ম্যাচ শেষ হয়ে গেছে। বৃষ্টি আইনে ৫ রানে হেরে টি-টোয়েন্টি বিশ^কাপ থেকে বিদায়ঘণ্টা বেজে গেছে বাংলাদেশের। তবে বরাবরের মতোই রেশ রেখে গেছে ভারত ম্যাচটি। এবারের কারণও যথারীতি বিতর্কিত। ভারত ক্রিকেটারদের অখেলোয়াড়সূলভ আচরণ, পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিং আর তাতে বরাবরের মতোই ‘রক্ষক হয়ে ভক্ষক’ ভ‚মিকায় আইসিসি!
গতপরশু অ্যাডিলেড ওভালে বিশ্বকাপে সুপার টুয়েলভের ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে বৃষ্টি আইনে ৫ রানে হেরে গেছে বাংলাদেশ। এই হারে সেমিফাইনালে ওঠার আশা অনেকটা ক্ষীণ হয়ে গেছে টাইগারদের জন্য। তবে হার জিত ছাপিয়েও ম্যাচের মধ্যে ঘটে যাওয়া দুটি ঘটনা নিয়ে আলোচনা চলছে। তবে প্রমাণাদী হাতে পাওয়ায় শুধু আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ থাকছে না ঘটনা, পরিণত হয়েছে অভিযোগে। আর তা নিয়ে আইসিসির দরবারেই যাচ্ছে বিসিবি।
ভেজা মাঠে পা হড়কানো...
অ্যাডিলেডে বৃষ্টির সম্ভাবনা ছিল আগে থেকেই, সেই বৃষ্টি নামে বাংলাদেশের ইনিংসের সপ্তম ওভার শেষে। ভারতের দেয়া ১৮৫ রানের বড় লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে লিটনের ব্যাটে ভর করে তখন উড়ন্ত সূচনা করে বাংলাদেশও। যেই বোলারকেই সামনে পেয়েছে, লিটন বেধড়ক পিটিয়েছেন তাকেই। বৃষ্টি নামার আগে বাংলাদেশের সংগ্রহ ছিল ৭ ওভারে বিনা উইকেটে ৬৬ রান। এমন অবস্থায় বৃষ্টি নেমে সেটি শুধু খেলার ছন্দকেই নষ্ট করেছে। বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর বাংলাদেশের নতুন টার্গেট দাঁড়ায় ১৬ ওভারে ১৫১। বৃষ্টি থামার পর মাঠ ভেজা থাকা অবস্থাতেই খেলতে নামতে হয়েছে বাংলাদেশকে। প্রথম ওভারেই রান নিতে গিয়ে ভেজা ঘাসে সিøপ করে পড়ে রানআউট হয়েছেন লিটন। বেধড়ক মার খেয়ে দিশেহারা হয়ে পড়া ভারতের বোলাররা স্বস্তি ফিরে পেয়েছেন লিটনের বিদায়ে। সেখানেই ম্যাচ থেকে ছিটকে যায় বাংলাদেশও। ম্যাচ শেষে বাংলাদেশকে এই ভেজা মাঠে খেলতে বাধ্য করা হয়েছে বলে অভিযোগও করেছেন অধিনায়ক সাকিব আল হাসান!
বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর ক্রিকেট বিষয়ক ওয়েবসাইট তাদের হিসেবে বলেছিল, গ্রাউন্ড খেলার উপযোগী করতে কমপক্ষে ২০ মিনিট সময় লাগবে। এটি স্থানীয় সময় ৯ টা বেজে ৪১ মিনিটের কথা। কিন্তু খেলা শুরু হয়ে গেল ৯টা ৪৯ মিনিটেই! অর্থাৎ, ভেন্যু প্রস্তুত করতে যেখানে ২০ মিনিট লাড়ার কথা সেখানে নেয়া হয়েছে মাত্র ৮ মিনিট! বাংলাদেশে সামাজিক মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় চলছে ভেজা মাঠে খেলানোর অভিযোগ নিয়েও। বৃষ্টির পর মাঠ যথেষ্ট না শুকিয়েই খেলা শুরু করা হয়েছে বলে মনে করছেন ক্রিকেট অনুসারীদের অনেকে। এই ভাবনা আরও উসকে দিয়েছে আম্পায়ারদের সঙ্গে সাকিবের তর্ক করা ভিডিও। সেখানে দেখা যায়, দুই আম্পায়ারের সঙ্গে বেশ উত্তেজিত হয়ে কথা বলছেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। ভারতীয় অধিনায়ক রোহিত শর্মাও ছিলেন পাশে। তিনি কিছু বলার চেষ্টা করলে সাকিব তাকে থামিয়ে দেন। ওই আলোচনাপর্ব শেষেও সাকিবকে খুব একটা খুশি মনে হয়নি।
ম্যাচের পরদিন গতকালও এ বিষয়ে কথা বলতে হলো দলের সঙ্গে থাকা বিসিবি পরিচালক ও ক্রিকেট অপারেশন্স কমিটির চেয়ারম্যান জালাল ইউনুসকে। সাবেক এই ক্রিকেটার গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, সাকিবের চাওয়া ছিল ম্যাচ শুরু করতে আরেকটু সময় নেওয়া, ‘মাঠ ভেজা নিয়েও আলাপ হয়েছিল (আম্পায়ারদের সাথে)। সাকিব বারবার বলছিল যে, ‘তুমি আরও সময় নিয়ে মাঠ শুকাও, আরেকটু সময় নিয়ে খেলা শুরু করো।’ কিন্তু আম্পায়ারদের, ম্যাচ রেফারির সিদ্ধান্তই চ‚ড়ান্ত। এটা নিয়ে তর্ক-বিতর্কের সুযোগ ছিল না। সিদ্ধান্ত একটাই, আপনি খেলবেন কী খেলবেন না।’
তার মানে দাঁড়ায় বাংলাদেশকে অনেকটা বাধ্য করেই মাঠে নামানো হয়েছিল ভেজা মাঠে খেলতে!
ভারতীয়দের অসভ্যতা...
এছাড়াও বিতর্কিত ঘটনা ঘটেছে আরেকটি। বৃষ্টিতে খেলা থামার আগে ভারতের বিপক্ষে ফেইক ফিল্ডিংয়ের অভিযোগ তুলেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু সেই অভিযোগ আমলেই নেননি মাঠের আম্পায়াররা। অথচ লেগ আম্পায়ারের ঠিক সামনেই ফেইক ফিল্ডিংয়ের ঘটনাটি ঘটান ভারতের তারকা ব্যাটসম্যান বিরাট কোহলি। ফেইক ফিল্ডিংয়ের অভিযোগটি রিভিউ করা হলেই পেনাল্টিতে ৫ রান পেতো বাংলাদেশ, আর সেই ৫ রানেই ম্যাচ হেরেছে বাংলাদেশ। সংখ্যাটা কাকতালীয়ভাবে মিলে গেলেও ঘটেছে এমনই।
ম্যাচ শেষে ফেইক ফিল্ডিংয়ের ঘটনাটি নিয়ে আক্ষেপ করে টাইগার উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান নুরুল হাসান সোহান বলেন, ‘মাঠ যে ভেজা, আপনারাও দেখছেন বাইরে থেকে, আমরাও দেখছি। ইভেনচুয়ালি আমার কাছে মনে হয় যে, যখন আমরা কথা বলি... একটা ফেক থ্রোও ছিল। যেটায় ৫ রান পেনাল্টি হয়তো হতে পারত। যেটা আমাদের দিকে আসতে পারত। দুর্ভাগ্যবশত সেটাও আসেনি।’
ঘটনার সময় উইকেটে থাকা ব্যাটসম্যান নাজমুল হোসেন শান্ত তাৎক্ষনিক অভিযোগ করেন আম্পায়ারের কাছে। তবে মাঠের আম্পায়ার সেটি আমলেই নেননি। আম্পায়ার শান্তকে জানান, এরকম কিছু তাদের চোখে পড়েনি। তবে পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেই ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে সেখানে দেখা গেছে স্পষ্ট ফেইক ফিল্ডিংয়ের ঘটনা ঘটিয়েছেন ভারতীয় ক্রিকেটার বিরাট কোহলি। ভিডিওতে দেখা গেছে, সপ্তম ওভারের খেলা চলার সময় অক্ষর প্যাটেলের বলে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টের সীমানার দিকে খেলেছিলেন লিটন। সেখানে ফিল্ডার ছিলেন অর্শদীপ সিং। তার থ্রো উইকেটকিপার দীনেশ কার্তিকের কাছে পৌঁছানোর আগেই ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে থাকা বিরাট কোহলি থ্রোয়ের মতো অঙ্গভঙ্গি করেন। সেটি বৃষ্টি নামার আগের ঘটনা।
ক্রিকেট আইনের ৪১.৫.১ ধারায় বলা আছে, ‘স্ট্রাইকার বল খেলার পর কোনো ফিল্ডার ইচ্ছাকৃতভাবে কথা বা কাজ দ্বারা যেকোনো ব্যাটারের মনোযোগ সরিয়ে দেওয়ার বা ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করলে সেটি “আনফেয়ার প্লে” বলে বিবেচ্য হবে।’ এ ক্ষেত্রে এমন কিছু হয়েছে কি না, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন আম্পায়াররা। এমন কোনো কিছু আম্পায়াররা মনে করলে ওই বলকে ডেড ঘোষণা করা হবে, সঙ্গে ব্যাটিং দলের স্কোরে ৫টি পেনাল্টি রান যোগ হবে। সেটি হলেও ম্যাচটি জিতে যেত বাংলাদেশ!
বাস্তবতা...
বাংলাদেশ হেরে গেছে। সাকিব-তাসকিনদের সঙ্গে হৃদয় ভেঙেছে ১৬ কোটি বাঙালির। তবে ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে ভেজা মাঠে জোর করে খেলানো, ভারত ক্রিকেটারদের ফেইক ফিল্ডিং ও পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিং নিয়ে আইসিসির পরবর্তী সভায় আলোচনা তুলতে চায় বাংলাদেশ। তবে সেই অভিযোগ দেওয়া সহজ নয় বলেও জানান তিনি, ‘কিছু হলেই যে বোর্ড থেকে আলাপ করা হবে, ব্যাপারটা এত সহজ না। এটা তো স্কুল না যে, আপনি গিয়ে হেডমাস্টারের কাছে অভিযোগ করবেন। এই ধরনের পরিস্থিতি না। তারপরেও এটা আমাদের মাথায় আছে, আমরা যেন প্রপার ফোরামে গিয়ে কথা বলতে পারি, এটা মাথায় আছে। ঐ সময়ই আম্পায়ারকে এটা নিয়ে জানানো হয়েছে। তিনি বলেছেন যে তিনি এটা খেয়াল করেননি। এজন্যই রিভিউতে যায়নি। মাঝখানে সাকিব এটা নিয়ে অনেক আলাপ করেছে এরাসমাসের (আম্পায়ার) সঙ্গে। খেলার পরও এটা নিয়ে আলাপ হয়েছে।’
আগামী সপ্তাহে মেলবোর্নে আইসিসির বোর্ড সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। সেখানে সুযোগ পেলে বাংলাদেশ এই ইস্যু তুলবে বলে জানান এই বোর্ড পরিচালক, ‘যখনই সুযোগ পাব, আমরা ইস্যুগুলো নিয়ে আলোচনা করব। এটা কোনো প্রতিবাদ নয়। কারণ, এটা করে এখন আর কোনো লাভ নেই। আমরা আইসিসিকে জানাবো যাতে করে ভবিষ্যতে এমনটা আর না হয়।’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন