনি মহান রবের কুল মাখলুকাতের নিকটও পরম প্রিয় প্রেমময় ও অনুসরনীয় আদর্শ ছিলেন। তাঁর জগতে আগমনই ছিল চারিত্রিক পরিপূর্ণতা সাধনের জন্য। এ বিষয়টি স্বয়ং তাঁর জবানে উল্লখ হয়েছে সুন্দর বর্ণনায়, তিনি বলেন, ‘ইন্নামা বুইসতু লে উতাম্মিমা মাকারিমুল আখলাক’ ‘অর্থ্যাৎ আমি তো প্রেরিত হয়েছি উত্তম চরিত্রের পরিপূর্ণতা সাধনের জন্য’ (কানযুল উম্মাল)।
অসভ্য বর্বর ও পথভ্রষ্ট জাতিকে সভ্যতায় ফিরিয়ে আনার জন্য আল্লাহপাক নবী রাসুলগণকে স্বজাতির নিকট প্রেরণ করেন। তাঁরা তাদের দাওয়াতি মিশনের মাধ্যমে জাতিকে আলোকিত সভ্যতার পথে ফেরান। যুগে যুগে অবিশ্বাসী খোদাদ্রোহি শক্তি সর্বোতভাবে সর্বপ্রকার প্রচেষ্টায় নবীগণের চরিত্রে এবং তাঁদের রেখে যাওয়া আদর্শে কালিমা লেপনের ঘৃণ্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। কিন্তু বাতিলের এ স্বপ্নসাধ কখনো বাস্তবায়িত হয়না। নবী রাসুলগণ আল্লাহর পক্ষ থেকে মানবজাতির প্রতি শ্রেষ্ঠ হাদিয়া, তাঁরা হলেন জাহালাতের ঘোর অমানিশা দুরীকরণে সর্বশ্রেষ্ঠ আলোকবর্তিকা, কোরআনের ভাষায় ‘সিরাজাম মুনিয়া’। স্বজাতিকে তাঁরা সুসংবাদ দান করেন, আল্লাহর আযাব ও গজবের ব্যাপারে সতর্কও করেন। পবিত্র কোরআন নবী রাসুলগণকে এজন্য ‘বাশিরাও ওয়া নাযিরা’ খেতাবে ভূষিত করেছে।
বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.) যখনই একত্ববাদের, রেসালাতের প্রচার শুরু করলেন, সাদা কালোর প্রভেদ দূরীকরণে উদ্যোগ নিলেন, সাম্য সম্প্রীতি ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করলেন ঠিক তখন কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী তাঁর বিরুদ্ধাচারণ শুরু দিল। তাঁকে ও তাঁর আনীত শ্রেষ্ঠ ধর্মের অবমাননা শুরু করে দিলো। তাঁকে মানসিক শারীরিক নির্যাতন শুরু করে দিল। তাঁর অনুসারীদেরকে অমানুষিক অমানবিক নির্যাতন শুরু করে দিল। রাসুলের যমানার সেই বিরোধীদের প্রেতাত্মা আজ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তারাই বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে রাসুল (সা.) এর অবমাননা, পবিত্র ইসলামের অবমাননা, পবিত্র কোরআনের অবমাননা, আলেম ওলামাদেরকে কলুষিত করণের কুৎসিত ও ঘৃণ্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়। ওলামায়ে কেরামের সতর্ক প্রতিবাদের কারণে ঐ চক্রটি তাদের কৌশল বদলায়। কিছুদিন পরপর তারা তাদের নোংরা খেলায় মেতে উঠে।
পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহয় বিশ্বনবী (সা.) এর অবমাননার পরিণতি বা পরিণাম সম্পর্কে অসংখ্য বর্ণনা এসেছে। পবিত্র কোরআন মাজিদে এ প্রসঙ্গে আল্লাহপাক বলেন, ‘আর যে ব্যক্তি তার সামনে হেদায়েত স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পরও রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করবে, আমি তাকে সে পথেই ছেড়ে দেবো, যা সে অবলম্বন করেছে। আর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব, যা অতি মন্দ ঠিকানা।’ (সূরা নিসা : ১১৫)। আল্লাহপাক আরো বলেন, ‘যারা আল্লাহ ও তার রাসুলের বিরুদ্ধে দুশমনিতে লিপ্ত হয় এবং পৃথিবীতে অশান্তি ও বিপর্যয় সৃষ্টির পাঁয়তারা করে, তাদের শাস্তি কেবল মৃত্যুদন্ড, শূলিবিদ্ধ করে হত্যা কিংবা হাত পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলা অথবা নির্বাসিত করা (কারাগারে নিক্ষেপ করা)। এ তো হল তাদের পার্থিব অপমান। আর পরকালেও তাদের জন্য অপেক্ষা করছে মর্মন্তুদ শাস্তি। (সুরা মায়েদা: আয়াত : ৩৩)।
আল্লাহপাক বলেন, ‘আর তাদের মধ্যে কেউ কেউ নবীকে ক্লেশ দেয়, এবং বলে, এ লোকটি তো কানসর্বস্ব। আপনি বলে দিন, কান হলেও তোমাদেরই মঙ্গলের জন্য, আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখে এবং বিশ্বাস রাখে মুসলমানদের কথার উপর। বস্তুতঃ তোমাদের মধ্যে যারা ঈমানদার তাদের জন্য তিনি রহমতবিশেষ। আর যারা আল্লাহর রসূলের প্রতি কুৎসা রটনা করে, তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক আযাব। তোমাদের সামনে আল্লাহর কসম খায় যাতে তোমাদের রাযী করতে পারে। অবশ্য তারা যদি ঈমানদার হয়ে থাকে, তবে আল্লাহকে এবং তাঁর রসূলকে রাযী করা অত্যন্ত জরুরী। তারা কি একথা জেনে নেয়নি যে, আল্লাহর সাথে এবং তাঁর রসূলের সাথে যে মোকাবেলা করে তার জন্যে নির্ধারিত রয়েছে দোযখ; তাতে সব সময় থাকবে। এটিই হল মহা-অপমান। মুনাফেকরা এ ব্যাপারে ভয় করে যে, মুসলমানদের উপর না এমন কোন সূরা নাযিল হয়, যাতে তাদের অন্তরের গোপন বিষয় অবহিত করা হবে। সুতরাং আপনি বলে দিন, ঠাট্টা-বিদ্রæপ করতে থাক; আল্লাহ তা অবশ্যই প্রকাশ করবেন যার ব্যাপারে তোমরা ভয় করছ। আর যদি তুমি তাদের কাছে জিজ্ঞেস কর, তবে তারা বলবে, আমরা তো কথার কথা বলছিলাম এবং কৌতুক করছিলাম। আপনি বলুন, তোমরা কি আল্লাহর সাথে, তাঁর হুকুম আহকামের সাথে এবং তাঁর রসূলের সাথে ঠাট্টা করছিলে? ছলনা কর না, তোমরা যে কাফের হয়ে গেছ ঈমান প্রকাশ করার পর। তোমাদের মধ্যে কোন কোন লোককে যদি আমি ক্ষমা করে দেইও, তবে অবশ্য কিছু লোককে আযাবও দেব। কারণ, তারা ছিল গোনাহগার। (সুরা তাওবাহ: আয়াত: ৬১-৬৬)। আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনের অন্যত্র বলেন, ‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলকে কষ্ট দেয়, আল্লাহ তাদের প্রতি ইহকালে ও পরকালে অভিসম্পাত করেন এবং তাদের জন্যে প্রস্তুত রেখেছেন অবমাননাকর শাস্তি। (সুরা আহযাব: আয়াত: ৫৭)।
আল্লামা ইবনে কাসির (রহ:) ‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ গ্রন্থে ইমাম বুখারি (রহ:)এর সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসূল (সা:) আবু রাফেকে হত্যা করার জন্য বেশ ক’জন আনসারি সাহাবিকে নির্বাচিত করলেন এবং হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আতিককে তাঁদের দলপতি নিয়োগ করলেন। আবু রাফে রাসূল (সা:) কে কষ্ট দিত এবং এ কাজে অন্যদের সহযোগিতা করত। মুজাহিদ (রহ:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ওমর (রা:) এর দরবারে এমন এক ব্যক্তিকে আনা হলো, যে রাসূল (সা:) কে গালি দিয়েছে। ওমর (রা:) তাকে হত্যা করেন। অতঃপর বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালা বা কোনো নবীকে গালি দেবে তোমরা তাকে হত্যা করো।’ (আসসারিমুল মাসলুল : ৪/৪১৯) আমর (রহ:) বলেন, আমি জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা:) থেকে শুনেছি, তিনি বলেন, রাসূল (সা:) বললেন, কে আস কাব ইবনে আশরাফের জন্য (অর্থাৎ তাকে হত্যা করতে পারবে? কেননা, সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা:) কে কষ্ট দেয়। তখন সাহাবি মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা দাঁড়ালেন; তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমি তাকে হত্যা করব, আপনি কি তা পছন্দ করেন? নবী (সা:) বললেন, হ্যাঁ, তিনি বললেন, তাহলে আমাকে তার সাথে কিছু কৌশলগত কথা বলার অনুমতি দেন। নবী করিম (সা:) বললেন, তা-ই বলো।’ (বুখারি, হাদিস : ২/৫৭৬)।
রাসুল (সা.) এর অবমাননার বিষয়ে ইসলাম ধর্মীয় পন্ডিতগণের অভিমত হলো, - আল্লামা খাইরুদ্দীন রামালী (রহঃ) ফতোয়ায়ে বাযযাযিয়ায় লিখেছেন, “রাসূলের কটূক্তিকারীদের সর্বাবস্থায় হত্যা করা জরুরী। তার তওবা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। চাই সে গ্রেফতারের পরে তওবা করুক বা নিজ থেকেই তওবা করুক। কারণ এমন ব্যক্তির তওবার কোনো পরোয়াই করা যায় না এবং এই মাস’আলায় কোনো মুসলমানের মতভেদ কল্পনাও করা যায় না। এটিই ইমামে আযম আবু হানিফা (রহঃ), আহলে কুফী ও ইমাম মালেক (রহঃ) এর মাযহাব।” (তাম্বিহুল উলাতি ওয়াল হুক্কাম, পৃষ্ঠা ৩২৮)। আল্লামা শামী (রহঃ) বলেন, “সকল উলামায়ে কেরাম এ বিষয়ে একমত যে, রাসূলের কটূক্তিকারীকে হত্যা করা ওয়াজিব। ইমাম মালেক (রহঃ), ইমাম আবুল লাইস (রহঃ), ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল (রহঃ), ইমাম ইসহাক (রহঃ), ইমাম শাফেঈ (রহঃ), এমনকি হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রহঃ) সহ সকলের মতেই রাসূলের কটূক্তিকারীর তওবা কবুল করা হবে না।” (ফতোয়ায়ে শামী)।
ফিকহে হানাফির অন্যতম বড় ফকীহ ইমাম ইবনে হুমাম (রহঃ) বলেন, “রাসূল (সা.) এর প্রতি বিদ্বেষপোষণকারী ব্যক্তি মুরতাদ হয়ে যায়। সুতরাং যে কটূক্তিকারী, সে তো আরো আগেই মুরতাদ হয়ে যাবে। আমাদের মতে, এমন ব্যক্তিকে হদ হিসেবে হত্যা করা জরুরী। তওবা গ্রহণ করে তার হত্যা মাফ করা যাবে না।” (ফাতহুল কাদীর, চতুর্থ খন্ড, পৃষ্ঠা ৪০৭)। ইমাম মালেক (রহঃ) বলেন, “রাসূলের কটূক্তিকারীর শুধু গর্দানই উড়িয়েই দেওয়া নয়, তার লাশও যেন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। ইবনে কাসেম (রহঃ), ইমাম মালেক (রহঃ) থেকে বর্ণনা করেন, যে রাসূল (সা.) কে গালি দিবে, বদনাম করবে, দোষ-ত্রুটি বের করবে। তাকে হত্যা করা হবে, চাই সে কাফের হোক বা মুসলমান, তার কাছে তওবা তলব করা হবে না।” (আস সারিমুল মাসলুল ‘আলা শাতিমির রাসূল)।
ইমাম খাত্তাবী (রহঃ) বলেন, “আমার জানা মতে, কোনো একজন মুসলমানও রাসূলের কটূক্তিকারীদের হত্যা ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে দ্বিমত করেননি।” (ফাতহুল কাদীর, আস সারিমুল মাসলুল, ফাতহুল বারী)।
শাইখুল ইসলাম ইমাম আহমদ (রহঃ) বলেন, “আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের প্রতি গালির ইঙ্গিত করাও ইরতেদাদের তথা ধর্মত্যাগীর শামিল, যা হত্যাকে অবধারিত করে। ” তিনি আরো বলেন, “চাই সে কাফের হোক বা মুসলিম, রাসূলের কটূক্তিকারীদের হত্যা করতে হবে। আমার মতে তাদের হত্যা করতে হবে এবং তার তওবা কবুল হবে না।” (আস সারিমুল মাসলুল ‘আলা শাতিমির রাসূল)।
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহিঃ) বলেন, “কোনো মুসলিম যদি নবীকে গালি দেয়, তাহলে সে কাফের ও মুরতাদ হয়ে যায়। এই বিষয়ে সবাই একমত যে, কোনো নবীকে গালি দিলেই সে কাফের এবং তাকে হত্যা করা জায়েয হয়ে যায়।” (আস সারিমুল মাসলুল ‘আলা শাতিমির রাসূল)। উল্লেখ যে, পবিত্র কুরআন সুন্নাহ এর বিধান অনুযায়ী যে বা যারা বিশ্বনবী (সা.) কে অবমাননা করে গালি দেবে, তাঁর ব্যাপারে কুৎসা রটাবে, ইসলামী রাষ্ট্রের আদালত কর্তৃক এ রকম পাপিষ্ঠদেরকে নির্মম দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা হবে। আধুনিক মুসলিম রাষ্ট্রসমুহ তাদের ‘ধর্ম অবমাননা ও ধর্ম সুরক্ষা’ সম্পর্কিত আইনের আওতায় ন্যায় বিচারের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধিকে শাস্তির মুখোমুখি করবে। পরিশেষে আল্লাহপাক আমাদেরকে তাঁর প্রিয় রাসুলের ভালোবাসা, তাঁর সুমহান আদর্শ ধারণ পূর্বক তাঁর শানমান রক্ষা করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখকঃ মোঃ আবদুল গনী শিব্বীর, মুহাদ্দিস, নোয়াখালী কারামাতিয়া কামিল মাদরাসা, সোনাপুর, সদর, নোয়াখালী।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন