মোহাম্মদ আবদুল গফুর : ১৯৫০ সালের কথা। আমার অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার মাত্র দুই মাস বাকি থাকতে তমদ্দুন মজলিসের ভাষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন কাজে সার্বক্ষণিক কর্মী হিসাবে যোগ দিতে জায়গীর বাড়ি ত্যাগ করে মজলিসের প্রধান কার্যালয় ১৯ নম্বর আজিমপুর চলে আসি। ১৯ নম্বর আজিমপুর একই সাথে ছিল তমদ্দুন মজলিস প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবুল কাসেমের বাসভবন। সারা দেশে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর ফারুকের (রা.) শাহাদৎ বার্ষিকী উদযাপন ও এ উপলক্ষে ‘বিপ্লবী উমর’ গ্রন্থ প্রকাশ ছাড়াও ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের দুই দিনব্যাপী জন্মবার্ষিকী উদযাপন এ সময়েরই ঘটনা।
এরপর আসে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি। ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয় ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিসের ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ শীর্ষক পুস্তিকা প্রকাশের মাধ্যমে। ১৯৪৭ সালে এ আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে আলোচনা সভা, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অধ্যাপক আবুল কাশেমর নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত ছাত্রসভা, বাংলা ভাষাবিরোধী বিভিন্ন চক্রান্তের প্রতিবাদে বিবৃতি, মেমোরেন্ডাম পেশ প্রভৃতির মধ্যদিয়ে ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে। প্রথম সংগ্রাম পরিষদও গঠিত হয় ১৯৪৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিজ্ঞানের তরুণ শিক্ষক অধ্যাপক নূরুল হক ভুঁইয়াকে কনভেনর করে।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি সাবেক বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্র লীগের একাংশ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নামে একটি স্বতন্ত্র ছাত্র সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এই সংগঠনও ভাষা আন্দোলনের সমর্থক থাকায় মজলিস ও ছাত্রলীগ উভয় সংস্থার যুগপৎ সদস্য শামসুল আলমকে কনভেনর করে সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠন করা হয়। এ সময়ে করাচিতে পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে কংগ্রেস সদস্য বাবু ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাঙলায় বক্তৃতা দানের দাবি জানালে সে দাবি প্রত্যাখ্যাত হয়। এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ হতে ১১ মার্চ সারাদেশে ধর্মঘট পালনের ডাক দেয়া হয়।
১১ মার্চের প্রতিবাদ দিবস বিপুল সাফল্যম-িত হয়। এই কর্মসূচির প্রতি রেল শ্রমিক-কর্মচারীদের সমর্থন থাকায় ওইদিন চট্টগ্রাম থেকে কোন ট্রেনই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হতে পারেনি। ঢাকার অবস্থা ছিল আরও নাজুক। সেক্রেটারিয়েট গেটে পিকেটিংয়ের কারণে ওইদিন খুব কম কর্মকর্তা-কর্মচারীই সেক্রেটারিয়েটে প্রবেশ করতে পারে। পুলিশ কিছু পিকেটারকে গ্রেফতার করে। অনেকের উপর করে লাঠিচার্জ। গ্রেফতার ও লাঠিচার্জের খবর ছড়িয়ে পড়লে কিছুক্ষণের মধ্যে সমগ্র সেক্রেটারিয়েট এলাকা বিক্ষুব্ধ জনসমুদ্রে পরিণত হয়। তখন সেক্রেটারিয়েটের চারদিকে দেয়াল ছিল না। ছিল কাঁটাতারের বেড়া। অনেকে কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে মন্ত্রী ও সচিবদের রুমে ঢুকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে না পারলে পদত্যাগ করবেন এমন প্রতিশ্রুতি আদায় করেন।
১১ মার্চ থেকে শুরু করে ১৫ মার্চ পর্যন্ত এরকম অরাজক পরিস্থিতি চলতে থাকে। এতে প্রাদেশিক চিফ মিনিস্টার খাজা নাজিমুদ্দিন ভীত হয়ে পড়েন। কারণ ১৯ মার্চ জিন্নাহ সাহেবের ঢাকা আসার কথা। নাজিমুদ্দিন ১৫ মার্চ তারিখে সংগ্রাম পরিষদের সকল দাবি-দাওয়া মেনে নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এতে পরিস্থিতি আপাতত কিছুটা শান্ত হয়। জিন্নাহ সাহেব ১৯ মার্চ ঢাকায় আসেন। ২১ মার্চ রমনা রেসকোর্স জনসভায় এবং ২৪ মার্চ কার্জন হলে বিশেষ সমাবর্তনে ভাষণ দেন। ইংরেজিতে প্রদত্ত উভয় ভাষণে তিনি উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার সংকল্প ঘোষণা করেন। উভয় স্থানে তাঁর বক্তব্যের প্রতিবাদ হয়। রেসকোর্সের বিশাল জনসভায় প্রতিবাদ তিনি টের না পেলেও কার্জন হলের সীমিত উপস্থিতিতে বক্তৃতায় তার মুখের উপর প্রতিবাদে তিনি স্তম্ভিত হন। কারণ এই ছাত্ররাই মাত্র কিছুদিন আগে তার ডাকে পাকিস্তান আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তিনি কিছুক্ষণ নীরব থাকেন। পরে বক্তৃতা সংক্ষেপ করে সভাস্থল ত্যাগ করেন।
পরে তিনি ছাত্র প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনায় বসেন। উভয় পক্ষ নিজ নিজ অবস্থানে অটল থাকাতে আলোচনা ব্যর্থ হয়। তবে লক্ষ্য করার বিষয়, ঐ বছর ১১ সেপ্টেম্বর তার ইন্তেকালের পূর্বে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে প্রকাশ্যে কোনো বক্তব্য দেননি। খ্যাতনামা সাংবাদিক মোহাম্মদ মোজাব্বেরের ‘সাংবাদিকের রোজনামচা’ শীর্ষক গ্রন্থ থেকে জানা যায়, মৃত্যু শয্যায় নাকি তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এলাহি বকশের সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি মাঝে মাঝেই বলতেন, অন্যের কথায় রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে মতামত দেয়া তার ভুল হয়েছে। এটা গণপরিষদের সদস্যদের উপর ছেড়ে দেয়া উচিত ছিল।
ইতিমধ্যে ১৯৪৮ সালের ১৪ নভেম্বর তমদ্দুন মজলিসের পক্ষ থেকে সাপ্তাহিক সৈনিক নামে যে পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়, বাস্তবতা বিবেচনায় তা ভাষা আন্দোলনের অঘোষিত মুখপত্র হয়ে দাঁড়ায়। এই পত্রিকা প্রকাশ করেন অধ্যাপক আবুল কাসেম। এর প্রথম দিকে সম্পাদক ছিলেন প্রখ্যাত কথাশিল্পী শাহেদ আলী ও এনামুল হক। সহকারী সম্পাদক হিসেবে ছিলাম আমি (আবদুল গফুর), সানাউল্লাহ নূরী ও মোস্তফা কামাল (পরবর্তীকালে সৈনিক বাংলার সহকারী সম্পাদক)। পরবর্তীকালে চাকরি নিয়ে এনামুল হক করাচি চলে গেলে শাহেদ আলী হন সম্পাদক ম-লীর সভাপতি। তিনি ১৯৫০ সালে তিনি বগুড়া আজিজুল হক কলেজে অধ্যাপক পদে যোগ দিলে আমাকে সম্পাদকের দাযিত্ব দেয়া হয়।
১৯৪৯ থেকে ১৯৫১ পর্যন্ত প্রতিবছর ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবস হিসেবে পালন করে সরকারকে মনে করিয়ে দেয়া হত যে, এদেশের মানুষ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি ভোলেনি। রাষ্ট্রভাষা বাঙলার দাবির প্রকাশ্যে বিরোধিতার সাহস না পেয়ে এক পর্যায়ে সরকার বাংলার দাবিকে সাবোটাজ করার লক্ষ্যে বাংলা ভাষায় আরবি হরফ ব্যবহারের চেষ্টা করে। এর বিরুদ্ধে তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আমার গঠিত প্রবন্ধ পরবর্তী সংখ্যার সাপ্তাহিক সৈনিকে প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়। এভাবে সরকারের এ অপচেষ্টাও ব্যর্থ হওয়ায় এ প্রশ্নে সরকার পিছুটান দিতে বাধ্য হয়।
ইতিমধ্যে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের নেতৃত্বে বিরাট পরিবর্তন ঘটে। ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর কায়েদে আজম জিন্নাহর মৃত্যুর পর খাজা নাজিমুদ্দিনকে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল করা হয়। ১৯৫১ সালে রাওয়ালপি-িতে এক জনসভায় বক্তৃতাকালে পাকিস্তানের পথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান আততায়ীর গুলিতে নিহত হলে খাজা নাজিমুদ্দিনকে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়। কেন্দ্রীয় প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর প্রথম ঢাকা সফরে এসে ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে এক জনসভায় বক্তৃতায় তিনি ঘোষণা দেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।
যে নাজিমুদ্দিন ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি মেনে নিয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন, তার এই ঘোষণা বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে চরম ধৃষ্টতা ও বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে বিবেচিত হয়। চারদিক থেকে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। অবশেষে বিভিন্ন বাংলা সমর্থক সংগঠনের প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। এবার আর শুধু তমদ্দুন মজলিস ও ছাত্রলীগ নয়। ইতিমধ্যে জন্ম নিয়েছে দেশের প্রথম বিরোধী রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ (১৯৪৯), পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ (১৯৫১), ইসলামী সংঘ আরও বাংলা সমর্থক অনেক সংস্থা। এদের সাথে যুক্ত হন মওলানা ভাসানী, আবুল হাশিম প্রমুখ খ্যাতনামা নেতাও। এদের সবাইকে নিয়েই গঠিত হয় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ। সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে প্রতিবাদ দিবস পালনের ডাক দেয়া হয়।
সরকার এই প্রতিবাদ দিবস ব্যর্থ করে দেয়ার লক্ষ্যে ২০ ফেব্রুয়ারি হঠাৎ অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে। এই উদ্ভূত পরিস্থিতিতে করণীয় বিবেচনায় ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ অফিসে সংগ্রাম পরিষদের জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সভায় গণতান্ত্রিক রাজনীতির স্বার্থে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার ব্যাপারে আওয়ামী নেতৃবৃন্দসহ অধিকাংশ সদস্য একমত হলেও কিছু সদস্য ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করলে আন্দোলনের অকাল মৃত্যু হবে এই অভিমতে অটল থাকেন। ফলে সিদ্ধান্ত হয়, দুটি অভিমতই ২১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠিতব্য ছাত্রসভায় উপস্থাপন করা হবে। ওই সভায় যে সিদ্ধান্ত হয় সেটাই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে।
পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠিত ছাত্রসভায় বিপুল ভোটে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এরপর ছাত্র-ছাত্রীরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছোট ছোট মিছিল নিয়ে জগন্নাথ হলে অধিবেশনরত সংসদের দিকে এগিয়ে যেতে চেষ্টা করে। এসব কর্মসূচিই ছিল শান্তিপূর্ণ। কিন্তু এই শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির বিরুদ্ধে পুলিশের গুলি বর্ষণের ফলে ভাষা-সমর্থক তরুণদের তাজা রক্তে রঞ্জিত হয় মেডিকেল কলেজের সামনের রাজপথ। পুলিশের গুলিতে তরুণদের শাহাদাতের খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তখন পূর্ব পাকিস্তানের চিফ মিনিস্টার ছিলেন নূরুল আমিন। ফলে শ্লোগানের ভাষা হয়ে দাঁড়ায় ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, নূরুল আমিনের কল্লা চাই, বাংলার প্রশ্নে আপোষ নাই’। এভাবেই তরুণদের চরম আত্মত্যাগের বিনিময়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি অপ্রতিরোধ্য রূপ ধারণ করে।
ভাষা আন্দোলনের এ নব অভ্যুত্থানের পর্বে ভাষা আন্দোলনের অঘোষিত মুখপত্র সাপ্তাহিক সৈনিক পালন করে ঐতিহাসিক ভূমিকা। ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনাবলী নিয়ে ২২ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক সৈনিকের লাল রঙে মুদ্রিত বিশেষ সংখ্যা। আন্দোলন সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ জানতে এ সময় সৈনিক অফিস ১৯ নম্বর আজিমপুরে সারাদিন প্রায় ভীড় লেগেই থাকত। পাঠকদের প্রয়োজন মেটাতে এসময় প্রত্যহ সৈনিকের একাধিক সংস্করণ প্রকাশ করতে হতো। এ অবস্থা ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলতে থাকে।
এ পটভূমিতেই ২৩ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত ৩টার দিকে পুলিশ এসে হানা দেয় ১৯ নম্বর আজিমপুরের গেটে। উদ্দেশ্য অধ্যাপক আবুল কাসেম ও আমাকে গ্রেফতার করা। এ আশঙ্কা আমরা আগেই করেছিলাম এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম কিছুতেই ধরা না দিতে। সেই সিদ্ধান্ত মোতাবেকই অধ্যাপক আবুল কাসেমের স্ত্রী বেগম রাহেলা কাসেম গেটের ভেতরে দাঁড়িয়ে গেট আটকিয়ে রেখে পুলিশের সাথে দীর্ঘ বচসা শুরু করে দেন। তাঁর বক্তব্য এত গভীর রাত্রে একটি পারিবারিক বাসভবনে প্রবেশের চেষ্টার বদলে তারা যেন সকালে আসেন। এভাবে পুলিশের সঙ্গে মিসেস কাশেমের দীর্ঘ বচসার সুযোগে আমরা বাসার পিছনের জঙ্গল ও গোরস্থান দিয়ে পার হয়ে দূরে সরে পড়তে সক্ষম হই। পরে পুলিশ বাসায় ঢুকলেও আমাদের আর সন্ধান পায়নি।
বাসা ত্যাগ করে আমরা প্রথমে যাই শেখ সাহেব বাজার রোগের একটা পরিচিত মেসে। পরে ভোর হলে পরিচিত এক বাসায় চলে যান অধ্যাপক কাশেম আর আমি চলে যাই আমার পূর্বতন জায়গীর বাড়ি। আমাদের দু’জনের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করতো আমার ছাত্রী নিলুফার খাতুন। আমরা এভাবে ঢাকায় অবস্থানের পর অধ্যাপক আবুল কাশেমের জামালপুর জেলাস্থ শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে ট্রেনযোগে ঢাকা ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেই। ঐ একই ট্রেনে অধ্যাপক কাশেমের স্ত্রী রাহেলা কাশেমেরও তার পিত্রালয়ে যাবার সিদ্ধান্ত হয়। তবে তারা ওঠেন ঢাকা স্টেশন থেকে, আমরা উঠি তেজগাঁও থেকে। কাশেম সাহেবের বড় ছেলে কামরুল একেকবার আমাকে দেখে আমার কাছে আসতে চায়, আবার কিছুটা অপরিচিত লাগায় পিছিয়ে যায়। এর কারণ, সারাজীবন আমি দাড়ি রাখলেও পুলিশকে ফাঁকি দিতে ঐ সময় আমাকে দাড়ি শেভ করতে হয়ে ছিল।
জামালপুর জেলার যে স্টেশনে আমাদের নামার কথা তার নাম দাগী। আগের থেকেই দু’খানা সাইকেল রেডি ছিল সেখানে। দু’জন দু’খানি সাইকেলে চড়ে বেশ দূরে যথাসময়ে যথাস্থানে পৌঁছে গেলাম। অধ্যাপক কাশেমের শ্বশুর বাড়িতে কয়েক সপ্তাহ ভালোই কাটল। কিন্তু পরে জানা গেল, সেখানে সরকারের গোয়েন্দা বিভাগ থেকে খোঁজখবর নেয়া শুরু হয়েছে। অতএব, পুনরায় স্থান পরিবর্তনের তাগিদ। তবে এবার আর দু’জন এক সাথে নয়। অধ্যাপক কাশেম রওনা হলেন চট্টগ্রামের দিকে। আর আমি কুষ্টিয়া। বলাবাহুল্য, ঢাকার বাইরে তখন তমদ্দুন মজলিসের সব চাইতে শক্তিশালী দুটি ঘাঁটিই ছিল চট্টগ্রাম ও কুষ্টিয়া।
কুষ্টিয়া গিয়ে আমি উঠলাম বর্তমান সিরাজদ্দৌলা রোডস্থ সাবেক মন্ত্রী শামসুদ্দিন আহমদের ভাই ডা. সদরুদ্দিন আহমদের বাসায়। ডাক্তার সাহেবের চেম্বারের একটা রুম ছিল কঠিন রোগীদের জন্য। সেখানে একটি রুমে আমাকে দূরারোগ্য যক্ষ্মা রোগী হিসেবে ঘোষণা দিয়ে আটকে রাখা হলো। তখন যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসা ছিল না। কিছুদিন পরে এখানেও আমার সম্পর্কে গোয়েন্দা পুলিশ খোঁজখবর নেয়া শুরু করলে সেখান থেকে আমাকে সরিয়ে কুষ্টিয়া শহর থেকে বহু দূরের ভেড়ামারা রেলস্টেশন থেকে বহু দূরে ব্যারিস্টার আবদুল হকের পিতার গ্রামের বাড়িতে স্থানান্তরিত করা হলো।
সেখানে কয়েক সপ্তাহ কাটানোর পর জানা গেল, ভাষা আন্দোলন উপলক্ষে পুলিশি নতুন তৎপরতা বন্ধ হয়েছে। নতুন করে আর কাউকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না। আরও বড় কথা, ভাষা আন্দোলনের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত অনেককে মুক্তি দেয়াও শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রায় তিন মাস সময় চলে গেছে। এ খবর পেয়ে আমি ঢাকায় ফিরে এলাম এবং রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নবনিযুক্ত কনভেনর আতাউর রহমান খানের সোয়ারিঘাট লেনস্থ বাসায় গিয়ে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করলাম।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন