মাত্রাতিরিক্ত উত্তোলন ও ব্যবহারের ফলে দেশের ভ‚গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। ফলে দেখা দিচ্ছে সুপেয় পানির সঙ্কট। এছাড়া ক্ষুণœ হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য, ভ‚গর্ভস্থ পানিতে বাড়ছে দূষণের ঝুঁকি। সেই সাথে ভূমিধসের আশঙ্কাও বাড়ছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া নিয়ে এতদিন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা এমনই উদ্বেগ জানিয়েছেন। তবে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় ‘বেঙ্গল ওয়াটার মেশিন’ এই উদ্বেগের অবসান ঘটিয়ে অনেকটাই স্বস্তির খবর দিয়েছে।
বিজ্ঞান সাময়িকী ‘সায়েন্স’-এ গত ১৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত ‘দ্য বেঙ্গল ওয়াটার মেশিন : কোয়াইন্টিফাইড ফ্রেশওয়াটার ক্যাপচার ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রতি বছর ভ‚গর্ভস্থ পানির স্তর ৪ থেকে ১২ মিটার নেমে যায়। পরবর্তী বর্ষাকালে তা প্রাকৃতিকভাবে রিচার্জ হয়ে আগের অবস্থায় ফিরে আসে। এটাকে গবেষকরা আশীর্বাদ হিসেবে দেখছেন। বঙ্গীয় অববাহিকা সংলগ্ন এলাকায় কৃষিকাজের জন্য যে পরিমাণ পানি মাটির নিচ থেকে তোলা হয়, তা পূরণ হয়ে যাচ্ছে পাঁচ-ছয় মাসের মধ্যেই। তবে কিছু কিছু এলাকায় মাত্রাতিরিক্ত পানি উত্তোলনের ফলে তা পুরোপুরি রিচার্জ হয় না। এসব এলাকাকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সেই সাথে ওই ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় পানি উত্তোলন ও ব্যবহার একটা সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মধ্যে রয়েছে রাজধানী ঢাকা। এই শহরের পানির স্তর ৮২ মিটারের নিচে নেমে গেছে। এটা আর পূরণ হয় না, প্রতি বছর আরো নেমে যাচ্ছে। গবেষকরা বলছেন, যেসব জায়গায় পানির স্তর রিচার্জ হচ্ছে না, সেসব জায়গায় সরকারকে আর্টিফিসিয়ালি বৃষ্টির পানি নিয়ে স্টোরেজ বাড়াতে হবে।
ভ‚গর্ভস্থ পানি নিয়ে ১৯৭৫ সালে এক গবেষণায় রজার রিভেল ও ভি ল²ীনারায়ণ দেখিয়েছিলেন, গঙ্গা অববাহিকার আশপাশ এলাকায় শুষ্ক মৌসুমে সেচের জন্য পানি উত্তোলন করায় ভ‚গর্ভের পানির স্তর নেমে যায়। তবে বর্ষা মৌসুমে নদীর পানি খাড়াভাবে মাটির মধ্য দিয়ে নামার ফলে সেই ফাঁকা স্থান পূরণ হয়ে যায়। এই প্রক্রিয়াকে তারা নাম দেন ‘গঙ্গা ওয়াটার মেশিন’।
এখন বঙ্গীয় অববাহিকা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে আরেক দল বিশেষজ্ঞ বলছেন, নদীর পাশাপাশি ভ‚-উপরিস্থ অন্যান্য উৎস যেমন পুকুর, খাল, মৌসুমি নদী-নালার পানি মাটি হয়ে ভ‚গর্ভের পানিস্তরের শূন্যতা পূরণ করে চলেছে, যেই প্রক্রিয়াকে তারা নাম দিয়েছেন ‘বেঙ্গল ওয়াটার মেশিন’ (বিডবিøউএম)। এই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার কারণে কৃষকরা খরা মৌসুমে গভীর ও অগভীর নলক‚প ব্যবহার করে জমিতে সেচ দিলেও দেশের উল্লেখযোগ্য অংশে ভ‚গর্ভস্থ পানির ফাঁকা স্তর দ্রæতই ভরাট হচ্ছে।
গবেষকরা বলছেন, দেশজুড়ে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১২৫০টি অগভীর পর্যবেক্ষণ ক‚পের মধ্যে তারা ৪৬৫টি ক‚পের চার দশকের তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করেছেন। গবেষণায় নির্বাচিত ক‚পের এক-তৃতীয়াংশেই (১৫৩টি) বিডবিøউএমের অস্তিত্ব বা স্বস্তিদায়ক ফল মিলেছে।
যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের তিন গবেষক- মোহাম্মদ শামসুদ্দুহা, রিচার্ড ডি টেলর, এম ইজাজুল হক; বুয়েটের সারা নওরীন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজী মতিন উদ্দীন আহমেদ এবং বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালক আনোয়ার জাহিদ যৌথভাবে এ গবেষণা পরিচালনা করেছেন।
ড. আনোয়ার জাহিদ বলেন, গবেষণালব্ধ তথ্যে সাধারণভাবে বলা যায়- দেশের কয়েকটি অঞ্চলের অধিকাংশ জায়গায় শুষ্ক মৌসুমে তুলে নেয়া ভ‚গর্ভস্থ পানি বর্ষায় পূরণ হয়ে যায়। তবে পুরো দেশের চিত্র এক না হওয়ায় তিনি সতর্কও করেছেন। তিনি বলেন, কোনো কোনো জায়গা আছে, সেখানে ভ‚গর্ভস্থ যে পরিমাণ পানি উত্তোলন করা হয়েছে, তা বর্ষা মৌসুমে পুরোটাই ভরে যায়, অর্থাৎ আগের ওয়াটার লেভেলে পৌঁছে যায়। কিছু কিছু জায়গা আছে, যেখানে অনেক বেশি পানি উত্তোলন করা হচ্ছে, সেখানে পানির স্তর আর পূরণ হচ্ছে না। এটা অ্যালার্মিং। যেসব জায়গায় ভরে যাচ্ছে, যতদিন পর্যন্ত ভরে যাবে, সেখানে ভ‚গর্ভস্থ পানির টেকসই ব্যবহার করা যাবে।
বঙ্গীয় অববাহিকার আশপাশের বেশ কিছু এলাকায় স্বাভাবিক বন্যা, বৃষ্টিপাত ও ভ‚তাত্তি¡কগত কারণে ভ‚গর্ভস্থ পানি নিয়ে স্বস্তিদায়ক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে উল্লেখ করে গবেষকরা জানাচ্ছেন, তারা ১৯৭৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ ক‚পের প্রতি মাসের তথ্য-উপাত্ত পর্যোলোচনা করে সেসব এলাকায় ভ‚গর্ভে পানি রিচার্জ হওয়ার তথ্য পেয়েছেন।
দেশে মূলত বৃষ্টি ও বন্যার পানি খাড়াভাবে মাটির মধ্য দিয়ে (পারকোলেশন বা অনু¯্রবণ) ভ‚গর্ভে প্রবেশ করে ও তার ফলে সেখানে রিচার্জ (পুনঃসঞ্চারণ) ঘটে থাকে। তবে বরেন্দ্র অঞ্চলে এই রিচার্জ ঘটে প্রধানত বৃষ্টির মাধ্যমে, কিন্তু সেখানে বৃষ্টিপাত কম হওয়ার ফলে পানির স্তর আর পূরণ হচ্ছে না।
দেশজুড়ে ১৬ লাখেরও বেশি অগভীর-গভীর সেচ নলক‚প রয়েছে। এর মধ্যে অগভীর রয়েছে প্রায় ১৬ লাখ, গভীর রয়েছে ২৫ হাজারের মতো (সংখ্যা ধীরে ধীরে কমছে); যেসব দিয়ে ভ‚গর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা হয়। বর্ষা মৌসুমে শহরাঞ্চল ও ঢাকা ছাড়া সবখানে পাম্প বন্ধ থাকে। তখন পানি উত্তোলন হয় না, মাটি দিয়ে পানি প্রবেশ করে ভ‚গর্ভস্থ পানির স্তর ভরে ওঠে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও খাদ্য নিরাপত্তার সম্ভাব্য ঝুঁকির মধ্যে অন্তত কিছু জায়গায় পানির স্তর প্রতি বছর রিচার্জ হওয়াকে ‘আশীর্বাদ’ হিসেবে দেখছেন গবেষকরা। যদিও এই রিচার্জ আগে যেখানে জুন-জুলাইয়ের মধ্যে সম্পন্ন হতো, সেখানে এখন সময় লাগছে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর পর্যন্ত। অর্থাৎ আগের চাইতে ২ মাসের মতো সময় লাগছে বেশি।
গবেষকরা জানাচ্ছেন, ঢাকা ও এর চার পাশে ২০০৪ ও ২০০৫ সাল থেকে ভ‚গর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাচ্ছে আশঙ্কাজনক হারে। আবার কিছু কিছু এলাকা বাদে পুরো বরেন্দ্র এলাকায় প্রতি বছর নামছে তিন-চার মিটার করে। আর শহর এলাকায় প্রতি বছর যা উত্তোলন হচ্ছে, তা আর পূরণ হচ্ছে না। দিনাজপুর, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, লালমনিরহাট; ব্রহ্মপুত্রের দুই পাড়ে জামালপুর, গাইবান্ধা, টাঙ্গাইল এবং শহর এলাকার মধ্যে সিলেট, কুমিল্লা ও বরিশালের (শেষ দুই শহর এলাকার কিছু এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ) কিছু কিছু এলাকায় প্রতি বছর পানিস্তর ভরে যাচ্ছে। এসব স্বস্তিদায়ক এলাকা।
বৃহত্তর ঢাকা, বৃহত্তর বরেন্দ্র, শিল্প এলাকা ও শহরাঞ্চল বাদে অধিকাংশ এলাকায় পানির স্তর বর্ষায় ভরে যাচ্ছে। আবার অনেক এলাকার চারপাশ ভরে যাচ্ছে, কিন্তু মাঝখানের একটি উপজেলায় তুলনামূলক বেশি পানি তোলায় তা আর রিচার্জ হচ্ছে না। হাওর এলাকার ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও পানি ভরে যাচ্ছে, আবার কোথাও কোথাও তা হচ্ছে না। আর উপক‚লীয় এলাকায় লবণাক্ততার প্রভাব থাকায় ভ‚গর্ভস্থ পানির ব্যবহারই কম। দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা ভ‚গর্ভস্থ পানির ব্যবহার টেকসই অবস্থায় নেই; ওইসব এলাকা বরাবরই ঝুঁকিতে রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ‚তত্ত¡ বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী মতিন উদ্দীন আহমেদ বর্ষাকালে যত বেশি পানি ধরে রাখা সম্ভব হবে, পরে তত বেশি ব্যবহার করা সম্ভব হবে। সময়ের সঙ্গে খাদ্যোৎপাদন বাড়ছে, সেই সঙ্গে ভ‚গর্ভস্থ পানিতে চাপও বাড়ছে। কোথাও কোথাও রিচার্জ হচ্ছে, কোথাও কোথাও রিচার্জ হচ্ছে না। যেসব জায়গায় রিচার্জ হচ্ছে না, সেসব জায়গায় আর্টিফিসিয়ালি বৃষ্টির পানি নিয়ে স্টোরেজ বাড়াতে হবে।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, সারা দেশেই কমবেশি পানির স্তর নিচে নামছে। এ গবেষণায় যা বলা হয়েছে তা অবশ্যই স্বস্তির বিষয়। তবে এতে বলা হয়েছে সব জায়গায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর পূরণ হচ্ছে না। এসব এলাকাকে ঝুঁকিপূর্ণ বলা হচ্ছে। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকা সবচেয়ে বেশি ঝূঁকিপূর্ণ। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বৃষ্টির পানি ধরে রাখা বা অন্যান্য উপায়ে পানির স্টোরেজ বাড়াতে বলা হয়েছে। আমরাও তা মনে করি। এ বিষয়ে সরকারকে অবশ্যই পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে ঢাকায় সুপেয় পানির সঙ্কট আরো তীব্র হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন