মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপ সম্পাদকীয়

মানুষের অবিচ্ছেদ্য অধিকারই মানবাধিকার

উপ-সম্পাদকীয়

| প্রকাশের সময় : ১১ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আফতাব চৌধুরী : বর্তমান বিশ্বে ব্যক্তিজীবন, ব্যষ্টিজীবন, সমাজজীবন, রাষ্ট্রজীবনে মানবাধিকার চর্চা এবং রক্ষার তৎপরতা অত্যন্ত গুরুত্ব লাভ করেছে। প্রতিটি সচেতন মানুষের অনুভবে এবং কর্ম তৎপরতায় মানবাধিকার এক বিশেষ স্থান অধিকার করেছে। এ অবস্থাটা অবশ্য গত শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকেই আরম্ভ হয়েছে। তবে এ অবস্থা সৃষ্টির পশ্চাতে রয়েছে মানবাধিকারের বিবর্তনের ইতিহাস যা প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য।
প্রকৃতপক্ষে মানবাধিকার মানুষের সহজাত এবং তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অধিকার, যা একজন মানুষ, মানুষ হিসাবে জন্ম গ্রহণ করেছে বলে তার অবশ্য প্রাপ্য। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, লিঙ্গ নির্বিশেষে প্রত্যেক ব্যক্তির মানুষ হিসাবে মর্যাদা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এ অধিকার পাওয়ার একান্ত প্রয়োজন। কোন ব্যক্তি বিশেষের সকল দাবিই মানবাধিকার বলে গণ্য হতে পারে না। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, একজন ব্যক্তি যদি যেভাবে খুশি জীবিকা নির্বাহ করতে চায় বা যা খুশি তা করতে চায় তাহলে তার এ দাবিকে মানবাধিকারের পর্যায়ভুক্ত বলে অভিহিত করা যায় না। কারণ যথেচ্ছাচার কোন সভ্য সমাজে অধিকার বলে গণ্য হতে পারে না।
যে অধিকারগুলো একজন ব্যক্তির মানবোচিত ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য সমাজস্বীকৃত উপাদান বলে গণ্য হয়, একমাত্র সেগুলোই মানবাধিকার রূপে গণ্য হওয়ার যোগ্য। মানবাধিকার কথাটি হালের। তবে এ শব্দবন্ধ অভিধানে থাকলেও মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো সমাজে স্বীকৃত ছিল এবং এ গ্রহে মনুষ্য বাসের সূচনালগ্ন থেকেই প্রচলিত ছিল। তবে এগুলোর রক্ষা এবং নির্বিঘেœ প্রয়োগের জন্য প্রাচীন বা মধ্যযুগে তেমন কোন আইন বিধিবদ্ধ নিয়ম ছিল না। আধুনিক যুগে আইনের প্রচলন আরম্ভ হলেও সকল দেশে সে আইনের সমরূপতা নেই, তা আবার সংশ্লিষ্ট দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলেও গণ্য। তবে স্মরণাতীতকাল থেকেই বিভিন্ন ধর্ম স্ব-স্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোর প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছে। প্রাচীন ও মধ্যযুগে ধর্ম এবং রাষ্ট্রের মধ্যে তেমন সংঘাত দেখা দিত না বলে রাষ্ট্র পরিচালনায় ধর্মের নির্দেশই প্রাধান্য পেত। তাই ধর্ম নির্দেশিত পথেই রাষ্ট্র মানুষের অধিকারগুলোর নিশ্চয়তা দান করত। আধুনিক যুগে রাষ্ট্র ও ধর্মের মধ্যে অনিবার্য সংঘাত দেখা দিয়েছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রের বিজয় সূচিত হয়েছে। তাই রাষ্ট্র্র মানুষের অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আইন প্রণয়ন করেছে। আইন প্রণয়ন করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের ঐতিহ্য, প্রথা, আচার-আচরণ, বিশ্বাস, সংস্কার প্রভৃতি প্রেক্ষিতগুলোর উপর গুরুত্ব আরোপ করায় মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং রক্ষণের জন্য প্রযুক্ত সকল রাষ্ট্রের আইনে সমতা আসেনি। তবে বিভিন্ন দেশে আইন প্রণয়নের পশ্চাতে যেসব ঐতিহাসিক কারণ বিদ্যমান ছিল তাদের মধ্যে একটা এককেন্দ্রীপ্রবণতা মোটামুটিভাবে অন্তঃপ্রবাহের মত বহমান আছে। ফলে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী ও রাষ্ট্রের মধ্যে মানুষের অধিকার সংক্রান্ত নির্দেশাবলী ও আইনের মধ্যে বিভিন্নতা থাকলেও এককেন্দ্রী ঝোঁকের অভাব নেই। তাই গত শতাব্দীর মাঝামাঝি এ ঝোঁককে সংহত করে মানবাধিকারের এমন একটি ধারণা সৃষ্টি করা হয় যার বিষয়বস্তু অত্যন্ত ব্যাপক এবং প্রয়োগের ক্ষেত্রটি বিশ্বজনীন।
১৯৪৫ সালে সানফ্রান্সিসকো থেকে জাতিসংঘের সনদ ঘোষণা করা হয়। মানবাধিকার বা Human Rights  এ শব্দবন্ধটি এ সনদেই সর্বপ্রথম ব্যবহার করা হয়। এর আগে মানুষের অধিকারের বিভন্ন দিক নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা হলেও ‘মানবাধিকার’ শব্দবন্ধের ব্যবহার হয়নি। জাতিসংঘের সনদের প্রস্তাবনায় জাতি, ধর্ম, ভাষা, লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য ‘মানবাধিকার’ এবং মৌলিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করাকে বিশ্বসংস্থার অন্যতম মূল লক্ষ্য বলে ঘোষিত হয়। এ লক্ষ্য অর্জনে সকল সদস্য রাষ্ট্র একক এবং যৌথভাবে জাতিসংঘের সহযোগিতায় তৎপর থাকবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়ার বাধ্যকতা গৃহীত হয়। এভাবে জাতিসংঘের সনদে ‘মানবাধিকার’ শব্দটি যেমন প্রথম আত্মপ্রকাশ করল, ঠিক তেমনি মানবাধিকার রক্ষণের বিষয়টি সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতিতে পরিণত হল। তার আগে মানুষের অধিকারের প্রশ্নটি রাষ্ট্র এবং ব্যক্তি বিশেষের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এবং তার অধিক্ষেত্র কোন দেশের অভ্যন্তরীণ এক্তিয়ারের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হত। সুতরাং মানুষের অধিকারের ব্যাপারটি এতকাল আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতার আওতাভুক্ত ছিল না এবং আন্তর্জাতিক জনসমাজের সঙ্গে এর কোন সংস্রবও ছিল না। লিগ অব নেশনস বা জাতিসংঘের সংগঠন ও কর্ম প্রবর্তনার মধ্যে একটা আন্তর্জাতিক সমাজ এবং আন্তর্জাতিক বিচার ব্যবস্থার প্রচেষ্টা থাকলেও এত জন বা ব্যক্তি মানুষের ব্যক্তিক ও সামগ্রিক স্বার্থের ব্যাপারটি ছিল অনুপস্থিত। যাহোক, ১৯৪৫ সালে ঘোষিত জাতিসংঘ সনদ পৃথিবীর প্রতিটি মানুষকে মানব সমাজের সদস্য বলে গণ্য করে। বিধিসম্মতভাবে মানবাধিকার দাবি করার অধিকার দিয়ে মানব ইতিহাসে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করল। এর ফলে মানবাধিকার বিশ্বজনীন অধিকারের মর্যাদা লাভ করল এবং তা প্রয়োগের ক্ষেত্রটি আন্তর্জাতিক স্তরে বিস্তৃত হল। তবে এটা ছিল একটা যুগের সূচনা মাত্র। জাতিসংঘ সনদে মানবাধিকার নীতিগতভাবে স্বীকৃতি লাভ করলেও তখন মানবাধিকার সংজ্ঞায়িত হয়নি। সুতরাং জাতিসংঘ সনদে সন্নিবেশিত মানবাধিকারের লক্ষ্য অর্জন, জনসাধারণ্যে মানবাধিকারের ধারণা প্রতিষ্ঠাকল্পে একটি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার প্রবর্তন এবং মানবাধিকার রক্ষণের জন্য মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার উপযুক্ত সংজ্ঞা নির্ধারণের প্রয়োজন দেখা দিল। আর সে কাজটি সম্পন্ন হল ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর ঘোষিত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ঘোষণার মাধ্যমে। তিন বছর ধরে গভীর অভিনিবেশ সহকারে চিন্তাভাবনার ফল হিসাবে জাতিসংঘের সাধারণ সভা মানবাধিকারের বিশ্বজনীন ইস্তাহার (Universal Declaration of Human Rights) ঘোষণা করল। এ ঘোষণাটি অবশ্যম্ভাবীরূপেই যুদ্ধ বিধ্বস্ত পৃথিবীতে একটি বিপ্লবী পদক্ষেপ। তাই মানব সভ্যতার ইতিহাসে ১০ ডিসেম্বর একটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য দিন রূপে মর্যাদা লাভ করেছে।
ত্রিশ অনুচ্ছেদ সম্বলিত ইস্তাহার ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে মানবজাতির নাগরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকার দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করে এবং তৎসঙ্গে সাম্য এবং স্বাধীনতা উপভোগে কোন ব্যক্তি বা ব্যষ্টিমানব যাতে বৈষম্যের শিকার না হয়, সে ব্যাপারে তৎপরতাকে নীতি হিসাবে গ্রহণ করতে বিশ্ব সংস্থা প্রতিশ্রুত হয়। এ ইস্তাহার বা ঘোষণাটি মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা নামে সমধিক প্রসিদ্ধ।
এ ঘোষণায় দ্ব্যর্থহীন ভাষায় উচ্চারিত নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল: প্রত্যেক মানুষের বেঁচে থাকা, স্বাধীনতা এবং নিরাপত্তার অধিকার; দাসত্ব প্রথার বিলোপ এবং উৎপীড়নের অবসান; অভিযোগ ছাড়া গ্রেফতার, বিনাবিচারে বন্দি বা নির্বাসনের অবসান; বিধিগত প্রক্রিয়ায় প্রত্যেক মানুষের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার; চিন্তা, বিবেচনা এবং ধর্ম পালনের স্বাধীনতা; ভোটদানের বা মত প্রয়োগের অধিকার; দেশান্তরে যাওয়া-আসা এবং দেশের মধ্যে অবাধ যাতায়াতের অধিকার।
এ ইস্তাহারে ঘোষিত অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকারগুলোর মধ্যে কয়েকটি বিশেষ অধিকার নিম্নলিখিতভাবে বিন্যস্ত:
সামাজিক নিরাপত্তা লাভের অধিকার; কর্ম সংস্থান এবং বিশ্রামের অধিকার, সমমানের কাজের জন্য পারিশ্রমিকের সমতার অধিকার, ন্যায্য পারিশ্রমিক লাভের অধিকার; শ্রমিক সংগঠনে যোগদানের অধিকার; জীবন ধারণের জন্য একটি প্রয়োজনানুগ মান লাভ করার অধিকার; শিক্ষা লাভের অধিকার; বিবাহ এবং পারিবারিক জীবন নির্বাহের অধিকার; স্বাস্থ্য রক্ষার অধিকার প্রভৃতি।
মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণার বিষয়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গটি হল রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে নির্দেশিত নীতি। এতে স্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হল জনগণের ইচ্ছাই হবে সরকারের কর্তৃত্বের মূল ভিত্তি।
জাতিসংঘের এ সার্বজনীন ঘোষণাটি কিন্তু সকল রাষ্ট্র এবং জাতির শাসনকার্য পরিচালনার জন্য একটি সাধারণ নীতি নির্দেশিকা রূপে ঘোষিত হলেও এতে কোন আইনি ক্ষমতা দেওয়া হল না। তথাপি ঘোষণাটি বিভিন্ন দেশের জনগণকে নৈতিক চেতনা এবং রাজনৈতিক উদ্দীপনায় উজ্জীবিত করে তুলল। এর শক্তিশালী প্রভাবে ঘোষণায় সন্নিবেশিত মানবাধিকারগুলো অর্জন ও রক্ষণের জন্য বিশ্বব্যাপী তীব্র আবেগ ও উত্তেজনা পরিলক্ষিত হলেও এসব দাবির অনুকূলে আইন প্রণয়ন করার জন্য রাষ্ট্রগুলোকে বাধ্য করার লক্ষ্যে জাতিসংঘ কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। যাহোক, জাতিসংঘের সাধারণ সভা তার মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাটিকে চুক্তিপত্রে রূপায়িত করে একটি খসড়া তৈরি করতে তার মানবাধিকার আয়োগকে অনুরোধ করে। তদনুযায়ী আয়োগ ১৯৫১ সালে চুক্তিপত্রের খসড়া তৈরি করলেও তা ১৯৬৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ সভায় তিনটি হাতিয়ার (Instrument)  নামে প্রেরণ করা হয় সদস্য রাষ্ট্রগুলোর স্বাক্ষরের জন্য। খসড়া চুক্তিপত্রটি জাতিসংঘের ৩৫টি দেশ কর্তৃক অনুসমর্থিত হলে ১৯৭৫ সালে তা কার্যকর বলে ঘোষিত হয়। চুক্তিপত্রের তিনটি উপায়কে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সামাজিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তিপত্র এবং নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত চুক্তিপত্রে (ব্যক্তিবিশেষের আবেদনে) সন্নিহিত দলিল। এখন পর্যন্ত ১৩০টি দেশ এ আন্তর্জাতিক চুক্তিপত্রগুলোতে স্বাক্ষর করেছে এবং এগুলো তাদের উপর আইনরূপে বর্তায়।
এছাড়া বিগত দশকগুলোতে মানবাধিকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরও অনেক সমস্যার উদ্ভব ঘটেছে এবং এগুলোর সমাধানে জাতিসংঘ নতুন নতুন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এভাবে রাষ্ট্রহীন ব্যক্তিদের অধিকার, উদ্বাস্তদের অধিকার, নারীদের অধিকার দান এবং সকল রকমের বৈষম্য দূরীকরণের উপায় উদ্ভাবনে জাতিসংঘ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
বাংলাদেশ এ আন্তর্জাতিক চুক্তিপত্রগুলোতে স্বাক্ষর করেছে এবং মানবাধিকার রক্ষার জন্য আইন প্রণয়ন করেছে। মানবাধিকার রক্ষণে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণকল্পে বাংলাদেশ মানবাধিকার রক্ষা আইন (Human Rights Prtection Act) প্রণয়ন করে জাতীয় মানবাধিকার আয়োগ ও তৎসঙ্গে মানবাধিকার আদালত প্রতিষ্ঠা করেছে। বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত মানবাধিকারের সংজ্ঞা নিরূপিত হয় এভাবে: মানুষের জীবন ধারণ সম্পর্কিত অধিকার, স্বাধীনতা, সাম্য এবং সংবিধান, আন্তর্জাতিক সাংবিধানিক চুক্তি ও বাংলাদেশীয় বিচারালয় কর্তৃক প্রদত্ত ব্যক্তির আত্মমর্যাদা রক্ষার অধিকার। অর্থাৎ বাংলাদেশ জাতিসংঘের সর্বজনীন ঘোষণা ও আন্তর্জাতিক চুক্তিপত্র বা সংবিধানে উল্লেখিত অধিকার সমূহের সঙ্গে বাংলাদেশ সংবিধান এবং আদালত কর্তৃক প্রদত্ত অধিকারগুলোকেও মানবাধিকার বলে গণ্য করেছে এবং এগুলোর রক্ষাকল্পে আয়োগও বিচারালয় প্রতিষ্ঠা করেছে।
এ তো গেল মানবাধিকার সম্পর্কে জাতিসংঘের সর্বজনীন ঘোষণা তা কার্যকর করার জন্য গৃহীত পদক্ষেপসমূহ এবং বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে তার প্রয়োগের ক্ষেত্রটি কীভাবে প্রস্তুত হয়েছে এবং হচ্ছে তার এক সংক্ষিপ্ত বিবরণ। কিন্তু বিশ্বের অবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এখনও বিশ্বে মানবাধিকার শুধু রক্ষা নয় অর্জনের দাবিতেও মানুষ প্রাণ দেয়। এর জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত প্যালেস্টাইন। স্বভূমে রাষ্ট্রহীন উদ্বাস্তু লোকেরা মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত। বর্তমান এক মেরু বিশ্বের সর্বাধিনায়ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদেই গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে প্যালেস্টাইন ‘জাতিসংঘের অবৈধ সন্তান’ ইসরাইলের আবির্ভাবের ফলে প্যালেস্টানিরা রাষ্ট্রহারা, বাস্তুহারা হয়েছিল। দশকের পর দশক ধরে এরা মানবাধিকার রক্ষাকল্পে নয় অর্জনের লক্ষ্যে আত্মাহুতি দিচ্ছে এবং নিদারুণ হতাশার শিকার হয়ে কেউ কেউ সন্ত্রাসের পথ বেছে নিচ্ছে। ৯/১১ উত্তর পরিস্থিতিতে আহত যুক্তরাষ্ট্র আক্রমণের পূর্বাধিকার নীতি (Presumptive war)  ঘোষণা করে আফগানিস্তান ও ইরাকে যুদ্ধ চালিয়ে দেশ দুটিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। এদিকে পরবর্তী পর্যায়ে লিবিয়ার যা ঘটলো যেভাবে সে দেশের রাষ্ট্রপ্রধান গাদ্দাফিকে হত্যা করা হলো তা কিন্তু করা হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদে যা বিশ্ববাসী ভাল করেই জানে। সেখানে তা মানবাধিকারের বিষয়টি বিবেচিত হয়নি। সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীদের গুয়েন্তেনামো এবং আবুগারীবে বন্দি করে তাদের উপর যেভাবে নির্যাতন চালানো তাতে মানবাধিকার নামক আইনসম্মত অধিকারটির অস্তিত্বই বায়বীয় বলে উপজাত হয়েছে। এভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনে এখনও আমেরিকার অবস্থান সম্ভবত শীর্ষে। তাই অবস্থা দৃষ্টে মনে হয় প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে বিখ্যাত গ্রীক ঐতিহাসিক তুকিডাইডস (৪৬০-৪০১ খৃঃ পূঃ) পৃথিবীর যে অবস্থা লক্ষ্য করেছিলেন আজও তার পরিবর্তন হয়নি। আড়াই হাজার বছর আগের পৃথিবীর রাজনৈতিক অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি মন্তব্য করেছিলেন- ‘শক্তিশালী রাষ্ট্র যা খুশি করতে পারে এবং শক্তিহীন রাষ্ট্র তা মেনে নিতে বাধ্য হয়।’ অবস্থাদৃষ্টে ‘সে ট্র্যাডিশন সামনে চলছে’ বলে কী মনে হয় না?
তথাপি শোষিত বঞ্চিত মানুষের কাছে মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণা বা আন্তর্জাতিক সংবিধান তার অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে অধিকার প্রত্যাশা করে অস্তিত্বের উপলব্ধি, বোধির বিকাশ। বোধি-মননের যোগ হলে জীবনবোধের বিকাশ ঘটে এবং তখনই অস্তিত্ব চেতনার উদ্ভব হয়। অস্তিত্ব চেতনার উদ্ভব ঘটলে অধিকার চেতনাবোধ জন্মায়। শোষিত বঞ্চিত মানুষের অধিকার চেতনাবোধ জন্ম দেয় ঐক্য চেতনাবোধ। অধিকার চেতনায় উদ্বুদ্ধ শোষিত বঞ্চিত মানুষের মধ্যে ঐক্য চেতনাবোধ জন্ম নিলে ‘মানবাধিকার’ নামক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তাদের সম্মিলিত প্রয়াস মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীকে নামাবে ধূলির ধরায় তিনি যতই শক্তিমান হোন না কেন।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন