বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

অভ্যন্তরীণ

অস্তিত্ব সঙ্কটে দেশীয় প্রজাতির মাছ

চলনবিলে বৈরী পরিবেশের প্রভাব

মো. আজিজুল হক টুকু, নাটোর থেকে | প্রকাশের সময় : ৪ অক্টোবর, ২০২২, ১২:০৬ এএম

নাটোরের চলনবিলে বৈরি পরিবেশের প্রভাবে হারিয়ে যাচ্ছে দেশীয় প্রজাতির মাছ। ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ এই চিরায়ত কথাটি এখন শুধুই কল্পকথা। নাটোরের সিংড়া, গুরুদাসপুর ও নলডাঙ্গা উপজেলার চলনবিল এলাকায় এখন দেশীয় প্রজাতির মাছের আকাল চলছে। চলনবিলে দেশি প্রজাতির অনেক বিলুপ্ত প্রায় মাছ এখন চাষ হচ্ছে পুকুরে। এক সময়ে দেশের সব চাইতে বড় মাছের ভান্ডার হিসেবে চিহ্নিত চলনবিল। বিলের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা নদী ও খালগুলোতে এখন দেশীয় প্রজাতির মাছ চাষের উপযোগী পানি বেশি সময় থাকে না।
সে কারণে নাটোরের সিংড়াসহ পাবনা-সিরাজগঞ্জের বিস্তীর্ণ চলনবিল অঞ্চলের নদী-নালা ও খালগুলো বর্তমানে প্রায় মাছশূন্য হয়ে পড়েছে। নাটোর-পাবনা-সিরাজগঞ্জ জেলার ৯টি উপজেলার নিচু এলাকা নিয়ে চলনবিল অঞ্চল গঠিত। কিন্তু প্রকৃতির বিরুপ প্রভাব ও নদীর প্রবেশমুখে অপরিকল্পিত ড্যাম দেয়ার কারণে চলনবিলে প্রবাহিত নদ-নদীগুলো এখন শুকিয়ে মরা খালে পরিণত হয়েছে। বর্ষায় নদ-নদী ও খালগুলোতে পর্যাপ্ত পানি থাকলেও শুস্ক মওসুমে বিল শুকিয়ে যাওয়ায় দেশীয় প্রজাতির মাছের উৎপাদন একেবারে কমে যায়। এসময় সিংড়া-গুরুদাসপুর-নলডাঙ্গা অঞ্চলের জেলেরা দিনভর মেহনত করেও তেমন একটা মাছ ধরতে পারেন না। ফলে এ অঞ্চলের হাজার হাজার মৎসজীবী পরিবারের সদস্যরা খেয়ে না খেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করে থাকেন।
নাটোর জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, দেশে স্বাদু পানিতে মাছের প্রজাতির সংখ্যা ২৬০। তারমধ্যে নাটোরের সিংড়া-গুরুদাসপুর-নলডাঙ্গা অধ্যুষিত চলনবিল অংশে অতীতে পাওয়া যেত প্রায় ১৩০ প্রজাতির মাছ। বর্তমানে মাছের প্রজাতি কমে দাঁড়িয়েছে ৭৯ তে। তথ্য মতে, বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া মাছের প্রজাতির মধ্যে ধোঁদা, গুড়পুঁই, বাছা, ব্যাইটকা, গজার, শিলং, ২ প্রজাতির টেংড়া, ভেদা, শংকর, ফাঁদা, টিপ পুঁটি, পানি রুই এর মতো ১১ প্রজাতির মাছ উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও এ অঞ্চলে বিলুপ্তপ্রায় হয়ে পড়েছে প্রায় ৫০ প্রজাতির দেশীয় মাছ। বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির মাছের মধ্যে মেনি মাছ, গুতুম বা পুঁইয়া, চিতল, ফোলি, চিংড়ি, ভেদা, বেলে, পাবদা, কাঁচকি, এক প্রজাতির চাঁদা, মলা-ঢেলা, দাঁড়কিনা, বৌমা, ঘাড়ুয়া, ভাঙ্গন, কালিবাউশ, বাঁশপাতা, পাঙ্গাস প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
স্থানীয় মৎস্যজীবী কসলেম উদ্দীনসহ অনেকেই হতাশার সাথে বলেন, আগে দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন প্রকারের মিঠা পানির মাছ চলনবিল অঞ্চল থেকে তারা বিপুল পরিমাণে সংগ্রহ করতেন। বোয়াল থেকে শুরু করে রুই কাতলা, টেংরাসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ পাওয়া যেতো প্রচুর পরিমাণে। নদীগুলো শুকিয়ে নদীবক্ষে ধুঁ-ধুঁ বালির চর পড়ায় বর্তমানে মাছের দুষ্পাপ্যতা দেখা দিয়েছে। এতে এ অঞ্চলের হাজার হাজার জেলে পরিবারে বর্তমানে যেমন দুর্দিন দেখা দিয়েছে তেমনি সাধারণ জনজীবনে খাদ্য-পুষ্টি ঘাটতির আশংকাও দেখা দিয়েছে ব্যাপকভাবে।
নাটোর জেলা মৎস্য অফিসের সিনিয়র সহকারী পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলমের মতে, চলনবিলের নদ-নদীতে পলি ও বালি জমে পানির স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ বাধাগ্রস্থ হওয়া, অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ, অপরিকল্পিত পুকুর খনন, অবৈধ জালের মারাত্মক ব্যবহার, বিল ভরাট করে দখল দারিত্ব, বিষ প্রয়োগে মাছ আহরণ, বিলের গভীর অংশ সেচে মাছ ধরা, কৃষি জমিতে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার, মৎস্য আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়া, হঠাৎ বন্যাসহ নানা কারণে চলনবিল অঞ্চল থেকে দেশীয় প্রজাতির মাছ হারিয়ে যাচ্ছে। সরকার দেশীয় প্রজাতির মাছ সংরক্ষণে বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করলেও এসব কারণে তা সফলতার মুখ দেখতে পারছেনা।
এ ব্যাপারে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, চলনবিল অঞ্চলে মাছের অভয়াশ্রম গড়ে তুলে বিলুপ্ত হওয়া মাছকে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এতে আগের মতো মাছ হয়তো চলনবিলে পাওয়া যাবে না। তবুও নলডাঙ্গায় অভয়াশ্রম করার ফলে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া মেনি মাছ বর্তমানে পাওয়া যাচ্ছে যা ৩-৪ বছর আগেও পাওয়া যেত না।
এই মৎস্য কর্মকর্তা আরোও জানান, যে কোন উপায়ে এ অঞ্চলে বেশি সংখ্যক মাছের অভয়াশ্রম গড়ে তুলতে হবে। আমাদের দেশে পুষ্টির চাহিদা পুরণের জন্য দেশীয় প্রজাতির মাছ সংরক্ষণ ও মাছচাষ সম্প্রসারণ অত্যন্ত জরুরি। বিভিন্ন প্রকার জালের ব্যবহার বন্ধের জন্য অভিযান ও মোবাইল কোর্ট নিয়মিত করার উপর আরও জোর দেয়া হয়েছে। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আরো জানান দেশীয় প্রজাতির মাছ সংরক্ষণের জন্য নাটোরে ৭টি বিল নার্সারিও করা হয়েছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন