মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তার সাম্প্রতিক বিবৃতিতে পাকিস্তানকে ‹বিশ্বের অন্যতম বিপজ্জনক দেশ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন এবং এর পারমাণবিক অস্ত্রের নিরাপত্তা বিধিমালা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এটি পাকিস্তানে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে, যদিও হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র পরে বাইডেনের মন্তব্যকে অস্বীকার বলেছেন যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জোর দিয়ে একটি স্থিতিশীল এবং সমৃদ্ধ পাকিস্তান চান। বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ক্যালিফোর্নিয়ায় বেসরকারি ডেমোক্রেটিক পার্টির তহবিল সংগ্রহের সময় মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে কথা বলার সময় বাইডেন বলেন, ‘আমি মনে করি যে, হয়ত বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশগুলোর একটি: পাকিস্তান। কোনো সমন্বয়হীন একটি পারমাণবিক অস্ত্র।’ শনিবার হোয়াইট হাউস তার মন্তব্যের একটি প্রতিলিপি প্রকাশ করলে পাকিস্তানে সাধারণ হনঞণের মধ্যে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া শুরু হয়।
যদিও ইসলামাবাদে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডোনাল্ড ব্লোমকে বাইডেনের অযাচিত মন্তব্যের ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য তলব করা হয়েছিল, কিন্তু পাকিস্তান সরকার বাইডেন সরকারের সমলোচনা করার পরিবর্তে ‘বন্ধুত্বপূর্ণ এবং পারস্পরিক উপকারী’ সম্পর্ক খুঁজতে বেশি আগ্রহী বলে প্রতীয়মান হয়েছে। ঠিক যেমনটি পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব জওহর সেলিম বলেছেন, ‘পাকিস্তান-মার্কিন সম্পর্কের ইতিবাচক গতিপথ বজায় রাখা ও আঞ্চলিক সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং বিশ্ব শান্তি জন্য উভয় পক্ষের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা অপরিহার্য ছিল।’ দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রী এবং পিপিপি চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুট্টো-জারদারিও বাইডেনের বিবৃতিটিকে অন্যদিকে ঘোরানোর চেষ্টা করেছেন এই বলে যে, এটি একটি তহবিল সংগ্রহের অনুষ্ঠান ছিল এবং কোনও আনুষ্ঠানিক বিবৃতি নয়। করাচিতে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট বাইডেনের মন্তব্যে আমি বিস্মিত। আমি বিশ্বাস করি এটি ঠিক এই ধরণের ভুল বোঝাবুঝি যা ঘনিষ্ঠতার অভাব হলে তৈরি হয়।’
তবে, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এবং পিটিআই চেয়ারম্যান ইমরান খান সহ অন্যরা এই ব্যাখ্যায় সন্তষ্ট নন। পাকিস্তানকে
বিশ্বের অন্যতম বিপজ্জনক দেশ হিসেবে আখ্যা দেয়ার সর্বশেষ বিস্ফোরক মন্তব্য এমন যেকোনো হৃদয় ও মনকে উস্কে দেবে, যা ইতিমধ্যেই বিশ^ব্যাপি মার্কিন নেতৃত্বে পশ্চিমাদের মুসলিম নিপিড়নের কারণে মার্কিন বিরোধী মনোভাব ধারণ করছে। পাকিস্তানের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান, যিনি দীর্ঘদিন ধরে তার সরকারের উৎখাতের পিছনে মার্কিন ষড়যন্ত্রের অভিযোগ করে আসছেন, শনিবার টুইট করেছেন যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বিবৃতি পাকিস্তানে ‘আমদানি করা’ বর্তমান সরকারের পররাষ্ট্র নীতির সম্পূর্ণ ব্যর্থতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের ‘পুনর্নিমান সম্পন্নের’ দাবির বৈকল্য প্রকাশ করেছে। তিনি প্রশ্ন করেন, ‘কোন তথ্যটি বাইডেনকে এই অযৌক্তিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পরিচালিত করেছে?’
ইমরান আরও জিজ্ঞাসা করেন, ‘পাকিস্তান কখন আগ্রাসন দেখিয়েছে, বিশেষ করে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ পরবর্তী যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীতে, যা বিশ্বজুড়ে যুদ্ধে লিপ্ত?’ ইমরান বলেছেন যে, প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তিনি জানতেন যে পাকিস্তানের বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ পারমাণবিক নিরাপত্তা এবং নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাগুলির মধ্যে একটি রয়েছে। ইমরানের দাবির যৌক্তিকতা রয়েছে। পিটিআই নেতা এবং প্রাক্তন তথ্যমন্ত্রী চৌধুরী ফাওয়াদ এটিকে নিখুঁতভাবে টুইট করেছেন। তিনি বলেছে যে, বাইডেনের বক্তব্য প্রমাণ করে যে, কেন পিটিআই সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘তাদের (বর্তমান শাসকদের) ব্ল্যাকমেইল করা সহজ। ইমরান খান ছাড়া কেউ বাইডেনের বক্তব্যের নিন্দা করেননি। এটা খুবই সত্য।’
মার্কিন মিত্র এবং প্রতিবেশি ভারতে প্রায়শই ইউরেনিয়াম চুরি হওয়ার খবর পাওয়া যায়। দেশটির পারমাণবিক কর্মসূচীকে বিশ্বের সবচেয়ে কম নিরাপদ হিসাবে বিবেচনা করা হয়, যেখানে পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচি এখন পর্যন্ত কোনো দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়নি। কিন্তু ভারতের অমানবিক পরমাণু দুর্ঘটনা বা মুসলিম নিপিড়ন নিয়ে পশ্চিমা বিশ^ নিজের মুখে তালা মেরে রাখে। যখনই পশ্চিমারা কোনও মুসলিম জাতিকে অন্যায়ভাবে দোষারোপ করে, তখন পশ্চিমা চাটুকাররা কেউ নিন্দা জানানোর সাহস করে না। যাহোক, হুট করে বিনা নোটিশে বিশ^ মোড়ল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের এধরণের মন্তব্যে পেছনে কোনও কারণ তো রয়েছে। বাইডেন কি পাকিস্তান এবং সউদী আরব সম্পর্কে বিবৃতি দিয়ে আমেরিকানদের মধ্যে তার ক্ষয়িষ্ণু খ্যাতি পুনরুদ্ধার করে আগামী নির্বাচনে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চান? নাকি তিনি ‘সমন্বয়হীন একটি পারমাণবিক দেশ’ বলতে আসলে নিজের দেশ যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝাতে চেয়েছেন?
যুক্তরাষ্ট্র সমুদ্রসীমাগুলির সামরিকীকরণের পাশাপাশি অন্যান্য দেশগুলির শাসক পরিবর্তন সহ তাদের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার প্রবণতা রয়েছে। মার্কিন সীমানা থেকে বহু দূরে গুয়ানতানামো, আবু ঘ্রাইব এবং বাগরামের বন্দি শিবিরে মানবতা বহির্ভুত নির্যাতনের জন্যও দায়ী যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু কেউ তাকে যুদ্ধাপরাধী আখ্যা দেয়ার সাহস করে না। পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের জন্য হুমকি কারণ তার পারমাণবিক অস্ত্রের উপর নিজেরই যথাযথ নিয়ন্ত্রণ নেই। ২০০৭ সালে ৬টি সক্রিয় পরমাণু সহ ই৫২ মার্কিন বোমারু বিমান আকাশে ওঠার পর ঘন্টার পর ঘন্টা পর হয়ে গেলেও কাউকে জানানো হয়নি।
পিটিআই নেতা এবং প্রাক্তন মানবাধিকার মন্ত্রী শিরীন মাজারি অন্তত যুক্তরাষ্ট্রকে পরমাণু অস্ত্রে দায়িত্বজ্ঞানহীন পরাশক্তি› বলে অভিহিত করার সৎ সাহস করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এমনকি আপনার নিজের লোকেরাও নিরাপদ নয়, যখন বন্দুকধারীরা হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।’ শিরিন বাইডেনকে কিছুটা লজ্জা সংরক্ষণ করতে আহ্বান করেছেন। লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। সূত্র : ডন, ট্রিবিউন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন