মোবায়েদুর রহমান : বিশ্ব রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে চলেছে। ’৯০-এর দশক থেকে এই পরিবর্তন ঘটা শুরু হয়েছিল। প্রথম প্রথম কেউই এই মন্থর পরিবর্তনকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেননি এবং সে কারণে তেমন আমলও দেননি। কিন্তু যতই দিন যেতে থাকে ততই সেই পরিবর্তন ধীরে ধীরে অবয়ব গ্রহণ করতে থাকে। ’৯০-এর দশকে যেটি ছিল স্যামুয়েল হান্টিংটনের মস্তিষ্কজাত কল্পনা, আজ এই ২০১৬তে সেই কল্পনাই বাস্তবে রূপ নেবে কিনা সেটি নিয়ে রাষ্ট্র ও সমাজ বিজ্ঞানীদের মধ্যে গবেষণা চলেছে। ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে বিশ্বের ২ পরাশক্তির অন্যতম সোভিয়েট ইউনিয়নের পতন ঘটেছে। সোভিয়েট ইউনিয়নের জঠর থেকে উঠে এসেছে ১৫টি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। ফলে সোভিয়েট ইউনিয়ন আর ২য় পরাশক্তি থাকেনি। এর ফলে আমেরিকা বিশ্বের বুকে একক এবং একমাত্র পরাশক্তি হিসেবে উত্থিত হয়েছে। আমেরিকার একমাত্র পরাশক্তি হিসেবে উত্থান ঘটার ফলে আমেরিকা নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। এটি হল ইসলামী বিশ্বের একটি অংশের চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জটি ইতোপূর্বে ছিল না। বরং ইসলামী জাহানের এই অংশটি এর অব্যবহিত পূর্বে বিশ্ব রাজনীতির মেরুকরণে আমেরিকার সাথেই ছিল। এখানেই এসে পড়েন সারা পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টিকারী সমাজ বিজ্ঞানী স্যামুয়েল হান্টিংটন।
সারা দুনিয়াবাসী যেমন দেখেছেন তেমনি হান্টিংটনও দেখেছেন যে, সোভিয়েট ইউনিয়ন খ- বিখ- হওয়ার ফলে আমেরিকা তথা পুঁজিবাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আর সোভিয়েট ইউনিয়ন রইল না। অনুরূপভাবে মার্কিন পুঁজিবাদেরও প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়াল ইসলাম। এটিই হল কঠোর সত্য। এরপর বিশ্ব রাজনীতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, মার্কিন শক্তিই বা কতদূর একচেটিয়া প্রাধান্য বিস্তার করে রাখবে, সোভিয়েট শক্তিমত্তা নিয়ে রাশিয়ার পুনরুত্থান ঘটবে কিনা, উদিয়মান বিশ্বশক্তি হিসেবে চীন কতদূর যাবে, আরেকটি আঞ্চলিক শক্তি ভারতের অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে এবং এসবের মধ্যে মুসলিম জাহান কোথায় তার আসন গ্রহণ করবে, সেগুলো নিয়ে সেই ৯০ দশক থেকেই গবেষণা শুরু হয়েছে। তারপর ২০ বছর পার হয়ে গেছে। এই ২০ বছর ধরে গবেষণা চলছে তো চলছেই।
এসব গবেষণাকে উস্কে দিয়েছে হান্টিংটনের সেই দুনিয়া কাঁপানো থিসিস, যেটির নাম Islam and the West: The Clash of Civilizations and the Remaking of World Order. তার এই থিসিস বা গবেষণা পত্রটি প্রথমে ফরেন অ্যাফেয়ার্স জার্নালে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে এটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত হয়। যারা সমকালীন রাজনীতি নিয়ে লেখাপড়া করেন তারা এসব খবর বিলক্ষণ জানেন। পত্রপত্রিকায় যেসব আলোচনা চলছে সেসব আলোচনায় সভ্যতার সংঘাত শুধুমাত্র ইসলাম এবং পাশ্চাত্য সভ্যতার সংঘাতকেই বেশি করে ফোকাস করা হয়েছে। কিন্তু হান্টিংটন অনেক বিষয়ের ওপরেই আলোকপাত করেছেন। যেমন কতগুলো প্রধান সভ্যতা আছে সেগুলোর একটি তালিকা তিনি দিয়েছেন। তাদের কার কার মধ্যে সভ্যতার সংঘাত হতে পারে তার একটি আভাস তিনি দিয়েছেন। এই সভ্যতার সংঘাতে কারা হবে প্রধান প্লেয়ার, সেটিও তিনি গোপন রাখেননি। আমেরিকা, চীন, রাশিয়া প্রভৃতি বিশ্ব শক্তির কথা তো বলা হয়েছেই, মুসলিম জাহান ও ভারতের কথাও বলা হয়েছে। আলাদাভাবে বলা হয়েছে তুরস্কের কথা। তার এসব ভবিষ্যৎ বাণীর সাথে হয়ত অনেকেই একমত হবেন না। আবার অনেকে একমত হচ্ছেনও। কিন্তু যেটি চিন্তার খোরাক জুগিয়েছে সেটি হল, ইসলাম এবং পাশ্চাত্য সভ্যতার সংঘাত। তার থিসিসের এ অংশ অনেকখানিই বাস্তবে রূপ লাভ করছে। তিনি যেভাবে তার ক্রমবিকাশ চিত্রিত করেছেন সেভাবে হয়ত সেভাবে পুরাপুরি ঘটছে না। কিন্তু একটি বিষয়ে কারও কোনো দ্বিমত নাই যে, যে ইসলাম বা মুসলিম জাহানের বৃহত্তর অংশ এক সময় দৃঢ়ভাবে পশ্চিমা ব্লক তথা আমেরিকার সাথে ছিল, আজ তাদের সেই বাধনে অনেক বড় ফাটল ধরেছে। শুধু ফাটলই ধরেনি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে ¯œায়ু যুদ্ধ শুরু হয়েছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে বৈরিতা শুরু হয়েছে। তবে লক্ষ্য করার বিষয় হল এই যে, ঝগড়াটা কিন্তু প্রথম আমেরিকার মুসলিম মিত্ররা বাধায়নি। বরং আমেরিকাই কাউকে পিকাপ করেছে আবার কাউকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। সেটি করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে যে, মুসলিম জাহানের বড় বড় শক্তিগুলোই আমেরিকা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, ক্ষেত্র বিশেষে এদের কেউ কেউ রাশিয়ার দিকে ভিড়ছে কেউ কেউ চীনের দিকে ভিড়ছে। ছায়াটা এখনো আবছায়া কিন্তু ধীরে ধীরে সেটি অবয়ব ধারণ করছে। দেখা যাচ্ছে যে, আমেরিকা এবং রাশিয়া ছাড়াও ধীরে ধীরে আরেকটি শিবির গড়ে উঠছে। সেটি হল চীনা শিবির।
॥ দুই ॥
এবার আমরা কিছুক্ষণের জন্য সমকালীন বিশ্ব রাজনীতির ওপর আলোকপাত করব। তারপর শেষের দিকে আবার হান্টিংটনের থিসিসে ফিরে যাব।
আমরা সকলেই দেখেছি যে, এইতো ৪-৫ দশক আগেও ৩টি শক্তিশালী মুসলিম রাষ্ট্র সলিডলি মার্কিন ব্লকে ছিল। রাষ্ট্রগুলি হল, তুরস্ক, ইরান ও পাকিস্তান। ইরানের সাথে মার্কিন বৈরিতা শুরু হয় অনেক আগেই, সেই আয়াতুল্লাহ খোমেইনির ইসলামী বিপ্লবের অঙ্কুরোদগমের সময় থেকেই। ধারণা করা হচ্ছে যে, ইরান ইতোমধ্যেই পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হয়েছে। তবে তারা সেটা প্রকাশ্যে ঘোষণা করছে না। এখন তারা চীন এবং রাশিয়া উভয়ের সাথেই যুগপৎ বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করছে এবং এ ব্যাপারে অনেক অগ্রগতিও হয়েছে। ইরান আর আমেরিকার সম্পর্ক তিক্ততার চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল, যে কারণে ইরানের ওপর আমেরিকা এবং পশ্চিমা দুনিয়া নানাবিধ সব কঠিন শর্তসহ অবরোধ আরোপ করেছিল। অবশেষে এই কিছুদিন আগে ওবামা প্রশাসন ইরানের সাথে পারমাণবিক নিয়ন্ত্রণ চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং অবরোধ কিছুটা শিথিল করে। এখন ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। ২০ জানুয়ারি তিনি শপথ গ্রহণ করবেন। নির্বাচনী প্রচারনার সময় ট্রাম্প ওয়াদা করেছিলেন যে, প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে তিনি ইরানের সাথে সম্পাদিত পারমানবিক চুক্তি বাতিল করবেন। যদি তিনি সত্যিই তাই করেন তাহলে ইরানের সাথে আমেরিকার বৈরিতা হবে চিরস্থায়ী।
অন্যদিকে তুরস্ক ছিল আমেরিকার কয়েক দশকের পরীক্ষিত বন্ধু। এশিয়ায় ইরানই একমাত্র দেশ যেটি আধা ওয়েস্টার্ন হয়ে গিয়েছিল। মিঃ এরদোগান চলতি মেয়াদে ক্ষমতায় এসে ইরানকে পশ্চিমের রাজনৈতিক প্রভাব এবং সাংস্কৃতিক বলয় থেকে বের করে আনার চেষ্টা করছেন এবং সে ব্যাপারে অনেকদূর অগ্রগতিও হয়েছে। সেই তুরস্কও রাশিয়ার সাথে মৈত্রী সম্পর্ক গড়ে তোলার আন্তরিক চেষ্টা চালাচ্ছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট কিছুদিন আগে রাশিয়া সফর করেছেন। রাশিয়া সফরের পর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন এবং তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্কের সূত্রপাত ঘটেছে। এই সম্পর্ক রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অনেকদূর যাবে বলে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মহল ধারণা করছেন।
মুসলিম জাহানের আর একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হল পাকিস্তান। পাকিস্তানও ইরান এবং তুরস্কের মতই সম্পূর্ণভাবে মার্কিন ক্যাম্পে ছিল। আসলে আমেরিকা ৫০ এর দশকে এই অঞ্চলে যে আঞ্চলিক উন্নয়ন সংস্থা বা আরসিডি গড়ে তুলেছিল সেই আরসিডির সদস্য ছিল ইরান, পাকিস্তান ও তুরস্ক। ইরান এবং তুরস্ক বর্তমানে মার্কিন বলয় থেকে যতটুকু বেরিয়ে আসতে পেরেছে পাকিস্তান এখনো ততটুকু বেরিয়ে আসতে পারেনি। কিন্তু পাকিস্তানের সাথে আমেরিকার সম্পর্ক বেশ কয়েক বছর হল ভালো যাচ্ছে না। তবে ইরান এবং তুরস্ক যেভাবে মার্কিন প্রভাব বলয় থেকে বেরিয়ে এসেছে পাকিস্তান সেভাবে এখনো পারেনি। এর কারণ সম্ভবত এই যে, ইরান এবং তুরস্কের মত পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর নয়। এছাড়াও পাকিস্তানের আর একটি অসুবিধা হল ভারতের সাথে বিরাজমান কাশ্মীর সমস্যা। ভারত পাকিস্তানের চেয়ে বড় দেশ এবং সামরিক দিক দিয়ে পাকিস্তানের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। এছাড়াও ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর থেকেই সোভিয়েট ক্যাম্পে অবস্থান নেয় ভারত। সোভিয়েট ইউনিয়নের স্থলাভিসিক্ত হয়েছে রাশিয়া। সেই রাশিয়া ভারতকে কাশ্মীর প্রশ্নে অন্ধভাবে সমর্থন দিয়ে এসেছে। বৃহৎ প্রতিবেশি ভারতের বিপরীতে রক্ষা কবচ হিসেবে পাকিস্তান মার্কিন শিবিরে ছিল। তবে সেই ৬০ এর দশকের শেষ দিক থেকেই পাকিস্তান চীনের সাথে সম্পর্কের উন্নতি ঘটানো শুরু করে। এখন পাকিস্তান ও চীন ঘনিষ্ট মিত্র। কাশ্মীর প্রশ্নে চীন পাকিস্তানকে সমর্থন করেছে। অন্যদিকে রাশিয়া এবং পাকিস্তান উভয়েই পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করছে। রাশিয়া থেকে সমরাস্ত্র ক্রয়ের জন্য পাকিস্তান আলাপ আলোচনা শুরু করেছে।
॥ তিন ॥
মনে হচ্ছে, বিশ্ব রাজনীতি পাল্টে যাচ্ছে। একটু আগে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ভারত এবং রাশিয়ার মধ্যে বন্ধুত্ব রয়েছে। ঐদিকে এশিয়ায় চীনকে টক্কর দেয়ার জন্য আমেরিকার সাথে খুব দ্রুত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলছে ভারত। ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকগণ ভারত মার্কিন সম্পর্ককে স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্কের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। ভারতের উদ্দেশ্য, এশিয়াতে চীনকে মোকাবেলা করা। চীনকে মোকাবেলা করার মত সামরিক সামর্থ্য হাসিল করতে হলে তার প্রয়োজন আমেরিকার অকুণ্ঠ সমর্থন। সেই পথেই হাঁটছে ভারত। এছাড়া ইসরাইলের সাথে তার বেশ কিছুদিন ধরেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রয়েছে। ভারত মার্কিন সম্পর্ক এখন স্ট্র্যাটেজিক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। অন্যদিকে পাকিস্তান ও চীন স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্কে আবদ্ধ। ইরান এবং তুরস্ক বিশেষ করে ইরান চীনের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছে।
সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে যে, একদিকে আমেরিকার খ্রিস্টান সভ্যতা, ইসরাইলের ইহুদী সভ্যতা এবং ভারতীয় হিন্দু সভ্যতা ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন যে শুধুমাত্র ভারতের সাথেই নয়, তিনি হিন্দুদের সাথেও সম্পর্ক গড়ে তুলবেন। অন্যদিকে মুসলমানদের সাথে অমুসলিম চৈনিক ও রুশ সভ্যতার মেল বন্ধন শুরু হয়েছে। স্যামুয়েল হান্টিংটন তার সভ্যতার সংঘাত বর্ণনা করতে গিয়ে এক পর্যায়ে এই ধরনের একটি মেরুকরণের চিত্র অংকন করেছেন। এই মেরুকরণ চূড়ান্ত পর্যায়ে কোথায় গিয়ে ঠেকে সেটি এই মুহূর্তে সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে শেষ পর্যায়ে হান্টিংটনের চিন্তাভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিয়ে হিন্দু ও খ্রিস্ট সভ্যতা একদিকে এবং অন্যদিকে মুসলিম ও চৈনিক সভ্যতার যদি সংঘাত শুরু হয় তাহলে সম্ভবত অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আমেরিকা ক্ষীয়মান। চায়না ক্রমবর্ধমান। এই ক্ষয়িষ্ণুতা এবং ক্রমবর্ধিষ্ণুতা তাদের আপন গতিতে যদি ইকুয়ালাইজিং ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে তাহলে বিস্মিত হব না।
Email: journalist15@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন