২০০৫ সালে বাগেরহাটের চাঞ্চল্যকর মনু হত্যা মামলার মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত ও ১৭ বছর ধরে দেশে ও ভারতে কবিরাজের ছদ্মবেশে পলাতক আসামি হেমায়েত ওরফে জাহিদ কবিরাজকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
র্যাব বলছে, হত্যার পর সে বিভিন্ন জায়গায় ছদ্মবেশে পালিয়ে কবিরাজি করে। এরপর ২০০৮ সালে পুনরায় অবৈধ পথে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে ফিরে সে নিজের আসল পরিচয় গোপন করার জন্য লম্বা চুল ও দাড়িওয়ালা ছবি ব্যবহার করে তার আসল নাম ও স্থায়ী ঠিকানা পরিবর্তন করে মো. জাহিদুল ইসলাম ছদ্মনাম ব্যবহার করে নতুন এনআইডি কার্ড তৈরী করে। নারীদের টার্গেট করে জ্বীনের বাদশার মাধ্যমে নারীদের বিভিন্ন শারীরিক, মানসিক, আর্থিক ও পারিবারিক সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে সে কবিরাজি ব্যবসা চালায়। বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হলেও জ্বীনের বাদশার মাধ্যমে সে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় বলেও র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে।
বুধবার রাতে তাকে রাজধানীর কেরানীগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার করে
বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ানবাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন৷
র্যাব জানায়, ২০০৫ সালের অক্টোবর মাসে বাগেরহাট জেলার সদর এলাকায় মনু বেগম এক নারীর বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করা হয়। উক্ত হত্যাকান্ডের ঘটনায় হেমায়েতসহ ৫ জনকে আসামি করে ভুক্ত ভোগীর বোন বাদী হয়ে বাগেরহাট থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করে। যার মামলা নম্বর-৯।
বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধারের ঘটনায় এলাকায় চাঞ্চল্যের তৈরি হয় কিন্তু মামলার অন্যতম আসামি হেমায়েত ওরফে জাহিদ কবিরাজ পলাতক থাকে। মামলাটির তদন্ত শেষে সাক্ষ্য প্রমানের ভিত্তিতে ২০০৯ সালের জুন মাসে আদালত আসামি হেমায়েতকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেন।
গ্রেপ্তারের সময় কবিরাজি চিকিৎসায় ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের আংটি- ১২৯টি, বক্স ১টি, শঙ্খ ৩টি, আলাদিনের চেরাগ ১টি, ক্রেস্ট ২টি, কবিরাজি সংক্রান্ত বই-১৫টি, পিতলের পাঞ্জা ১টি ও কবিরাজি সংক্রান্ত অন্যান্য সরঞ্জামাদি।
গ্রেপ্তার হেমায়েত র্যাবকে জানায়, সে ১৫-১৬ বছর বয়স থেকে কবিরাজি পেশা শুরু করে। কবিরাজির পেশার মাধ্যমে সে নানাভাবে মানুষকে প্রতারিত করে অর্থ উপার্জন করত। তার বাবা কবিরাজি পেশায় থাকায় সে তার বাবার কাছ থেকে কবিরাজির বিভিন্ন পদ্ধতি ও কৌশল শিখে নেয়। নারীরাই ছিল তার প্রতারণার মূল টার্গেট।
র্যাব কর্মকর্তা খন্দকার মঈন বলেন, ২০০৩ সালে সে তার স্ত্রী সন্তানসহ পিরোজপুর থেকে বাগেরহাটে এসে কবিরাজি ব্যবসা শুরু করে। কবিরাজি পেশায় তার অন্যতম সহযোগী ছিল উক্ত হত্যা মামলার অপর মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামি সোবহান। ২০০৫ সালে জানুয়ারি মাসে সোবহান ভিকটিম মনুকে মাথা ব্যাথার রোগকে মানসিক রোগ বলে আখ্যায়িত করে কবিরাজি চিকিৎসার জন্য হেমায়েত এর কাছে নিয়ে আসে।
তিনি বলেন, ভিকটিম মনুর স্বামী ঢাকায় চাকরি করত এবং প্রতিমাসে সংসারের খরচ চালানোর জন্য মনুর কাছে টাকা পাঠাত। মনু তার জমানো টাকা দিয়ে কাপড়ের ব্যবসা করত এবং নারী উদ্যোক্তা হয়ে উঠেন। কাপড়ের ব্যবসা করে এবং স্বামীর পাঠানো টাকা জমিয়ে মনুর কাছে লক্ষাধিক টাকা জমা হয়। এই অর্থের প্রতি হেমায়েত এর লোলুপ দৃষ্টি পড়ে। হেমায়েত মনুর সরলতার সুযোগে তার টাকা পয়সা হাতিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যে মনুকে টার্গেট করে।
র্যাব মুখপাত্র বলেন, গ্রেপ্তার হেমায়েত ভিকটিম মনুকে কিছু ভেষজ উপাদানের মাধ্যম নিয়মিত ঘুমের চিকিৎসা দেয়া শুরু করে। একপর্যায়ে মনুকে তার যাবতীয় সম্পত্তির দলিলপত্র এবং টাকা পয়সা শত্রু পক্ষের জ্বীনের আক্রমনে পড়তে পারে বলে ভয় ভীতি দেখিয়ে তার যাবতীয় সহায় সম্পত্তির দলিলপত্র নিরাপত্তার জন্য হেমায়েত পীরের কাছে জমা রাখার জন্য মনুকে উদ্বুদ্ধ করে। নিয়মিত ভেষজ উপাদান সেবনের ফলে ভিকটিম মনুর ঘুম হয় এবং মাথা ব্যাথার প্রবণতা কিছুটা কমে আসলে হেমায়েত এর উপর ভিকটিমের আস্থা তৈরী হয়।
কমান্ডার খন্দকার মঈন বলেন, পরবর্তীতে ভিকটিম সরল বিশ্বাসে তার টাকা পয়সা ও সম্পত্তির দলিল হেমায়েত এর কাছে জমা রাখে। মনুর সরল বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী হেমায়েত সহযোগীসহ তাকে চেতনানাশক ঔষধ খাইয়ে দলিলপত্রে টিপসই নিয়ে তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্চিত করার চেষ্টা করে। একপর্যায়ে মনুর জ্ঞান ফিরে আসলে সে পুলিশের কাছে গিয়ে অভিযোগ করার জন্য উদ্ধত হলে মনুর সাথে ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে সহযোগীর সহযোগিতায় হেমায়েত মনুকে কুপিয়ে এবং শেষ পর্যন্ত গলা কেটে তার হত্যা নিশ্চিত করে। এরপর রাতের অন্ধকারে মনুর গলাকাটা লাশ বস্তাবন্দি করে হেমায়েতের বাড়ির সামনের খালের অপর পার্শ্বে ধান ক্ষেতে লুকিয়ে রাখে।
গ্রেপ্তারকে জিজ্ঞাসাবাদে র্যাবের এই কর্মকর্তা জানায়, হত্যাকান্ডের পর বাগেরহাট সদর থানায় হত্যা মামলা দায়েরের খবর পেয়ে সে বাগেরহাট থেকে পালিয়ে যশোরে একটি মাজারে গিয়ে আশ্রয় নেয়। পরবর্তী দিন অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে আজমীর শরীফ মাজারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করে। সেখানে সে কবিরাজি পেশাসহ বিভিন্ন ধরণের প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে ৩ বছর অবস্থান করে।
তিনি আরও বলেন, ২০০৮ সালে পুনরায় অবৈধ পথে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে ফিরে এসে ঢাকার মিরপুরে বসবাস শুরু করে। এসময় সে নিজের আসল পরিচয় গোপন করার জন্য লম্বা চুল ও দাড়িওয়ালা ছবি ব্যবহার করে তার আসল নাম ও স্থায়ী ঠিকানা পরিবর্তন করে মো. জাহিদুল ইসলাম ছদ্মনাম ব্যবহার করে একটি নতুন এনআইডি কার্ড তৈরী করে। সে বিভিন্ন সময়ে একাধিক বিয়ে করে।
র্যাব কর্মকর্তা মঈন বলেন, মিরপুরে থাকাকালীন গ্রেপ্তার হেমায়েত পুরাতন পেশা কবিরাজির মাধ্যমে সাধারন মানুষের সাথে প্রতারণা করতে থাকে। সে মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের তাবিজ, স্বামী-স্ত্রীর কলহ দূরীকরণ তাবিজ, বশীকরণ তাবিজ ইত্যাদির মাধ্যমে সাধারন মানুষের কাছ থেকে বড় অংকের টাকা নিয়ে প্রতারণা করত।
র্যাব জানায়, মিরপুরে ৩ বছর অবস্থানের পর তার প্রতারণার বিরুদ্ধে জনরোষ সৃষ্টি হলে সে ঠিকানা পরিবর্তন করে কিছুদিন আদাবর, কিছুদিন কেরানীগঞ্জ এবং সর্বশেষে গত ৫ বছর ধরে মোহাম্মদপুর বসিলায় বিভিন্ন স্থানে বসবাস করছে। বসিলায় একইভাবে সে কবিরাজি ব্যবসা করতে থাকে। তাবিজ দেয়ার পাশাপাশি সে তার বশবর্তী জ্বীনের বাদশার মাধ্যমে মানুষের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের কথা বলে নতুনভাবে প্রতারণার মাধ্যমে সাধারন মানুষের কাছ থেকে প্রচুর অর্থ হাতিয়ে নেয়।
সংবাদ সম্মেলনে র্যাব জানায়, সে নারীদের টার্গেট করে জ্বীনের বাদশার মাধ্যমে নারীদের বিভিন্ন শারীরিক, মানসিক, আর্থিক ও পারিবারিক সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে সে কবিরাজি ব্যবসা চালিয়ে আসছে। ২০১২ সালে দারুস সালাম থানায় মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে তার বিরুদ্ধে একটি মামলা রয়েছে।
এছাড়াও, ২০১৭ সালে সে তার কবিরাজি কাজে ব্যবহৃত কষ্টি পাথরের মূর্তি রাখার দায়ে চোরাকারবারী হিসেবে আইন-শৃৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গ্রেপ্তার হয়ে দেড়মাস জেলে থাকে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ধোকা দেয়ার জন্য সে বারবার তার অবস্থান পরিবর্তন করে থাকে।
গত দুই মাসের মধ্যে সে কিছুদিন পর পর পিরোজপুর, যাত্রাবাড়ী, মোহাম্মদপুর, কেরানীগঞ্জ এবং মিরপুরে তার অবস্থান পরিবর্তন করেছে। তার পরিচয় গোপন রাখার জন্য সে মাঝে মাঝেই তার চুল দাড়ি রং পরিবর্তন, পোশাকের ধরন পরিবর্তন করেছে বলেও জানান র্যাব মুখপাত্র।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন