আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রশাসনে কর্মরত সরকারবিরোধী আমলারা ১৯৯৬ সালের ২৩ মার্চ ‘জনতার মঞ্চ’ এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ‘উত্তরা ষড়যন্ত্রে’র (আওয়ামী লীগের ভাষায়) মতো কোনো ‘ষড়যন্ত্র’ করতে না পারেন, সে বিষয়ে গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সতর্ক করা হয়েছে। প্রশাসনে কর্মরত সন্দেহভাজন প্রায় ৪০ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার গতিবিধি, মোবাইল ফোনে যোগাযোগসহ দেশে-বিদেশে তাদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে পদোন্নতি বঞ্চিত ১৭ জন কর্মকর্তা রয়েছেন। বর্তমান সচিব ও অতিরিক্ত সচিবদের সঙ্গে অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন সচিবও সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্রে যুক্ত রয়েছে এমন গুজব রয়েছে। প্রভাসনের অভ্যন্তরে সিন্ডিকেট তৈরি অভিযুক্ত এসব কর্মকর্তার কেউ কেউ লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন বলেও তথ্য পেয়েছে সরকার। ইতোমধ্যেই একজন সচিব ও তিনজন পুলিশ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। আরো বেশ কয়েকজন সচিব ও অতিরিক্ত সচিবকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হতে পারে বলে জোর গুজব চলছে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়ে চর্তুমুখী অস্থিরতা বিরাজ করছে। আগামী শনিবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ড, ফরহাদ হোসেন অস্ট্রেলিয়ার থেকে দেশেন আসার পরে ৫ থেকে ৬ জন সচিব ও অতিরিক্ত সচিবের বিষয় সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তাদের বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হবে কি-না, তা এখনো খোলাশা করে কেউ বলতে পারছে না প্রশাসনের কর্মকর্তারা। এ মাসে যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি এবং জেলা প্রশাসক পদে নিয়োগ দেয়ার কথা থাকলেও তা পেছিয়েছে বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কে এম আলী আজম ইনকিলাবকে বলেন, প্রশাসনে কোনো অস্থিরতা নেই। স্বাভাবিকভাবে চলছে।
এদিকে গত রোববার ‘জনস্বার্থে’ অবসরে যাওয়া সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার সচিব মকবুল হোসেনের রিপোর্ট করা আর্থিক কেলেঙ্কারিকে কেন্দ্র করে দুর্নীতি দমন কমিশন কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে কি-না তা জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট। আদালত দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খানকে দুদকের কাছ থেকে তথ্যসংগ্রহ করে ২৭ অক্টোবরের মধ্যে আদালতে হাজির করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ যখন দিশেহারা অবস্থায় তখন বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের মাত্রাও বেড়ে গেছে। যাতে করে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ১৯৯৬ সালের মতো জনতার মঞ্চ করতে না পাবে, সে জন্য আমলাদের লাগাম টেনে ধরতে চায় সরকার।
এমন পরিস্থিতিতে ২০০৪ সালের ২২ মার্চ আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলের মতো ‘৩০ এপ্রিল ট্রাম্পকার্ড’ দেয়ার মতো বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আমানউল্লাহ আমান ১০ ডিসেম্বর ট্রাম্পকার্ড ট্যাম্পকার্ড দিয়েছেন। ১০ ডিসেম্বর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য আতঙ্কের তারিখ। গত বছরের এ দিন আন্তর্জাাতিক মানবাধিকার দিবসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র র্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। ফলে আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির ঘোষিত মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সরকারের ভেতরে অস্থিরতা চলছে। এই অস্থিরতার মধ্যেই রোববার তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মকবুল হোসেনকে এক বছর আগেই বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর ঘটনায় প্রশাসনজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। এর রেশ কাটতে না কাটতেই মঙ্গলবার তিনজন পুলিশ সুপারকে জনস্বার্থে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। তারা হলেনÑ পুলিশ সুপার (টিআর) মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চৌধুরী, পুলিশ সুপার (অপরাধী তদন্ত বিভাগ) মো. দেলোয়ার হোসেন মিঞা ও মীর্জা আব্দুল্লাহেল বাকী। আরও বেশ কয়েকজন সচিব ও অতিরিক্ত সচিবকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হতে পারে। এমন খবরে প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়ে বিরাজ করছে অস্থিরতা।
জনপ্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা জানান, সাম্প্রতিক সময়ে পদোন্নতি ও বিভিন্ন পদায়ন নিয়ে আমলাদের মধ্যে এক ধরনের অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। এখন যারা চাটুকার এবং বিভিন্নভাবে সুযোগসন্ধানী তারাই সবচেয়ে ভালো অবস্থায় রয়েছেন। যারা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ কখনো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বা আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিলেন না। যোগ্যতা বিবেচনা না করে মুখ চিনে প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের তদবিরে বেশ কয়েকজনের সচিব হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এটি নিয়ে যেমন আওয়ামীপন্থি আমলাদের মধ্যে অসন্তোষ এবং হতাশা তৈরি হয়েছে, তেমনি পদোন্নতিবঞ্চিত বিএনপি-জামায়াতপন্থি আমলারাও এখন সঙ্ঘবদ্ধ। তারা সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলতে এমন সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, যেগুলো সরকারের জন্য আত্মঘাতী হচ্ছে। অন্যদিকে তারা বিভিন্ন তথ্য পাচার করছে বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের কাছে, সরকারের গোপন তথ্য চলে যাচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। তারা প্রশাসনে পদোন্নতি ও বঞ্চনা নিয়ে আমলাদের উসকে দিচ্ছে। কর্মচারীদের বেতনভাতা বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলনে যাওয়ার জন্য নানারকম প্ররোচণা দেয়া হচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ার অজুহাত দাঁড় করিয়ে প্রশাসনের তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের মাঠে নামানোর একটা নীরব প্রক্রিয়া চলছে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, লোডশেডিং ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে জনমনে অসন্তোষ রয়েছে। এখন যদি সচিবালয়ে একটা অস্থিরতা তৈরি করা যায়, তাহলে বিষয়টি সরকারের জন্য আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে।
২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির বাতিল হওয়া নির্বাচনের ২০০৬ সালের ২৪ নভেম্বর রাতে উত্তরায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার জ্বালানি উপদেষ্টা মাহমুদুর রহমানের উত্তরার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে (আর্টিসান সিরামিক) পুলিশসহ জনপ্রশাসনের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা গোপনে বৈঠক করেছিলেন, যা তখন উত্তরা ষড়যন্ত্র নামে পরিচিতি লাভ করে।
সাবেক সিনিয়র সচিব হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বা দুর্নীতির অভিযোগসহ যেকোনো কারণেই বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর ঘটনা বিভিন্ন সরকার আমলে হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে এটা করা হয় সতর্ক করার জন্য। যেমন দুর্নীতির দায়ে কাউকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হলে অন্য কর্মকর্তারা দুর্নীতি করতে ভয় পাবে।’ তিনি বলেন, ‘সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮-এর ধারা ৪৫ অনুযায়ী কোনো সরকারি কর্মচারীর চাকরির মেয়াদ ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ার পর যেকোনো সময় সরকার জনস্বার্থে তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠাতে পারে। এ ছাড়া কোনো কর্মকর্তা নিজেও স্বেচ্ছায় অবসরে যেতে পারেন। এ ক্ষেত্রে তিনি অবসরকালীন সব সুবিধা পাবেন।’
অন্যদিকে আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির ঘোষিত মহাসমাবেশকে মুখে গুরুত্ব না দিলেও ভেতরে ভেতরে সতর্ক রয়েছে সরকার ও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে মুক্ত করে ওই মহাসমাবেশে হাজির করা হবে এবং ১০ ডিসেম্বরের পর খালেদা জিয়ার কথায় দেশ চলবে-বিএনপি নেতারা এমন ঘোষণাও দিয়েছেন। তবে বাস্তবে এ ঘোষণার কোনো ধরনের ভিত্তিই নেই বলে জানিয়েছেন সরকারের একাধিক মন্ত্রী। ঘোষিত মহাসমাবেশ ঘিরে ‘সরকারপতন’-এর কঠোর আন্দোলনের হুমকিকে কঠোরভাবেই রাজপথে মোকাবিলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। প্রশাসনের দায়িত্বশীলরা আশঙ্কা করছেন বিএনপি সারা দেশে বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে চাইছে। দেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনার ছক আঁকছে। এ কারণেই তারা যেন আন্দোলনের নামে বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে না পারে, সেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে সরকার। তাদের যেকোনো ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হবে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে বিএনপিকে সভা-সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের সুযোগ দেয়া হলেও নাশকতা করতে দেয়া হবে না। এমনকি তাদের মোকাবিলায় রাজনৈতিক নানা কর্মসূচি নিয়েও মাঠে থাকবে আওয়ামী লীগ। সরকারবিরোধীরা যেন বড় ধরনের কোনো কর্মসূচি পালন করতে না পারে, সে জন্য পাড়া-মহল্লায় অবস্থান নেবে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা।
সরকারের উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো যেন সরকারবিরোধী কঠোর আন্দোলন করতে না পারে, সে জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঠে আরো তৎপর রয়েছে। বিএনপিকে কোনো ধরনের বড় জমায়েত করতে দিলেও সেখানে থাকবেÑ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারি। তারা সমাবেশের আড়ালে নাশকতা ও সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটানোর পরিকল্পনা যাতে করতে না পারে, সে ব্যাপারে বাড়ানো হবে গোয়েন্দা নজরদারি। একইসঙ্গে আগামী বছরের জানুয়ারি থেকে মিডিয়ার ওপরেও থাকবে কঠোর নজরদারি। প্রতি সপ্তাহে না হোক, মাসে একবার হলেও মিডিয়া হাউসগুলো মনিটরিং করবে সরকারের একটি সেল। মনিটরিংয়ের মাধ্যমে দেখা হবে, কোন মিডিয়া সরকারবিরোধী সংবাদ বেশি প্রচার বা প্রকাশ করছে। এতে সরকারের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন হচ্ছে কিনা?
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন